দিনহাটা থেকে গোবড়াছড়া । গোবড়াছড়া জুনিয়ার হাইস্কুলের ঠিক পাশ দিয়ে মেঠোপথ ধরে পায়ে হেটে দুই মিনিট গেলেই জীর্ণ এক মন্দির । মন্দিরের গায়ে বটের শেকড় । এটাই মুস্তাফীদের দুর্গা মন্ডপ। দুর্গা মন্ডপটা ছেড়ে আর একটু পথ হাটলেই পুরানো ইটের বাড়ি। লতাপাতায় ঢেকে গেছে- এটাই জমিদার বাড়ি। ইতিহাস এভাবেই বোধহয় ঢেকে যায়। বিশেষত বাঙালি যেখানে ইতিহাস চর্চায় অনাগ্রহী সেখানে এই জমিদার বাড়ির বোবাকান্না শোনবার মতন মানুষ আজ নেই, তবে জমিদার বাড়ির অনেক কথাই লোকমুখে গল্প হয়ে বেঁচে আছে। 

এই জমিদার বাড়িতেই পূজা হতো দেবী দুর্গার। জমিদার না থাকলেও এই ভগ্ন মন্দিরে পার্শ্ববর্তী মানুষেরা পূজা দিত মন্দিরের ভেতর বেদীতে। বিগত চার বছর থেকে পুনঃরায় মূর্তি দিয়ে পূজা শুরু হয়েছে। 


ইতিহাস বলে ১৬৬৫ খ্রিষ্টাব্দে মহারাজা মোদনারায়নের রাজত্বকালে রূপচন্দ্র মজুমদার নামে এক ব্রাহ্মণ কোচবিহারে রাজকার্যে যোগদান করে। কিছুদিনের মধ্যে রাজার আস্থাভাজন হন এবং মুস্তাফি পদ লাভ করেন। রাজার কাছে কতটা বিশ্বস্ত এবং গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছিলেন এই মুস্তাফি জমিদার তা লোকমুখে প্রচলিত প্রবাদেই প্রমাণ মেলে- 
‘সাতখুন মাফ মুস্তাফির’ ।১ 


গোবড়াছড়া ভিতরকুঠিতে জমিদারী প্রাপ্তিরপর কুলদেবী দুর্গার পূজা পুনঃরায় শুরু করেন। অনেকে বলে থাকেন কোচবিহারের কুলদেবি বড়দেবীর অনুকরনে মুস্তাফিরাও রক্তবর্ণা দেবীর আরাধনা করেন। প্রসঙ্গত প্রশ্ন থেকে যায়, রাজবাড়ির অনুসরণই যদি হয় তবে গোবরাছরার দেবী দুর্গার পাশে জয়া-বিজয়া কোথায়? বরং সাবেকি ঢঙ্গে দেবীদুর্গার পাশে এখানে পূজিত হন গনেশ, কার্তিক,লক্ষ্মী,সরস্বতি। তাই এক্ষেত্রে মনে হয় রক্তবর্ণের প্রচলন রাজানুকরণমাত্র। দেবি দুর্গার যে পূজার প্রচলন এখানে করা হয় তা কোচবিহারে আসবার আগে থেকেই প্রচলিত ছিল। 

তবে যাইহোক- রূপচন্দ্র মজুমদার কোচবিহারে আসবারপর গোবরাছড়ায় যে দেবীবন্দনার শুরু করেন তা এই সমস্ত অঞ্চলে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিলো। একটি প্রবাদে তার প্রমাণ পাওয়া যায়- 
“কোচবিহারের রাস 
বলরামপুরের বাঁশ 
শুটকাবাড়ির বিবি 
গোবড়াছড়ার দেবী।”২

শোনাযায়, মোস্তাফিদের জমিদারীতে এই পূজা উপলক্ষ্যে সমগ্র জমিদারীতে অরন্ধন ঘোষণা করা হত। পূজার তিনদিন পার্শ্ববর্তি মাঠে বসত মেলা। নদীর ওপারের মানুষজনও ছুটে আসত এই মেলায়। ওপার থেকে আসত মাটির বাসনপত্র। মেলার তিনদিনের একদিন সমস্ত দর্শনার্থীদের জন্য সমস্ত কেনাকাটা বিনামূল্যে হত। কিন্তু সেটা কোনদিন হবে তা জমিদার বাবু ছাড়া আর কাররই জানা থাকত না। পূজা উপলক্ষ্যে জমিদার বাড়িতে বসত চোখের ডাক্তার । এই চিকিৎসাও হতো একদম বিনাপয়সায়। 

দশমীর দিন মন্দির সংলগ্ন পুকুর থেকে তুলে আনাহত জমিদার বাড়ির সিন্ধুক । শিকল লাগিয়ে হাতি দিয়ে টেনে তোলা হত সেই সিন্ধুক । বছরে মোট তিনবার তোলা হতো । এই সিন্ধুক নিয়েও রয়েছে কাহিনী। 

তবে দুঃখের বিষয় রাজ আমলের এই মন্দির এবং তৎসংলগ্ন জমিদার বাড়ির ভগ্নস্তুপ,পুকুর সংরক্ষণের উদ্যোগ নেওয়া হয়নি । মন্দির ছেয়ে যাচ্ছে বটের শিকড়ে । একদিন হয়তো এই বটবৃক্ষই গল্প শোনাবে আগামীকে- এক জমিদার বাড়ির গল্প – রক্তবর্ণা দুর্গা মায়ের গল্প। 

তথ্যঋণঃ ১) সিতাংশু শেখর মুস্তাফী 

২) বিবর্তনের হাত ধরে গোবড়াছড়ার রক্তবর্ণা দেবী দুর্গা- দেবব্রত চাকী/ তোর্ষা প্রবাহ/সম্পাঃ দিলীপ রায়/উৎসব সংখ্যা 

বিস্তারিত দেখুন ভিডিওতে-