মহামারীর বছরে ঐতিহ্যের রাস- রাসচক্র ঘুরবে আজ

মহামারীর বছরে ঐতিহ্যের রাস- রাসচক্র ঘুরবে আজ  




কোচবিহার রাসমেলা বাংলার শতাব্দী প্রাচীন মেলাগুলির অন্যতম । এই মেলা উত্তরবঙ্গ এবং উত্তর পূর্ব ভারতের সব থেকে বড় মেলা। এই মেলার জন্য কোচবিহারবাসী অন্তর থেকে গর্ব অনুভব করেন, অপেক্ষা করেন বছরভর। কোচবিহারের প্রধান উৎসব- এই রাসমেলা। তবে করোনা মহামারী অন্যান্য ক্ষেত্রের মতই রাসমেলাতেও প্রভাব ফেলেছে। বিগত বছরের মতন এবছর উৎসব আয়োজন হচ্ছে না। 

আজ সন্ধ্যায় ২০৮ তম রাস উৎসবের শুভ সূচনা করবেন জেলাশাসক পবন কাদিয়ান। শনিবার সরেজমিনে উৎসবের প্রস্তুতি ঘুরে দেখেন জেলাশাসক। তিনি এদিন বলেন- ‘‘ঐতিহ্য মেনে এ বারও আমরা রাস উৎসবের আয়োজন করছি। দর্শনার্থীদের কাছে অনুরোধ, মাস্ক পরেই মন্দির চত্বরে প্রবেশ করুন। ’’

ফাইল ছবি 


জানাযায়, কোচবিহারের দ্বিতীয় মহারাজা ও কামরূপরের দ্বিতীয় বিক্রমাদিত্য নর নারায়ণ (রাজত্বকালঃ ১৫৫৪ - ১৫৮৮ খ্রিস্টাব্দ) অসমের বৈষ্ণবধর্ম গুরু শ্রীমন্ত শঙ্করদেবের নির্দেশের সোনার বংশীধারী তৈরী করে মাঘ মাসের উত্তরায়ণ সংক্রান্তির পূর্ণিমা তিথিতে পন্ডিত অনন্ত কন্দলিকে দিয়ে মূর্তি প্রতিষ্টা সম্পন্ন করেন ।এই বিগ্রহের নাম হয় "বংশীধারী" বা " লক্ষীনারায়ণ " বা " " শ্রী শ্রী মদনমোহন "।শঙ্করপন্থী বৈষ্ণবদের মতে শ্রী কৃষ্ণের সঙ্গে রাধা পূজিতা হননা , এখানে একক ত্রিভঙ্গমুরারী নিত্যপূজিত হন । কালের প্রভাবে কোচবিহারবাসীরা সবনাম ভুলে গিয়ে মদনমোহনের নামেই অর্ঘ দিয়ে থাকেন।

ফাইল ছবি 



পরবর্তীতে কোচবিহারের মহারাজ হরেন্দ্রনারায়ণ ভূপ রাজধানী বেহারে (কোচবিহার ) ভৌতিক উপদ্রপ ঘটায় কোচবিহার রাজ্যেরই ভেটাগুড়িতে ১৮১২ খ্রিস্টাব্দে অগ্রহায়ণ মাসের রাসপূর্ণিমার দিন সন্ধ্যাবেলায় মানসাই নদী পেরিয়ে নতুন রাজধানী ও রাজপ্রাসাদে প্রবেশ করেন এবং সেখানেই গৃহদেবতা মদনমোহনের রাসমেলার সূচনা করেন। এরপর যখনই কোচ রাজাদের রাজধানী পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে মদনমোহন ঠাকুরের স্থান পরিবর্তন ঘটে, বর্তমান নতুন রাজপ্রাসাদের নির্মাণ কাজ শেষ হয় ১৮৮৭ খ্রিস্টাব্দে তার পূর্বে এর উত্তরদিকে পুরোনো রাজপ্রাসাদ ছিলো ,মনে করা হয় সেই রাজপ্রাসাদ সংলগ্ন মন্দিরে রাসমেলা হতো । 

ফাইল ছবি 


এরপর মহারাজা হরেন্দ্র নারায়ণের প্রোপৌত্র মহারাজা নৃপেন্দ্র নারায়ণ এর রাজত্বকালে ১৮৯০ সালে কোচবিহারের বৈরাগীদিঘির পাড়ে মদনমোহন মন্দিরের তৈরির কাজ সম্পন্ন হয় ,এবং রাজপ্রাসাদের মদনমোহন বিগ্রহসহ অন্যান্য দেবদেবীর বিগ্রহ মন্দিরে প্রতিষ্টা করা হয়। সেই সময় থেকেই মন্দির সংলগ্ন এলাকায় রাস মেলা বসছে। 


