কেন রবীন্দ্রনাথ? — কাব্যের আধুনিকতা 


rabindra nath tagore


ড. উৎপল মণ্ডল 
প্রফেসর, বাংলা বিভাগ, উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয় 
utpalnbu@yahoo.com 


বাংলা সাহিত্যে আধুনিকতার কথা বললেই ঝপ করে দুটো সময় ভেসে ওঠে চোখে। তাই, বিষয়টা একটু আগে থেকে, অন্যভাবে ভাবা দরকার। প্রথম আধুনিকতা বাংলা সাহিত্যে আসছে উনিশ শতকে; সাহিত্য সমালোচকেরা তাই বলছেন এবং তা আসছে নবজাগরণের হাত ধরে। এটা আমরা সকলেই জানি। এই যে নবজাগরণের হাত ধরে বাংলা সাহিত্যে প্রথম আধুনিকতা আসছে তার প্রথম পুরোহিত অবশ্যই মধুসূদন দত্ত। শিবনারায়ণ রায় মহাশয় বলছেন, তিনি শুধুমাত্র বাংলা সাহিত্যে নয়, সমগ্র ভারতবর্ষের প্রথম আধুনিক কবি। এবং কি অদ্ভুত সমাপতন যে বছরে মধুসূদন দত্তের আধুনিকতার প্রকাশ, সেই বছরই আবির্ভাব রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের (১৮৬১)। উনিশ শতকের এই আধুনিকতার অনেক বৈশিষ্ট্য যা সাহিত্যের ইতিহাসের বইতে লেখা আছে, কিন্তু কেন্দ্রিয় কথা দুটো – (এক) মানবতাবাদ (দুই) ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য। এই ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যের হাত ধরেই কিন্তু আসছে গীতিকবিতা। বাঙালির প্রতিভা মূলত গীতিকাব্যিক। অর্থাৎ গীতিপ্রাণতাই বাঙালির ধর্ম।কিন্তু গোটা মধ্যযুগের সমস্ত কাব্যে গীতিকবিতার সমস্ত বৈশিষ্ট্য থাকা সত্ত্বেও তাঁকে গীতিকবিতা বলা হয় না, কারণ তাতে আমিত্ব ছিল না। ‘আমি ভালোবাসি তার অস্থি মাংস সহ’ – এইভাবে বলা ছিল না। যেখানে বলা ছিল ‘রাধার কি হইল অন্তরে ব্যাথা’, আমার অন্তরে কি হইল তার কথা বলা ছিল না। এই নবজাগরণের কেন্দ্রে যে ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য; তার হাত ধরেই আসে গীতিকবিতা। সেই গীতিকবিতা রবীন্দ্রনাথের হাতে যখন পড়ল তখন তা পৌঁছে গেল বিশ্বের দরবারে। গীতিকবিতা এক আন্তর্জাতিক মাত্রা পেল। 

আর দ্বিতীয় আধুনিকতা রবীন্দ্রউত্তরকালের আধুনিকতা; অর্থাৎ তিরিশের কবিদের থেকে যার সূত্রপাত। তার আগেই নজরুল- মোহিতলাল- যতীন্দ্রনাথ,এই তিনজনের মধ্যে অন্যরকম প্রয়াস দেখা যায়, কিন্তু আসলে রবীন্দ্রোত্তর আধুনিকতাকে পাচ্ছি তিরিশের দশকে- তেমনই বলেন সমালোচকরা। উনিশ শতক আর বিশ শতকে তিরিশের দশক – এই দুটো সময়ের মাঝখানে রবীন্দ্রনাথ কি করছেন – সেটা আমরা দেখবো। এবং তাঁর মধ্যেও কোথায় লুকিয়ে আছে পরবর্তী আধুনিকতার সূত্র – তাও দেখবো।


