শিবপ্রসাদ মুস্তাফির টেরাকোটা শিব মন্দিরের অজানা ইতিহাস

মুস্তাফির টেরাকোটা শিব মন্দিরের



নিজস্ব সংবাদদাতা, তপন বর্মন:

শ্রাবণ মাস শিবের মাস, শিব ভক্তদের পবিত্র মাস। এই মাসে শিব লিঙ্গে জল ঢেলে শিব ভক্তরা তাদের মনস্কামনা পূরণের জন্য শিবের কাছে প্রার্থনা করে থাকেন। কোচবিহার জেলার বিভিন্ন শিব মন্দিরগুলিতে এই মাসে শিব ভক্তদের ঢল নামে। ফলে অতি প্রাচীন কাল থেকেই এই শিব মন্দিরগুলি ঐতিহ্য বহন করে আসছে।

কোচবিহার জেলার দিনহাটা মহকুমার গোবরাছড়া নিকটবর্তী শিবপ্রসাদ মুস্তাফির টেরাকোটা শিব মন্দির এই প্রসঙ্গে উল্লেখযোগ্য। প্রায় ২৩৫ বছরের পুরোনো এই শিব মন্দির প্রতিষ্ঠার নানান ইতিহাস রয়েছে। এমনকি মন্দির নির্মাণ শৈলীও মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করে।

দিনহাটা মহকুমা থেকে প্রায় ১২ কিমি দূরে গোবরাছড়া বাজারের দক্ষিণ পূর্ব প্রান্তে বানিয়াদহ নদী বেষ্টিত প্রায় ২৩৫ বছরের পুরোনো এই শিব মন্দির। চারপাশে সবুজ খেত আর সারি সারি তালগাছে ঘেরা পুকুর পারে এই শিব মন্দির তৎকালীন কোচবিহার রাজ্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ শিব মন্দির।

বিভিন্ন পুরাতন পত্র পত্রিকা, সামাজিক মাধ্যম, স্হানীয় মানুষ জন ও পূজা কমিটির সদস্যদের কাছ থেকে এই মন্দির প্রতিষ্ঠা সম্পর্কে নানান তথ্য পাওয়া যায়।

কোচ মহারাজা মোদনারায়ণের আমলে (১৬৬৫-১৬৮০ খ্রিঃ) রাঢ়ীয় শ্রেণির ব্রাহ্মণ রূপচন্দ্র মজুমদার সে সময় কোচবিহার রাজ্যের রাজকর্মচারীরূপে নিযুক্ত হয়ে মহারাজের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন এবং মুস্তাফি উপাধি ও পদপ্রাপ্ত হন।স্থাপত্যটির নির্মাণ প্রমাণগত ভাবে রূপচন্দ্রের অধস্তন চতুর্থ পুরুষ গৌরী নন্দন মুস্তাফির উদ্যোগে হয়েছিল। যিনি কোচ মহারাজা উপেন্দ্রনারায়ণের আমলে (১৭১৪-১৭৬৩ সাল) রাজ্যের খাসনবিশ পদে ও পরবর্তীতে মহারাজা দেবেন্দ্রনারায়ণের সময় (১৭৬৩-১৭৬৫ সাল) মহামন্ত্রীপদে নিযুক্ত ছিলেন। তাই দীর্ঘদিনব্যাপী রাজ্যের এক প্রধান আমলা থাকায় তাঁর পক্ষে ব্যক্তিগত উদ্যোগে এই অনন্য সাধারণ স্থাপত্য তৈরি সম্ভবপর হয়েছিল। এই সময় কোচবিহারে আরেকটি বিখ্যাত টেরাকোটার বিমিশ্র শৈলীর মন্দির নির্মিত হয়েছিল, যেটা ধলুয়াবাড়ি সিদ্ধনাথ শিব মন্দির।

জানা যায় দিনহাটা মহকুমার গোবরাছড়া -নয়ারহাট গ্রাম পঞ্চায়েতের অন্তর্গত ভিতর কুঠিতে (২০১৫ সালে ছিট বিনিময়ের পর শিবপ্রসাদ মুস্তাফি) সন্তানহীন খাসনবীস ও প্রধানমন্ত্রী গৌরী নন্দন মুস্তাফির বসত বাড়ি ছিল এবং এ স্হানে তাদের জমিদারি ছিল। এই বসতবাড়ি নিকটেই আনুমানিক ১৭৯০-১৭৯৫ খ্রিষ্টাব্দে তিনি এই শিব মন্দির বা বুড়া বাবার মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন। শিবের প্রসাদে তিনি পুত্র সন্তান লাভ করেন তাই তার ১৫ তম বংশধরের নাম রাখেন শিবপ্রসাদ মুস্তাফি। ইনি পরবর্তীতে তৎকালীন কোচবিহার রাজ্যের বিচারালয়ের বিচারপতি নিযুক্ত হয়েছিলেন।

