১৯৮৬’র ২১শে জুলাই দুই ভাষা শহিদ আজ বিস্মৃতির গাঢ়তর অন্ধকারে হারিয়ে যাওয়া দুইটি নাম মাত্র


দিব্যেন্দু দাশ ও জগন্ময় দেব




সন্দীপন ধর, সংবাদ একলব্য:


অবচেতনের অন্ধকারে ইতিহাসের পথ ধরে ব্যতিক্রমী হাতে গোনা কিছু মানুষ পথ হাঁটে , কোন বিলাসিতায় নয় দায়বদ্ধতায় । ইতিহাসকে টেনে নিয়ে বর্তমানে এনে ভবিষত্যের দিকে ঠেলে দিয়ে সেই সব ব্যতিক্রমীরা সময়ের সেতুবন্ধ রচনা করেন । সাধারণ বাঙালিরা যেমন আত্মঘাতী তেমন আত্মবিস্মৃতও । আত্মবিস্মৃত বলেই ভাগ্যের ঘুর্ণি ঝড়ে তারা ছিন্নমূল । সময়ের প্রবহমান স্রোতে ভাসমান বাঙালি সত্তা এগিয়ে যায় শিকড়কে অস্বীকার করে । সময়ের প্রত্যাহ্বানের কাছে পরাভূত নতজানু বাঙালি নিজের ভাগ্যকে জয় করার অধিকার নিজের হাতেই বিসর্জন দিয়েছে । বিসর্জন দিয়েছে বলেই ১৯৮৬’র দুই ভাষা শহিদ আজ বিস্মৃতির গাঢ়তর অন্ধকারে হারিয়ে যাওয়া দুইটি নাম মাত্র । অথচ বিংশ শতকের আটের দশকে ঘটে যাওয়া বহুমাত্রিক ঘটনার গোলকধাঁধায় যেমন সংকট তৈরি হয়েছিল আবার সেই সংকট থেকে উত্তরণের দিশা ও খুঁজে পাওয়া গিয়েছিল সংগ্রামের মধ্যে।


দিব্যেন্দু দাশ ও জগন্ময় দেবের আত্মবলিদানে ৬১ সালের একাদশ শহিদের আত্মবলিদানের স্পর্ধিত হুংকার । আত্মবিস্মৃত বাঙালির দূর্বল স্মৃতি শক্তি সেই হুংকারকে ধরে রাখতে পারেনি । সংগ্রামী চেতনা বোধ উত্তরণের পথে না গিয়ে অবনমনের তলায় তলিয়ে যেতে লাগল ।


২১শে জুলাই স্মরণ করতে গিয়ে প্রাসঙ্গিক কারণেই কথাগুলো মনে এসে শ্রাবণের মেঘের মত মনে ভীড় করে । একটি ছাত্র সংস্থার কয়েকজন এখনো নিষ্ঠার সঙ্গে শহিদ বিজন চক্রবর্তীকে স্মরণ করে কিন্তু বিজন (বাচ্চু) চক্রবর্তী বরাক উপত্যকার সাধারণ মানুষের সচেতন বা অবচেতন কোন স্মৃতিতেই নেই ।


৬১’র ভাষা আন্দোলনের একাদশ শহিদকে আমরা কি পেরেছি যথাযোগ্য সস্মান জানাতে ? পারিনি , আর যেটুকু পেরেছি বা আজও পারছি তা আশির দশকের উত্তাল সময়ে তৈরি হওয়া স্পর্ধিত চেতনা বোধের অবশিষ্ট অংশের জন্য । ৬১’র ভাষা শহিদদের স্মৃতি তর্পণ করার মত গণচেতনা সত্তরের দশকে ও ছিল না । বিগত দুই তিন দশক থেকে ৬১’র ভাষা শহিদদের নিয়ে এক দিবসীয় হুজুগে উন্মাদনা হয় বটে কিন্তু সেটা উদযাপনের আনন্দেই থেকে যায় , স্মরণের গভীরতায় গিয়ে সংগ্রামী চেতনা বোধকে প্রদীপ্ত করে না ।