উনিশ শতকের কাব্যভাষায় মূলত আমরা যেটা দেখেছি, অল্প কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া, সেটা হচ্ছে বস্তুসত্য (মেটেরিয়ালিস্টিক ট্রুথ)। প্রথম রবীন্দ্রনাথের গানে এই জায়গাটা উঠে আসে এবং ভাঙতে শুরু করে অবশেষে পৌঁছে যান সেনসেশনাল ট্রুথে। রবীন্দ্রনাথ যখন লেখেন ‘শ্রাবণঘন গগন মোহে গোপন তব চরণ ফেলি’ সুরেশচন্দ্র সমাজপতিরা তখন ব্যাঙ্গ করে বলেন, চরণ কি করিয়া গোপন হয় তাহা বুঝিতে পারিলাম না। বক জাতীয় কোনও কোনও পক্ষী একটি চরণ গোপন করিয়া থাকে’। তাঁরা ধরতেই পারছেন না রবীন্দ্রনাথ নিঃশব্দে শব্দকে মেটেরিয়ালিস্টিক ট্রুথ থেকে সেনসেশনাল ট্রুথে পৌঁছে দিচ্ছেন। ‘আমি কান পেতে রই’, ‘তোমার এই আসন তলে মাটির পড়ে লুটিয়ে রব’ প্রভৃতি পঙতিও লক্ষ্যণীয়। ব্যাপারটা তো এমন নয় যে, কারো পায়ের তলায় তিনি ধুলোয় লুটোপুটি খাবেন। এই অর্থ তাঁরা ধরতে পারছেন না। উনিশ শতকের কাব্যে মেটেরিয়ালিস্টিক ট্রুথের ছবি পাচ্ছি মধুসূদনের কাব্যে – ‘অশ্রুআঁখি বিধুমুখী ভ্রমে কুঞ্জবনে/ কভু ব্রজ কুঞ্জবনে হায়রে যেমনি/ ব্রজবালা নাহি হেরি কদম্বের মূলে/ পীতধরা পীতাম্বরে অধরে মুরলী’। -- উপমাটিতে কৃষ্ণকে না দেখে রাধার মনের যে অবস্থা, তার চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। 



এই ছবির পাশাপাশি আর একটি দৃষ্টান্ত দেখুন- ‘দূরে দূরে গ্রাম দশ বারোখানি/মাঝখানে একখানি হাট/ সন্ধ্যায় জ্বলে না প্রদীপখানি/ প্রভাতে পড়ে না ঝাট’; কিংবা, ‘কুমোর পাড়ার গরুর গাড়ি/বোঝাই করা কলসি হাঁড়ি’ – এসব কবিতায় চোখের সামনে ভেসে উঠছে সেই চিত্রটাই, বস্তু সম্পর্কে যা বলা হচ্ছে। কিন্তু ‘গোপনে তব চরণ ফেলে’ বা ‘সোনার তরী’র ‘ভরা পালে চলে যায়/ কোনো দিকে নাহি চায়/ ঢেউগুলি নিরুপায় ভাঙে দুধারে’ প্রভৃতি কবিতা ভিন্ন মার্গের। বুদ্ধদেব বসু বলছেন, ঢেউগুলিকে নিরুপায় হতে হল মিল রক্ষার তাগিদে; ছন্দ রক্ষার তাগিদে। আসল ব্যাপারটা যে তা নয়, সেটা প্রথম বললেন সরোজ বন্দ্যোপাধ্যায়। উনিশ শতকীয় যে মিলের কথা বুদ্ধদেব বসু বলেছেন সেটা কিন্তু এখানে নেই, যেখানে নৌকোর হাল পড়ছে, সেখানে ঢেউ তো তার নিজস্ব গতি হারাতে বাধ্য। এটাই ঢেউয়ের নিরুপায়তা এবং তার পরিণতি কূলে গিয়ে আছড়ে পড়া। প্রশ্ন সেখানেও নয়। আসলে মেটেরিয়ালিস্টিক ট্রুথ থেকে আবেদনটি পৌঁছে যাচ্ছে সেনসেশনাল ট্রুথে। অর্থাৎ আসলে সে নাবিক মহকাল, সে উদাসীন। নাবিক চলে যাচ্ছে, তার কাছে জল জগতের ঢেউ যেমন নিরুপায়, চাষীও সেরকম নিরুপায়। কবিতার শেষে গিয়ে আমরা তাই দেখতে পাবো। এই ভাবে ক্রিয়া ও বিশেষণকে বিশেষভাবে ব্যবহারের মধ্য দিয়ে রবীন্দ্রনাথ কবিতা লেখার পূর্বতন ঢংকে সম্পূর্ণত ভেঙে দিয়েছেন বলেই মনে হয়। 



