১৯৬১ সালের ১৯শে মে বরাকে শিলচর ভাষা আন্দোলন- বিশ্বে মাতৃভাষা আন্দোলনের অন্যতম উজ্জ্বল নজির

কলমে- ঐক্যযোদ্ধা সৌম্য চৌধুরী:

ভাষা আন্দোলন বলতে আমরা সাধারণত বাংলাদেশের ভাষা আন্দোলনকেই বুঝি। কিন্ত বাংলা ভাষা শুধুই বাংলাদেশ বা এই বাংলায় সীমাবদ্ধ নয়, এটি সমানভাবে আসাম ও ত্রিপুরাতেও বিস্তৃত  রয়েছে।   

আসামের বরাক উপত্যকার বাংলা ভাষা আন্দোলন ছিল আসাম সরকারের অসমীয়া ভাষাকে রাজ্যের একমাত্র দাপ্তরিক ভাষা করার সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ, যেহেতু ঐ অঞ্চলের জনসংখ্যার সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ ছিল বাংলাভাষী। 

১৯৬০ সালের এপ্রিলে, আসাম প্রদেশ কংগ্রেস কমিটিতে অসমীয়া ভাষাকে প্রদেশের একমাত্র দাপ্তরিক ভাষা হিসেবে ঘোষণা করার একটি প্রস্তাবের সূচনা হয়। এতে ব্রহ্মপুত্র উপত্যকায় উত্তেজনা বাড়তে থাকে। অসমীয়া উত্তেজিত জনতা বাঙালি অভিবাসীদের আক্রমণ করে। জুলাই ও সেপ্টেম্বরে সহিংসতা যখন উচ্চ রূপ নেয়, তখন প্রায় ৫০,০০০ বাঙালি ব্রহ্মপুত্র উপত্যকা ছেড়ে পশ্চিমবঙ্গে পালিয়ে যায়। প্রায় লক্ষাধিক বাঙালি বরাক উপত্যকা ও উত্তর-পূর্বের অন্যত্র পালিয়ে যায়। ন্যায়াধীশ গোপাল মেহরোত্রার নেতৃত্বে এক ব্যক্তির একটি তদন্ত কমিশন গঠন করা হয়। কমিশনের প্রতিবেদন অনুযায়ী, কামরূপ জেলার গোরেশ্বর অঞ্চলের কয়েকশো গ্ৰাম ও কয়েকশো মানুষের ওপর অমানুষিক অত্যাচার করা হয় ‌। 

বরাক উপত্যকার বাঙালীদের ওপরে অসমীয়া ভাষা চাপিয়ে দেওয়ার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে ১৯৬১ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি তারিখে কাছাড় গণ সংগ্রাম পরিষদ নামক সংগঠনটির জন্ম হয়। অসম সরকারের এই অন্যায়ের বিরুদ্ধে ১৪ এপ্রিল তারিখে শিলচর, করিমগঞ্জ আর হাইলাকান্দির লোকেরা সংকল্প দিবস পালন করেন । বরাকের জনগণের মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টি করার জন্য এই পরিষদ ২৪ এপ্রিল একপক্ষ দীর্ঘ একটি পদযাত্রা শুরু করেছিল। ২ মে তে শেষ হওয়া এই পদযাত্রাটিতে অংশ নেওয়া বাঙালি সত্যাগ্রহীরা প্রায় ২০০ মাইল উপত্যকাটির গ্রামে গ্রামে ঘুরে প্রচার চালিয়েছিলেন। পদযাত্রার শেষে পরিষদের মুখ্যাধিকারী রথীন্দ্রনাথ সেন ঘোষণা করেছিলেন যে, যদি ১৩ এপ্রিল,১৯৬১ সালের ভিতর বাংলাকে সরকারী ভাষা হিসেবে ঘোষণা করা না হয়, ১৯ মে তে তারা ব্যাপক হরতাল করবেন। ১২ মে তে অসম রাইফেল, মাদ্রাজ রেজিমেন্ট ও কেন্দ্রীয় সংরক্ষিত পুলিশ বাহিনী শিলচরে ফ্ল্যাগ মার্চ করেছিল। ১৮ মে তে অসম পুলিশ আন্দোলনের তিনজন নেতা নলিনীকান্ত দাস, রথীন্দ্রনাথ সেন ও বিধুভূষণ চৌধুরী (সাপ্তাহিক যুগশক্তির সম্পাদক) কে গ্রেপ্তার করে।