এই না পারা অসহায়ত্ব বা সীমাবদ্ধতাকে নিয়তি মেনে নিয়ে বাঙালিরা আত্মতুষ্ট । ইতিহাস চর্চা বিমুখ বাঙালিরা খণ্ডিত ধর্মীয় মোহে পথভ্রষ্ট । এই প্রেক্ষিতেই “ উদযাপনের আনন্দে নয়, স্মরণের গভীরতায় ২১শে জুলাইর শহিদদের শ্রদ্ধাঞ্জলি”’ শীর্ষক নিবন্ধের পথ চলা ।


ভাষা আন্দোলনের ঐতিহ্য ও ধারাবাহিকতায় বরাক উপত্যকায় কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপিত হলেও বিশ্ববিদ্যালয়ের কোন উপাচার্য বা ইতিহাস বিভাগ ভাষা আন্দোলনের ঋণ স্বীকার করে কোন প্রামান্য ইতিহাস সংকলনের কাজ আজ পর্যন্ত হাতে নিল না । বিক্ষিপ্ত ভাবে সংখ্যায় অতি নগন্য কয়েকজন পি এইচ ডি উপাধি অর্জনে কিছু কাজ করলেও প্রকাশনা যোগ্য কোন তাৎপর্যপূর্ণ কাজ আজ অব্দি হয়নি ।


সমাজতাত্ত্বিক ইতিহাসবিদ সুজিত চৌধুরীর লেখা ইতিহাসও বিশ্ববিদ্যালয়ের উদাসীনতায় চিরতরে হারিয়ে গিয়েছে , বলা ভাল চুরি হয়েছে । হয়তো সুজিত বাবুর সেই লেখা ইতিমধ্যে কয়েক ডজন পি এইচ ডি প্রসব করেছে । বর্তমান উপাচার্যের কার্যকলাপ ভাষা আন্দোলনের গৌরবময় ঐতিহ্যকে শুধু বিরোধিতা নয় ব্যঙ্গ ও করে।


১৯৮৪তে জন্ম নেওয়া বিজেপির দলীয় সংগঠন ছিল না , তবে বিজেপি দলের মতাদর্শে বিশ্বাসীরা ভাষা আন্দোলনে কোন সদর্থক ভুমিকা পালন করেছেন বলে কষ্ট করেও স্মরণ করতে পারছি না । আসা যাক কংগ্রেসের কথায় , আসাম রাজ্যে তখন এজিপি দলের সরকার এবং কংগ্রেস তখন বিরোধী দলে ।বিরোধী দলে থেকে সরকার বিরোধী আন্দোলনের ইস্যুকে কাজে লাগানোর কোন চেষ্টাই কংগ্রেস করেনি । করবার কথাও নয় , স্বাধীনতার আগের থেকেই আসাম কংগ্রেসে বাঙালিরা ব্রাত্য । চাটুকার বৃত্তিতে যারা পারদর্শি তারা তবুও কিছুটা কল্কে পেতেন অন্যরা ব্রাত্য হয়েই উপেক্ষিত থাকতেন ।


ভুলে গেলে চলবে না ৮৬ সালে বরাক উপত্যকার বেশিরভাগ জনপ্রতিনিধি কংগ্রেসের ছিল , ইচ্ছা করলে কংগ্রেস সেবা সার্কুলারের বিরুদ্ধে ভাষা আন্দোলনে বলিষ্ট ভুমিকা পালন করতে পারত , কিন্তু শুধু নৈতিক সততার অভাবে ঝাপসু, বাভসু ইত্যাদি ছাতা মাথা সংগঠন বানিয়ে ভাষা আন্দোলনকে বিভ্রান্ত করতেই ব্যস্ত হয়ে উঠাই ছিল কংগ্রেসের একমাত্র কাজ । আসা যাক বামপন্থী দল সিপিএম, সিপিআইর কথায়। ৬১সালের আন্দোলনে যে দলের ( অবিভক্ত) ইতিবাচক ভুমিকা ছিল , ৭২ সালে যে দুই বামপন্থী দল সিপিআই এবং সিপিএম অগ্রণী ভুমিকা নিয়েছিল সেই দুই দল একশত আশি ডিগ্রী ঘুরে ১৯৮৬তে নেতিবাচক ভুমিকা পালন করল । ৮৬সালে এজিপি সরকারে সিপিআই মন্ত্রীত্বের স্বাদ পেয়ে আসাম আন্দোলনে তাদের দলের শহিদদের কথা ভুলে গেলেন আর ক্ষমতার চেয়ারে না বসলেও ক্ষমতার অলিন্দে বসে থাকার আনন্দে মশগুল সিপিএম তাদের দলের শহিদদের কথা বেমালুম ভুলে গেলেন । বরাক উপত্যকার একাংশ মুসলমান এবং কয়েকজন শিক্ষিত হিন্দুরা এজিপি দলে সামিল হয়ে শহিদদের কফিনে পেড়েক মারতে ব্যস্ত হয়েছিলেন ।