রবীন্দ্রনাথের গানে এটা দেখা যাচ্ছে বারবার। “আমি কান পেতে রই” বা “তোমার ঐ আসন তলে মাটির পরে লুটিয়ে রব” বা “যে রাতে মোর দুয়ারগুলি ভাঙলো ঝড়ে/ জানি নাইকো তুমি এলে আমার ঘরে/ সব যে হয়ে গেল কালো/ নিবে গেল দীপের আলো’ --এখানে কীভাবে বস্তুসত্য ভেঙে যাচ্ছে দেখা যাক। প্রশ্ন হলো বস্তু সত্য দিয়ে যদি ভাবা হয়, তাহলে প্রথমে প্রশ্নটা হবে ঝড়ের গতিবেগ কত ছিল? অথবা দরজাগুলি কত পলকা ছিল? 

একটা একটা করে দরজাগুলি ভেঙে গেল কীভাবে – এই ধরণের কোনো প্রশ্ন আমাদের মনে আসছেই না। আমরা স্বাভাবিক জ্ঞান থেকেই বুঝে যাচ্ছি ব্যাপারটা আসলে কী? এটাকেই বলতে চাইছি নিঃশব্দ বিপ্লব। আধুনিকতা মানে আপাতভাবে যে চিৎকার চেচামেচি, তা না করেও এক নিশঃব্দ বিপ্লব ঘটে যাচ্ছে রবীন্দ্রনাথের হাতে। আর এভাবেই পাঠকের মননভূমিটাকে তিনি তৈরি করে দিচ্ছেন। আমাদের বিশ্বাস এই নিঃশব্দ বিপ্লবে পাঠকের মননভূমিটাকে যদি রবীন্দ্রনাথ তৈরি করে না দিতেন, তাহলে প্রথমত বাঙালি, পাঠক বুঝতেই পারতেন না – শিশিরের শব্দের মতন কীভাবে সন্ধ্যা নেমে আসে। 



দ্বিতীয়ত, বস্তু সত্য থেকে সেনসেশনাল সত্যের দিকে যে যাত্রা, যা তিরিশের কবিতায় দারুণভাবে রয়েছে, তারও সূচনা এই লগ্নেই, আর আমাদের নির্ণীত এই সিদ্ধান্তই যাবতীয় পোস্টমর্ডান তত্ত্বগুলির ভিত্তিভূমি। এটা নিশ্চয়ই একবাক্যে সবাই স্বীকার করবেন যে, পোস্টমর্ডান সমস্ত তত্ত্বের আঁতুরঘর ফের্দিনা দ্য সোস্যুরের ভাষাতত্ত্ব। তিনি লাঙ পারোলের কথা বলেছেন – একটা সমাজ স্বীকৃত সত্য আর একটা সমাজস্বীকৃত নয়। প্রসঙ্গত বলে নেওয়া ভালো স্যোসুর মারা যাচ্ছেন ১৯১৩ তে, এবছরই রবীন্দ্রনাথ নোবেল পাচ্ছেন। আর সমস্যা হল, সোস্যুর কিছু লিখে যাননি। তাঁর প্রিয় দুই ছাত্র আলবেয়ার শেসেই ও শার্ল বালি স্যস্যুর যে গল্পগুলি বলতেন সেগুলি তাঁর মৃত্যুর পর প্রকাশ করেন। এর ওপরই দাঁড়িয়ে আছে পোস্টমর্ডান থিয়োরিগুলি। অথচ স্যস্যুর যে তত্ত্বের কথা বলছেন, রবীন্দ্রকাব্যে তা এসে গেছে অনেক আগেই। 



এর পর কল্লোল গোষ্ঠী চলে আসে আর তিনি দেখেন কিভাবে পয়েটিক ডিকশন বদলে যাচ্ছে। । বিষয়টি একটু বুঝে নেওয়া যাক-- 