১৯ মে তে শিলচর, করিমগঞ্জ ও হাইলাকান্দিতে হরতাল ও পিকেটিং আরম্ভ হয়। করিমগঞ্জে আন্দোলনকারীরা সরকারী কার্যালয়, রেলওয়ে স্টেশন, কোর্ট ইত্যাদিতে পিকেটিং করেন। শিলচরে তারা রেলওয়ে স্টেশনে সত্যাগ্রহ করেছিলেন। বিকেল ৪টার সময়সূচির ট্রেনটির সময় পার হওয়ার পর হরতাল শেষ করার কথা ছিল। ভোর ৫:৪০ এর ট্রেনটির একটিও টিকিট বিক্রি হয় নি। সকালে হরতাল শান্তিপূর্ণ ভাবে অতিবাহিত হয়েছিল। কিন্তু বিকালে স্টেশনে অসম রাইফেল এসে উপস্থিত হয়।

বিকেল প্রায় ২:৩০র সময় ন'জন সত্যাগ্রহীকে কাটিগোরা থেকে গ্রেপ্তার করে পুলিশের একটি ট্রাক তারাপুর স্টেশনের (বর্তমানের শিলচর রেলওয়ে স্টেশন) কাছ থেকে পার হয়ে যাচ্ছিল । পিকেটিংকারী সকলে তাদেরকে গ্রেপ্তার করে নিয়ে যেতে দেখে তীব্র প্রতিবাদ করেন। ভয় পেয়ে ট্রাকচালক সহ পুলিশরা বন্দীদের নিয়ে পালিয়ে যায়। এর পর কোনো অসনাক্ত লোক ট্রাকটি জ্বালিয়ে দেয়, যদিও দমকল বাহিনী এসে তৎপরতার সাথে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনে। তারপর প্রায় ২:৩৫ নাগাদ স্টেশনের সুরক্ষায় থাকা প্যারামিলিটারী বাহিনী আন্দোলনকারীদেরকে বন্দুক ও লাঠি দিয়ে মারতে শুরু করে। এরপর সাত মিনিটের ভিতর তারা ১৭ রাউণ্ড গুলি বাঙালি আন্দোলনকারীদের লক্ষ্য করে গুলিবর্ষণ করে।

 বাংলা মায়ের ভাষাকে প্রতিষ্ঠিত করতে যে ১১ জন সেদিন শহীদ  হন তাদের মধ্যে অন্যতম হলেন শ্রীমতী কমলা ভট্টাচার্য (পৃথিবীর প্রথম মহিলা ভাষা শহীদ)। এছাড়া যারা শহীদ হয়েছিলেন তাঁরা হলেন তরণী দেবনাথ, কানাইলাল নিয়োগী, শচীন্দ্রপাল, বীরেন্দ্র সূত্রধর, সুনীল সরকার, কুমুদ রঞ্জন দাস, সত্যেন্দ্র দেব, হীতেশ বিশ্বাস, চন্ডীচরণ সূত্রধর, সুকোমল পুরকায়স্থ ও কৃষ্ণকান্ড বিশ্বাস।

অবশেষে আসাম সরকার আন্দোলনকারীদের চাপের মুখে শেষ পর্যন্ত বাধ্য হয়েছিল আসামে বাংলা ভাষাকে দ্বিতীয় রাজ্য ভাষার স্বীকৃতি দিতে।

 আজকের এই দিনটি বাঙালির কাছে নিছকই এক প্রতীক মাত্র নয়। এই দিনের সাথে জুড়ে আছে তার সংগ্রামের ইতিহাস ,মাতৃভাষা রক্ষার জন্য তার ভালবাসার কথা, ভাষার জন্য তার সমস্ত সযত্নে লালিত আবেগ, আর রয়েছে বন্দুকের নলের সামনে দাঁড়িয়েও হার না মানার এক অদম্য, একরোখা মনোভাব। ভাষার মধ্যেই লুকিয়ে থাকে একটি জাতির বেঁচে থাকার সব রসদ। এটি তার প্রতিনিয়ত লড়াই করার অবলম্বন। বাংলা ভাষার প্রতি বিমাতৃসুলভ আচরণ করে অতীতেও যেমন বাঙালিকে বঞ্চনার মুখে ফেলা হয়েছে, আজও বাংলা ভাষাকে হেয়  করে হিন্দিভাষাকে অন্যায়ভাবে জোর করে চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা চালিয়ে যাওয়া হচ্ছে। কিন্তু সেই  tradition  সমানে চলতে আর  দেওয়া যায় না। যখনই কোথাও বাংলা ভাষার প্রতি অবমাননা হবে, সমগ্র বাঙালি জাতি এক হয়ে গর্জে উঠে তাকে রক্ষা করবে। ১৯৬১ সালে করেছিল, আজও করবে।