প্রত্যেকটি রাজনৈতিক দলের একটি যুব সংগঠন ও একটি ছাত্র সংগঠন থাকে । যুব ও ছাত্র সংগঠনের মস্তিষ্ক রাজনৈতিক দলেই যদি উপত্যকা বিরোধী জীবাণু বাসা বাঁধে তখন তার অঙ্গ প্রত্যঙ্গ অসাড় হয়ে সঠিক কাজ করবে না , এটাই তো স্বাভাবিক । স্বাভাবিকতার ব্যত্যয় হবে না , হয়ওনি । কংগ্রেসের গোষ্টী দ্বন্দ্ব ব্যাঙ্গের ছাতার মত বেশ কয়েকটি ছাত্র যুব সংস্থার জন্ম দিয়েছিল যারা কোন ধরনের সদর্থক করেনি । সেবা সার্কুলারের বিরুদ্ধে আন্দোলনের সমান্তরাল বিশ্ববিদ্যালয়ের দাবী নিয়ে আন্দোলন চলছিল । এতে ও বিভ্রান্তি এক পক্ষ বলছে কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয় অন্যদল রাজ্যিক বিশ্ববিদ্যালয় , একদল বলছে শুধু রাজ্যিক নয় প্রস্তাবিত বিশ্ববিদ্যালয়টি হতে হবে বরাক উপত্যকার বাইরে । গৌহাটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসের সমর্থনে এক গোষ্টী প্রচার করছিল । বহুমাত্রিক দ্বান্দ্বিকতার প্রেক্ষিতেই সেবা সার্কুলারের আনুষ্ঠানিক বিজ্ঞপ্তি জারি হল । মিহির লাল রায়ের নেতৃত্বে কয়েকটি সংগঠনের মিলিত সমন্বয় কমিটির নেতৃত্বেই সংগ্রাম পরিচালিত হচ্ছিল ।


৬১’র ভাষা আন্দোলন করিমগঞ্জে শুরু হয়ে করিমগঞ্জেই শক্তি সঞ্চিত করছিল কিন্তু গুলি বৃষ্টি হল শিলচরে আর ৮৬তে শিলচরে শুরু করে শিলচরেই শক্তি বৃদ্ধি করছিল কিন্তু গুলি হল করিমগঞ্জে । ৬১ এবং ৮৬তে বাঙালিদের পাশাপাশি অন্যান্য ভাষিক গোষ্ঠির মানুষরা সংগ্রামে অংশ নিয়ে নির্নায়ক ভুমিকা পালন করেছিলেন ।৬১’র ১৯শে মে তারিখের ঠিক এক মাস পরের তারিখে অর্থাৎ ১৯শে জুন ভয়ানক দাঙ্গার উস্কানি প্রতিহত করতে যাদের পুলিশের গুলিতে মারা হয়েছিল ৮৬’র ২১শে জুলাই তারিখের ঠিক পরের দিন মুখ্যমন্ত্রী নিজে হাইলাকান্দিতে গিয়ে তাদের শহিদ বলে ঘোষণা করে ইতিহাসের একটি বৃত্তকে সম্পূর্ণ করলেন । যারা ধর্মকে প্রাথমিকতা দিয়ে ভাষিক সত্তাকে লঘু মনে করেন কি হিন্দু কি মুসলমান তারা কোনদিনই ভাষার আগ্রাসনকে গুরুত্ব দিতে নারাজ এবং নিজেদের মাতৃভাষা মর্যাদা রক্ষার আন্দোলন থেকে দূরে রাখেন যেমন মুক্তি যুদ্ধে ছিলেন জামাতিরা ,রাজাকাররা । তাঁদের মধ্যে যারা “হিন্দু” তাঁরা বিশুদ্ধ দেবভাষা সংস্কৃত উচ্চারণে বিধানসভা লোকসভাতে শপথ নেন আর যারা “মুসলমান” তাঁরা অসমীয়া ভাষায় বিধানসভায় শপথ নেন ।