প্রয়োজনের খাতিরে এর আগের ইতিহাসটা একটু দেখে নিতে হবে। ১৯১৭ তে হয়ে গেল বলশেভিক বিপ্লব। ১৯২২ শে নজরুলের ‘ধূমকেতু’ পত্রিকায় ‘বিদ্রোহী’ কবিতায় চলে আসছে ‘টরপেডো’ ‘মাইন’ প্রভৃতি শব্দ। তার কিছু পরে প্রেমেন্দ্র মিত্র লিখছেন—‘আমি কবি যত কামারের আর ছুতোরের, মুটে মজুরের/ আমি কবি যত ইতরের’। আমাদের দেশে তখন মার্কসীয় দর্শন ঢুকে পড়েছে। তিরিশের কবি সাহিত্যিকেরা ভাবছেন নিচের তলার মানুষদের জন্য। এই সময় থেকেই কবিতার ভাষাও যে বদলে যাচ্ছে তা রবীন্দ্রনাথ খুব ভাল করে বুঝতে পারছেন। তার মোক্ষম দুটি প্রমাণ হল – (এক) তাঁর ব্যক্তিগত চিঠিপত্র (দুই) শেষের কবিতায় কবিতার দুটি দল। একটা দল বলছে রবীন্দ্রনাথের কবিতা বড্ড সেকেলে হয়ে যাচ্ছে। এই সমালোচকদের আড়ালে আসলে রবীন্দ্রনাথ এটা নিজেই নিজেকে নিয়ে বলছেন। অর্থাৎ তিনি নিজের সেকেলে হয়ে যাওয়ার ব্যাপারটি বুঝতে পারছেন ও নিজেকে ক্রমাগত বদলে নিচ্ছেন। যার প্রমাণ ‘খাপছাড়া’তে পাচ্ছি – ‘শুটকি মাছের যারা রাধুনিক/ সেই দলেতে ছিলে তুমি আধুনিক’। আরও পরে তাঁর চারপাশের জীবন ও জীবন সংলগ্ন শব্দকে কবিতায় তুলে ধরেছেন। এই সময়ের বহু কবিতায় তার বহু প্রমাণ আছে—গলিটার কোণে কোণে/ জমে ওঠে পচে ওঠে/ আমের খোসা ও আঁটি, কাঁঠালের ভুতি/ মাছের কানকা/ মরা বিড়ালের ছানা /ছাইপাশ আর কত কী যে’ অথবা ‘ মরা বিড়ালের দেহ পেঁকো নর্দমায়/ বীভৎস মাছির দল ঐক্যতান বাদন জমায়’। এই ভাষা রবীন্দ্রনাথ তাঁর কবিতায় ব্যবহার করছেন। নিজেকে বার বার ভেঙে নিজেকেই এবং সমকালকে অতিক্রম করছেন। 



আধুনিকতার সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য পরীক্ষা নিরীক্ষা এবং ক্রমাগত গ্রহণ বর্জন। শুধুমাত্র কবিতার ক্ষেত্রেই নয়, জীবনের ক্ষেত্রেও একটি আধুনিক ও বড় বৈশিষ্ট্য। শুধু তাই নয়, যে সময়ের কথা বলা হচ্ছে, সেই সময় তিরিশের কবিরা প্রায় সকলেই চলে এসেছেন। ১৯২৭ এ ‘ঝরাপালক’ লেখা হয়ে গেছে। সুধীন্দ্রনাথ, অমিয় চক্রবর্তী সকলেই চলে এসেছেন। এদের কবিতায় ভাষাগত বিশেষত্ব আমরা লক্ষ্য করি।একটু ব্যাখ্যা দরকার। বোদলেয়ার বলেছেন আমাদের পঞ্চ ইন্দ্রিয়ের অনুভূতি আলাদা আলাদা কিন্তু এর কেন্দ্রিয় জায়গাটা এক অর্থাৎ মন। ত্বকের যে অনুভূতি, কান দিয়ে যা শুনছি; তা যাচ্ছে মস্তিষ্কে। সেখান থেকে নির্দেশ আসছে। সামনে কারা আছে বা কাদের দেখছি তাও নির্দেশ দিচ্ছে ব্রেন। বোদলেয়ার বলছেন আমাদের প্রত্যেক ইন্দ্রিয়ের যে ইন্দ্রিয়বেদ্যতা তার উৎস হচ্ছে এক। সেটাই যদি হয়, তাহলে এক ইন্দ্রিয়ের ইন্দ্রিয়বেদ্যতাকে আরের ইন্দ্রিয়ের মধ্য দিয়ে প্রকাশ করলে অসুবিধে কোথায়? বোদলেয়ারের এই বক্তব্যের ফল ‘ডানার রৌদ্রের গন্ধ মুখে ফেলে চিল’ অথবা ‘শিশিরের শব্দের মতন সন্ধ্যা আসে’। এই সিনেস্থেসিয়া বা অনুভুতির ইন্দ্রিয়ান্তরকরন- এটা রবীন্দ্রনাথ কবিতার মধ্য দিয়ে দেখাচ্ছেন (১) বাজিয়েছে বীণ তোমার আঁখির আলো (২) নিরীহ দিনগুলি ব্যাঙের মতো একঘেয়ে ডাকে(ক্যামেলিয়া)। (৩) চাঁদের হাসি বাঁধ ভেঙেছে’,(৪) এ অশ্রুজল,এ ভাঙা বুক/ভাঙ্গা বাদ্যের মতো বাজিয়ে সাথে সাথে নিশিদিন-- অনেক আছে এমন। 