এই মন্দির সংলগ্ন প্রায় ২২৫ বিঘা জমি রয়েছে। সেই সাথে মন্দির প্রতিষ্ঠা লগ্নে প্রায় ২০০টি তালগাছ দিয়ে ঘেরা ১২ বিঘা জমির আয়তনের একটা পুকুর ছিল। যার নাম ছিল তাল পুকুর। যদিও এখন এ স্হানে তিনটি পুকুর খনন করা হয়েছে এবং অল্প কয়েকটি তালগাছ মাথা উঁচু করে প্রাচীন স্মৃতি আকড়ে ধরে আছে।

মন্দিরের স্থাপত্যশৈলী ও টেরাকোটার কাজ দেখলে বিস্মিত হতে হয়। বাংলার ইটভাটা থেকে ইট এনে এই মন্দির নির্মাণ করা হয়।

মন্দিরটির দৈর্ঘ্য ও প্রস্থ যথাক্রমে ১৫ ফুট X ১০ ফুট। দেওয়ালের পুরূত্ব ২০ ইঞ্চি। যে ইঁটগুলি নির্মাণকাজে ব্যবহৃত হয়েছিল সেগুলির নির্দিষ্ট আয়তন ৫ X ৩ X ২। মন্দিরের অভ্যন্তরে গর্ভগৃহে প্রায় ৩ ফুট উচ্চতা বিশিষ্ট একটি শিবলিঙ্গ রয়েছে তার পাশে আছেন গণেশ এবং নন্দী । গৌরীনন্দন মুস্তাফি নিজের হাতে এই শিব লিঙ্গ স্হাপন করেন।

এই মন্দিরটির উচ্চতা প্রায় ৩০ ফুট। ১৮৯৭ সালের ভুমিকম্পে মন্দিরটি প্রায় পাঁচ ফুট মাটির নিচে বসে যায়। টেরাকোটার অলঙ্করণে অলঙ্কৃত এই মন্দিরটি নির্মাণের জন্য রাঢ় বঙ্গ থেকে শিল্পীদের নিয়ে আসা হয়। মন্দিরের সামনের দেওয়ালে শোভা পাচ্ছে খোদাই করা বিভিন্ন দেব দেবীর মূর্তি। এদের মধ্যে মন্দিরের প্রবেশ দ্বারের উপরেই রয়েছে দশভূজা সহ নানান দেবদেবীর মূর্তি। এছাড়াও অতি প্রাচীন কাল থেকেই মন্দিরের পাশে একটা পাঙুয়া গাছ এবং মন্দিরের দক্ষিণ পাশে পাতকুয়ো এখনও প্রাচীন স্মৃতি বহন করছে।

পুরোনো দিনের নিয়ম অনুসারে এই মন্দিরে শিব চতুর্দশীর তিনদিন ছাড়া সাধারণের প্রবেশ নিষেধ ছিল। সেসময় মন্দিরের সামনে বসত মেলা । অসংখ্য ভক্তদের জন্য ফলাহারের ব্যবস্হা ছিল। সমস্ত ব্যয়ভার মুস্তাফি জমিদার পরিবার বহন করত। পরবর্তীতে ভারতবর্ষ স্বাধীন হওয়ার পর শিবপ্রসাদ মুস্তাফি তালুক ছিটমহলে পরিণত হয় ফলে সে স্হান জনশূন্য হয়ে পরে। পরবর্তীতে ২০১৫ সালে ছিট বিনিময়ের পর আবার এ স্হানে রাস্তা ঘাট, ইলেক্ট্রিক ব্যবস্হার উন্নতির ফলে এখানে আবারও পূজার দিনগুলোতে জন জোয়ার নামে।

এই মন্দির দীর্ঘদিন মুস্তাফি জমিদার পরিবারের থাকলেও পরবর্তীতে জমির মালিকানা চ্যাটার্জী পরিবারের হাতে চলে যায়। জানা যায় গৌরীনন্দন মুস্তাফির পুত্র শিবপ্রসাদ মুস্তাফি এবং তার পুত্র বিষ্ণু প্রসাদ মুস্তাফির এক ছেলে এক মেয়ে ছিল। মেয়ের নাম শ্যামা সুন্দরী দেব্যা। ময়মনসিংহের আটঘরিয়ার ব্রাক্ষ্মণ গৌরচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে তার বিয়ে হয়। ১২৫৫ বঙ্গাব্দ তথা ১৮৪৮ খ্রিস্টাব্দে এই বিয়ে সম্পন্ন হয়েছিল। এই বিয়ে উপলক্ষে জামাতা গৌরচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়কে বিষ্ণুপ্রসাদ মুস্তাফি যৌতুক হিসেবে ১২০০ বিঘা জমি দান করেন। তার পর থেকে বংশ পরম্পরায় চ্যাটার্জী পরিবারের হাতে এ সম্পত্তি রক্ষিত হয়ে আসছে এবং মন্দিরের তত্বাবধানের দায়িত্বে তারাই রয়েছেন।