ফাইল ছবি 
রাসপূর্ণিমায় বিধি মেনে বিশেষ পুজো করে সূচনা হয় রাস উৎসবের। ১৯১২ খ্রিস্টাব্দে কোচবিহারে কলেরা মহামারী আকার ধারণ করলে এবং বৈরাগী দীঘির জল দূষণমুক্ত রাখতে রাজআদেশে মেলাকে প্যারেড গ্রাউন্ডের মাঠে স্থানান্তর করা হয় । বর্তমানে শ্রী শ্রী মদনমোহন বাড়ি থেকে রাসমেলা মাঠ ( প্যারেড গ্রাউন্ড ) ও জেনকিন্স স্কুল সংলগ্ন রাস্তা পর্যন্ত মেলা বসে । রাজামলে রাসমেলায় যত্রতত্র বসে যেতো জুয়ার আড্ডা । প্রলোভনে ফাঁদে পরে সর্বশান্ত হয়ে বাড়ি ফিরতেন গ্রামীন মানুষ । খবর পেয়ে নড়েচড়ে বসেন কোচবিহারের তৎকালীন মহারাজা জিতেন্দ্র নারায়ণ ভূপবাহাদুর , তাঁর নির্দেশেই ১৯২২ খ্রিস্টাব্দে মেলায় জুয়া বন্ধ হয়ে যায় । 

ফাইল ছবি 


১৯২৮ খ্রিস্টাব্দে রাসমেলায় প্রথম বৈদ্যুতিক আলোর ব্যবস্থা করা হয়। রাজআমলে মহারাজা সর্বপ্রথম রাস উৎসবের সূচনা করতেন ,১৯৬৯ সাল পর্যন্ত শেষ স্বাধীন মহারাজা জগদ্দীপেন্দ্র নারায়ণ রাসচক্র ঘুরিয়ে উৎসবের সূচনা করে শ্রী শ্রী মদনমোহন সহ মন্দিরে পূজিত সব বিগ্রহকে প্রনাম জানাতেন ; প্রত্যেক দেবতাকে প্রনামি হিসেবে দিতেন ১৪ টাকা করে এটাই ছিলো প্রথা , রাজা পুজোতে বসতেন না যজ্ঞও করতেন না । 


১৯৬৬ সালে মহারাজা জগদ্দীপেন্দ্র নারায়ণ জয়পুরে পোলো খেলতে গিয়ে ঘোড়া থেকে পরে বুকে আঘাত পান সেবছর উনার পরিবর্তে উনার বিদেশী স্ত্রী মহারানী জর্জিনা নারায়ণ রাসচক্র ঘুরিয়ে শ্রী শ্রী মদনমোহন ঠাকুরের রাসযাত্রার উদ্বোধন করেন , এই ঘটনায় কোচবিহার রাজপরিবারের প্রাচীনপন্থীদের মধ্যে কিছু বিরোধিতা হলেও তৎকালীন কোচবিহারের জেলাশাসক নীতিশ সেনগুপ্তের মধ্যস্থতায় সমস্যা মিটে যায়। 

ফাইল ছবি 


শেষ স্বাধীন মহারাজা জগদ্দীপেন্দ্র নারায়ণ ও মহারানী জর্জিনা দেবী নিঃসন্তান থাকায এবং সরকারি ভাবে রাজতন্ত্র না থাকায় ১৯৭০ খ্রিস্টাব্দের ১১ই এপ্রিল মহারাজা জগদ্দীপেন্দ্র নারায়ণ ভূপবাহাদুরের মৃত্যুর পর ভাইপো পরবর্তী সিংহাসনহীন ও মুকুটহীন মহারাজা বিরাজেন্দ্র নারায়ণ দেবত্র ট্রাস্টের সভাপতি হিসেবে রাস উৎসবের সূচনা করতেন। 


১৯৯২ সালে মহারাজা বিরাজেন্দ্র নারায়ণের মৃত্যুর পর দেবত্র ট্রাস্টের পরবর্তী সভাপতি হিসেবে সরকারি কর্তাভজা আমলারা জেলাশাসকে দিয়ে রাসের উদ্বোধন , পুজো ও যজ্ঞ করিয়ে আসছেন। 


কোচবিহারের রাসউৎসবের মূল আকর্ষন রাসচক্র। কোচবিহারের বাসিন্দা আলতাফ মিঞা বংশপরম্পরায় এই রাসচক্র তৈরী করেন । লক্ষীপূর্ণিমার দিন থেকে আলতাফ মিঞা ও তাঁর পরিবারের সদস্যরা একমাস ধরে নিরামিষ খেয়ে কাগজকেটে নানারকম সুক্ষনকশা করে এবং তারসাথে থাকে দেবদেবীর রঙ্গিন ছবি দিয়ে রাসচক্র বানানো শুরু করেন এবং কোচবিহারবাসীরা রাসচক্র ঘুরিয়ে পুন্য অনুভব করেন।


সূত্রঃ মেঘের ভেলা, ২০১৭, রাসমেলা সংখ্যা-আবির ঘোষ

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