রবীন্দ্রনাথের কবিতায় যে সিনেস্থেসিয়া আছে, তা আমরা ভাবতে পারছি না। তার কারণ ছন্দের মধ্য দিয়ে তিনি লিখছেন এবং সুরের মধ্যে আমরা হারিয়ে 

যাচ্ছি। এভাবেই ভাষাতাত্ত্বিক দিক থেকে রবীন্দ্রনাথ সময়কে অনুভব করছেন এবং তাঁকে অতিক্রম করে যাচ্ছেন, যা তিরিশের কবিদের অনেকটা সহায়ক হয়ে উঠছে। মানুষ অসচেতনভাবে কবিতার মধ্য দিয়ে সেনসেশনাল ট্রুথকে বুঝতে পারছে। তা রবীন্দ্রনাথ কবিতার মধ্য দিয়ে তুলে না ধরলে সাধারণ মানুষ বুঝতে পারতো না। 

এছাড়া আধুনিক কবিতার আরো বিষয়গত দিক থেকে বৈশিষ্ট্যের কথা সমালোচকেরা বলে থাকেন। যেমন ‘পরাবাস্তবতা’ – তাঁর শেষের দিকের কবিতাগুলির মধ্যে প্রচুর পরাবাস্তবতার ছবি আছে। ‘বিচিত্রিতা’র ‘কালোঘোড়া’ কবিতাটি যেমন – ‘কালো ঘোড়ার অন্তরে যে সাদা …./ সে আমার অন্ধ অভিলাস… অসাধ্যের সাধনায় ছুটে যায় বলে……।সাবকনসাস মাইন্ডের চিন্তাভাবনা, পরাবাস্তবতা, প্রান্তিকের ৫ নম্বর কবিতাটিতে লক্ষ্য করি।রবীন্দ্রউত্তর কবিদের কবিতায় যে নৈরাশ্যবোধ দেখা যায়, তা রবীন্দ্র কবিতাতেও প্রচুর আছে। ‘নবযাত্রিক’, ‘কেন’ প্রভৃতি কবিতা লক্ষ্য করলেই বিষয়টি বোঝা যায়। আমার একান্ত ব্যক্তিগত মতামত এই যে, আধুনিক কবিদের যে নৈরাশ্যবোধ তা এসেছে ব্যক্তিগত না পাওয়া থেকে, নির্বেদ থেকে। আর রবীন্দ্রনাথের নৈরাশ্যবোধ কোনো ব্যক্তিগত না পাওয়া থেকে নয়, এসেছে বিশ্বগত যন্ত্রনাবোধ থেকে। 

আধুনিক কবিদের যে নগরচেতনা, তা রবীন্দ্রনাথেও প্রচুর রয়েছে। ‘চিত্রা’র ‘নগরসঙ্গীত’, ‘বধু’ কবিতায় প্রচুর নগরচেতনা রয়েছে। 