৬১’র একাদশ শহিদের কিংবা ৭২ সালের বিজন চক্রবর্তীর বা ৮৬ সালের জগন যীশুর আত্মবলিদান এই উপত্যকায় ভাষাকে ধর্মের আগে নিয়ে আসতে সফল হয়নি । ভাষা আন্দোলনের অসমাপ্ত পর্যায়কে সম্পূর্ণতা দিতে উদ্যোগ নিতে হবে যেমন করে বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধের রেশ ধরে রাখতে শাহবাগ আন্দোলন শুরু করতে হয় । মানুষ জানেনা সে কতটা হিন্দু- মুসলমান বা কতটা বাঙালি কতটা অসমীয়া । নিত্যদিনের স্নান যেমন মহাসাগরের উত্তাল ঢেউয়ে করা সম্ভব হওয়ার নয় ক্ষুদ্র অর্ধ শিক্ষিত , অশিক্ষিত মানুষেরা নিত্যদিন মানবতার মহাসাগরে নিজেকে আবিষ্কার করা সম্ভব নয় । তখন ক্ষুদ্রত্বের সীমায়িত গণ্ডিতে মানুষ নিজেকে খুঁজে নিতে চায় । আর ঠিক তখন ধর্মের যষ্টিকে এগিয়ে দিয়ে ভাষিক সত্তার বিভাজনে একদল পেশাদার রাজনীতিবিদ এগিয়ে আসেন ।


নির্বাচনের ভরা মরশুমে বরাক উপত্যকার বাইরে থেকে এসে দুই লক্ষ ভোট জোগার করে ব্রহ্মপুত্র উপত্যকায় গিয়ে জনগণনায় বাঙালি মুসলমানদের মাতৃভাষা অসমীয়া ভাষা লিখতে আহ্বান করেন তখন মনে হয় শহিদের আত্মবলিদান ব্যর্থ হয়েছে। ইতিহাসের পথ চলা যেমন অন্ধকারে থেমে যায় না , সাময়িক ভাবে পথভ্রষ্ট হওয়া আর চিরতরে থেমে থাকা এক কথা নয়। একসময় যেমন ব্রহ্মপুত্রের বিভাজনের রাজনীতির বিপ্রতীপে বরাক উপত্যকায় সমন্বয়ের উৎসব , মৈত্রী উৎসব করে বহুত্ববাদকে স্বীকৃতি দিয়ে বহুত্ববাদের বর্ণময়তাকে মেনে নেওয়া হয়েছিল আজ আবার সেই পথেই হেঁটে যেতে হবে ।


ইতিহাস চর্চায় বিলাসিতায় নয় দায়বদ্ধতায় ঐতিহ্যের সাথে আধুনিকতার সংমিশ্রণ ঘটাতে হবে । উদযাপনের আনন্দে নয় স্মরণের গভীরতায় শহিদদের প্রাণ সঞ্চার করে বরাক উপত্যকার মুক্তি পথের সন্ধান করতে হবে । আসামের বাঙালিদের বিচ্ছিন্ন করে নয় সঙ্গে নিয়ে চলতে হবে । প্রাসঙ্গিকভাবেই মনে হল ২০১০ সালের ২১শে জুলাই বরপেটার চার শহিদের কথা যাদের আত্মবলিদানে কয়েক লক্ষ হিন্দু – মুসলমান বাঙালির নাগরিকত্ব রক্ষা পেয়েছিল । নির্মোহ ইতিহাস পাঠ হউক আজকের প্রতিজ্ঞা।