সন্তান-সন্ততির মঙ্গলকামনার্থে মুলা ষষ্ঠীর ব্রত



সুজাতা ঘোষ, বাগডোগরা :

বাঙালি-জীবনে বছরভর পালিত হয় ব্রত-পার্বণ সহ নানান ধরনের লোকায়ত আচার অনুষ্ঠান। মূলত সন্তান-সন্ততির মঙ্গলকামনার্থে অগ্রহায়ণ মাসের শুক্লপক্ষের ষষ্ঠীর দিন  হিন্দু মায়েরা মুলা ষষ্ঠীর ব্রত পালন করে থাকেন।


এই ষষ্ঠী দেবী হলেন বঙ্গীয়, বহির বঙ্গীয় সনাতন হিন্দু ধর্মাবলম্বী এক পৌরাণিক দেবী । হিন্দু শাস্ত্রানুসারে এই ষষ্ঠী দেবী প্রতি মাসেই বিভিন্ন নামে পূজিত হন আর অগ্রহায়ণ মাসে মুলা ষষ্ঠী নামে পূজিতা হন। তবে এবছর আশ্বিন মাস মলমাস হওয়ায় পূজা পিছিয়ে অগ্রহায়ণ মাসে না হয়ে পৌষ মাসে পালন করা হয়।



এই ব্রতের পেছনে প্রচলিত একটি কাহিনী রয়েছে -

'কোন এক দেশে কোন এক  ব্রাহ্মণ তার ছেলে বউ নিয়ে বাস করত ।  তাদের অবস্থা মোটামুটি ভালো ,বাড়িতে তাদের অনেক কাজের লোক । বাড়ির কর্তার একদিন মাংস খেতে ইচ্ছা করলে সে বাজার থেকে হরিণের মাংস নিয়ে এল। বৌমা তা নিয়ে রান্না করতে গেল। রান্না হয়ে গেলে তার স্বাদ কেমন হয়েছে তা জানতে কাজের মেয়েটাকে একটু চাখতে দিল। নুন ,ঝাল সব ঠিক আছে কিনা তা চাখতে চাখতে কাজের মেয়েটি সব মাংস খেয়ে ফেলল। তাই দেখে বউয়ের মাথায় হাত,সে বলে,  “সব মাংস খেয়ে ফেললি, শ্বশুর এলে আমি কি খেতে দেব? যেখান থেকে পারিস হরিণের মাংস কিনে আন।”



ঝি আর কি করে সে বাজারে ছুটল মাংস আনতে। কিন্তু অনেক খোঁজাখুঁজি করেও মাংস আর পেল না। শেষে বাড়ি ফেরার পথে দেখে বাগানে একটা মরা বাছুর পরে আছে, তার থেকে বেশ খানিকটা মাংস কেটে ধুয়ে সে বউকে দিলে। বৌমা ভালো করে রান্না করছে কিন্তু দেখে মাংস সিদ্ধ আর হয় না। বৌমা তখন ঝিকে ডেকে জিজ্ঞেস করল,  “কিরে এটা কিসের মাংস নিয়ে এসেছিস?  দুঘন্টা ধরে সিদ্ধ হয় না। ঝি আর কি বলবে। এইদিকে সময় গড়িয়ে যায়,মাংস আর সিদ্ধ হয় না,বাড়ির কর্তার খাবার সময় হয়ে গেল। শ্বশুর এসে জিগেস করে “বৌমা রান্না হল?”


তা শুনে বউ ভয়েই মরে, শেষে একটা ফন্দি বার করল। সে ঝিকে ডেকে বলল, “তুই রান্না ঘরে তেল আর জল ঢেলে রাখবি ,আমি যেই রান্না ঘরে যাব অমনি পা পিছলে পরে যাব আর তুই আমার মাথায় মুখে ঘড়া ঘড়া জল ছিটোবি তাহলে সব খাবার নষ্ট হয়ে যাবে।”



ওই দিকে দুম করে পড়ে যাবার শব্দে সবাই রান্না ঘরে ছুটে গেল,আর বৌমার কথামত ঝি তার মাথায় এমন জল ছিটে দিল যে সব খাবার নষ্ট হয়ে গেল।  সেই দিন আর কারোর খাবার জুটল না। বউ তারপর তার স্বামীকে সব খুলে বলল, আর ঝিকে জিজ্ঞেস করল, “কোথা থেকে এই মাংস নিয়ে এসেছিস তা দাদাবাবুকে দেখা।”



ঝি আর কি করে সে মরা বাছুর কে দেখাল। তা দেখে বামুনের ছেলে তো অবাক। সে এসে বউকে সব বলল। বউ ঝিকে খুব কথা শোনাল। তারপর এই পাপ থেকে বাঁচার উপায় খুঁজতে থাকল। সেইদিন ছিল অগ্রহায়ণ মাসের ষষ্ঠী। বৌমা মুলো, কলা, পান, তেল, হলুদ দিয়ে মা ষষ্ঠীর পুজো করে সেই পুজোর ফুল মরা বাছুরের উপর দিয়ে দিল। কি অবাক কান্ড! সেই মরা বাছুর বেঁচে উঠল। আর তা দেখে চারিদিকে ধন্য ধন্য পরে গেল। বাড়ির কর্তা সব শুনে অবাক হয়ে যায়। তারপর বৌমা খুব ঘটা করে মা ষষ্ঠীর পুজো করল। আর সবাইকে বলল যে অগ্রহায়ণ মাসের শুক্লা ষষ্ঠীর দিন যে মাছ মাংস খাবে তার গো-মাংস খাবার পাপ হবে।সেই দিন মা ষষ্ঠীর পুজো করে প্রথমে মুলোর তরকারি মুখে দিতে হবে ,তারপর অন্য কিছু খাওয়া যাবে। সেই থেকে এই ব্রত মুলোষষ্ঠী নামে চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ল।