ডারুইনের বিবর্তনবাদ রবীন্দ্রনাথের বহু কবিতায় উঠে এসেছে। ‘সমুদ্রের প্রতি’, ‘বসুন্ধরা’ ,’প্রথম দিনের সূর্য’ প্রভৃতি কবিতায় তার পরিচয় পাওয়া যায়। ডারউইনের বিবর্তনবাদের মধ্যে রয়েছে, জীবজগতের অনাগত ভবিষ্যতের সম্ভাবনার কথা। একে উলটে আমরা বলতে পারি যে, আমরা বিবর্তিত হতে হতে কোথায় চলে এসেছি এবং আগামী দিনে কোথায় গিয়ে পৌঁছাবো, তা আমরা জানি না। রবীন্দ্রনাথের কবিতায় এইরকম একাধিক ডাইমেনশন উঠে এসেছে। কিংবা বলা ভাল মাল্টিডাইমেনশনাল বলেই তা কবিতা। 

“প্রথম দিনের সূর্য 
প্রশ্ন করেছিল সত্তার নতুন আবিরভাবে 
কে তুমি 
মেলেনি উত্তর। 

* * * * * 

দিবসের শেষ সূর্য 
শেষ প্রশ্ন উচ্চারিল 
কে তুমি 
পেলো না উত্তর।” 


বিবর্তনবাদের তত্ত্ব এখানে খুব সুন্দরভাবে উঠে এসেছে। সমুদ্রের প্রতি , বসুন্ধরা প্রভৃতি এরকম অনেক কবিতায় তা আছে। 

আর সবথেকে বড় কথা ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য। আইনস্টাইনের এই আপেক্ষিকতাবাদের সাথে সাধারণ মানুষের ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যের দারুণ মিল আছে—আমারই চেতনার রঙে পান্না হল সবুজ/চুনী উঠলো রাঙা হয়ে/ আমি বললাম গোলাপ সুন্দর/তাই গোলাপ সুন্দর হয়ে উঠলো । এখানে চূড়ান্ত আপেক্ষিকতার দৃষ্টান্ত উঠে এসেছে। আমার সাপেক্ষে গোলাপ সুন্দর, সেটা অন্যের কাছে সুন্দর নাও হতে পারে। 

বিজ্ঞান তো রবীন্দ্রনাথের কবিতার যত্রতত্র। ইওরোপ কবিতায় বিজ্ঞানকে ধরতে পারেননি, রবীন্দ্রনাথ পারলেন। বিজ্ঞানীরা বলছেন, পৃথিবীর সমস্ত গতিশক্তি উৎপন্ন হয় স্থিতিশক্তি থেকে। ‘বলাকা’র ‘ছবি’ কবিতায় কবি লিখছেন ‘তুমি কি কেবলই ছবি শুধু পটে লেখা’। তারপর বলছেন—তুমি আমার মধ্যে আছো, আমি গতিশীল সুতরাং তুমিও গতিশীল। কাইনেটিক এনার্জি শুরু হচ্ছে পোটেনশিয়াল এনার্জি থেকে – এই ভাবনা মিশে গেছে যেন গোটা কবিতার ভাববস্তুতে । 

..আধুনিক কবিদের, বিশেষত তিরিশের কবিদের প্রধান বৈশিষ্ট্য আন্তর্জাতিকতা। তিরিশের কবিরা প্রচন্ড আন্তর্জাতিক। অথচ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে হিরোসিমার ঘটনা আধুনিক কবিদের কবিতায় প্রভাব ফেলল না। কিন্তু রবীন্দ্রনাথের আন্তর্জাতিকতা একটি সত্যকারের বোধ। ১৯১৪ তে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ। ভারতে বসেই তিনি লিখছেন ‘বলাকা’র ‘ঝড়ের খেয়া’—দূর হতে কি শুনিস মৃত্যুর গর্জন ওরে.. এখানে, এই যে মানব সভ্যতা চূড়ান্ত দুর্দিনের কবলে পড়েছে, তিনি বলছেন এর মধ্য দিয়েই তরী বেয়ে নিয়ে যেতে হবে। কবিতার শেষে কবি বলছেন ‘নতুন উষার স্বর্ণদ্বার খুলিতে বিলম্ব কত আর’। অর্থাৎ এই দিন একদিন গত হবে। গায়ক নচিকেতা চক্রবর্তীর ভাষায় ‘পৃথিবী আবার শান্ত হবে’। কবিও এমনই ভাবছেন। কিন্তু পৃথিবী শান্ত হলনা। ১৯৩১এ হিটলার জার্মানীতে বসলেন চ্যন্সেলর হয়ে। তারপর জার্মানী সহ ইওরোপের ইতিহাস অনেকেরই জানা। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কারণ প্রথম বিশ্বযুদ্ধ। ভার্সাই সন্ধির মধ্য দিয়ে জার্মানীর ওপর যা চাপিয়ে দেওয়া হল এবং জার্মানীকে যেভাবে পর্যুদস্ত করা হল, অর্থনৈতিক দায় চাপানো হল; সেই পরিস্থিতিতে হিটলারের মতো মানুষের প্রয়োজন ছিল। তখন রবীন্দ্রনাথের অন্তিম সময়। বার বার অসুস্থ হচ্ছেন। ‘প্রান্তিক’ কাব্যে লিখছেন – ‘নাগিনীরা চারিদিকে ফেলিতেছে বিষাক্ত নিশ্বাস/ শান্তির ললিত বাণী শোনইবে ব্যররথ পরিহাস/ বিদায় নেবার আগে ডাক দিত্যে যায়/ দানব্বের সাথে যার আসংগ্রামের তরে/প্রস্তুত হতেছে ঘরে ঘরে’। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালিন অসুস্থতা থেকে উঠে লিখছেন ‘আরোগ্য’ কাব্যের ‘ওরা কাজ করে’ কবিতাটি। এই কবিতার সাথে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কোনও যোগ আছে কিনা আমাদের জানা 

নেই, কিন্তু আমার মনে হয় ১৯৪০ এর কোনও এক সময়ে কবিতাটি লেখা হয়েছে—‘অলস সময় পানে চেয়ে মন চলে শূণ্য পানে চেয়ে’। একজন অসুস্থ মানুষের আকাশের দিকে চেয়ে ইতিহাসের কথা মনে পড়ছে। এসেছে মোঘল, ইংরেজ; একে একে সবাই চলে গেছে; ইংরেজও চলে যাবে; তিনি ভবিষ্যতবাণী করেছেন—‘জানি তার পণ্যবাহী সেনা জ্যোতিষ্কলোকের মাঝে রেখামাত্র চিহ্ন রাখিবে না’। এবং তিনি বলছেন, এই সাম্রাজ্যবাদীদের ইতিহাস ‘শিশুপাঠ্য কাহিনী’তে স্থান পাবে। তাঁদের তৈরি ইতিহাস আসল ইতিহাস নয়, ইতিহাস রচনা করে কর্মমুখর মানুষ। যে মানুষটি প্রথম বিশ্বযুদ্ধের রক্তাক্ত পৃথিবীকে দেখে আশা পোষণ করেছিলেন’ উষার স্বর্ণদ্বার খুলিতে বিলম্ব কত আর’ সেই বিশ্বমানবতাবাদী মানুষটি দেখছেন নতুন উষার স্বর্ণদ্বার তো খুললো না, পৃথিবী আবার বিষবাস্পে জর্জরিত হচ্ছে। এটুকু নিশ্চিতভাবেই বলা যায় এই মৃত্যুপথযাত্রী প্রাজ্ঞ মানুষটি নিতান্ত বালখিল্য মানসিকতা থেকে ভবিষ্যৎ বাণী করবেন না। আসলে এখানে তিনি সাম্রাজ্যবাদী শক্তিকে আলতো করে চাবুক মেরেছেন। আর এখানেই এই কবিতার সাথে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সম্পর্ক রচিত হয়ে যায়। এখানেই রবীন্দ্রনাথের বিশ্ববোধ। আর এই বিশ্ববোধ একান্তভাবেই বাঙালীর ভাবে প্রকাশিত। কবিতায় তিনি বিদেশী শব্দ একেবারেই ব্যবহার করেননি। সারা বিশ্ব তিনি ঘুরেছেন, আত্মস্থ করেছেন, গ্রহণ করেছেন কিন্তু প্রকাশ করেছেন একেবারেই বাঙালি ভাবে, সরল ভাবে, বিদেশিয়ানার কোন ছিটেফোঁটাও ! আর একটা কথা বলে শেষ করবো, যা ঠিক আধুনিক নয় উত্তরাধুনিক স্তরে। 

এখন তো পোস্ট কলোনিয়াল ভাবনা ভাবা হয়, কিন্তু আমি যদি বলি, ইংরেজ শাসনে বসে একজন মানুষ সেই ভাবনাই ভেবেছেন !!