স্তন ক্যান্সারের ঝুঁকি কমানোর জন্য অভূতপূর্ব অস্ত্রোপচার অ্যাপোলো হসপিটালস কলকাতায়


স্তন ক্যান্সারের ঝুঁকি কমানোর জন্য অভূতপূর্ব অস্ত্রোপচার অ্যাপোলো হসপিটালস কলকাতায়



কলকাতা, নভেম্বর ৫: 


এই শহরে বেভারলি হিলসসুলভ একটা ঘটনা ঘটল সম্প্রতি। দুর্গাপুজোর মরসুমে একজন ৩৭ বছর বয়সী গৃহবধূ একটা ভয়ানক অসুখকে হারিয়ে দেওয়ার জন্য তাঁর সমস্ত মানসিক শক্তি একত্র করে, স্তন ও ডিম্বাশয়ের ক্যান্সারের ঝুঁকি কমিয়ে ফেলার জন্য অস্ত্রোপচার করালেন। পূর্ব ভারতের এই অস্ত্রোপচার এই প্রথম করা হল, আর সেটা ঘটল অ্যাপোলো গ্লেনইগলস হসপিটালস, কলকাতায়।


ঠিক সাত বছর আগে, ২০১৩ র অক্টোবরে, হলিউড অভিনেত্রী অ্যাঞ্জেলিনা জোলি ঠিক এই অস্ত্রোপচারই করিয়েছিলেন ক্যালিফোর্নিয়ার বেভারলি হিলসে। কারণ পরীক্ষা করে দেখা গিয়েছিল তাঁর স্তন ক্যান্সার হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। মেদিনীপুর জেলার কুইকোটায় প্রায় ১৩,০০০ কিলোমিটার দূরে বসে থাকা মৌসুমী রায়ের উপর জোলির সিদ্ধান্ত গভীর ছাপ ফেলে। জোলির মত মৌসুমীও তাঁর মাকে স্তন ক্যান্সারের কারণেই হারিয়েছিলেন, তা-ও মাত্র দশ বছর বয়সে। পরে তাঁর মাসিও একই অসুখে মারা যান। ঘটনাচক্রে তাঁর বাবাও ক্যান্সারে মারা গেছেন।


তাই এপ্রিল মাসে যখন তাঁর বি আর সি এ পরীক্ষার ফল পজিটিভ হল, অর্থাৎ তাঁর স্তন ও ডিম্বাশয়ের ক্যান্সার হওয়ার ঝুঁকি বেশ বেশি বলে জানা গেল, তখন তিনি একেবারে অপ্রস্তুত হয়ে পড়েননি। সঙ্গে সঙ্গেই বাঁদিকের “নিপল স্পেয়ারিং ম্যাস্টেকটমি” (স্তন বৃন্ত অবিকৃত রেখে স্তনের টিস্যু বাদ দেওয়া) এবং ইমপ্ল্যান্ট ও পিঠের পেশি ব্যবহার করে স্তনের তাৎক্ষণিক পুনর্গঠন করতে রাজি হয়ে যান। একইসঙ্গে “ল্যাপারোস্কোপিক বাইল্যাটারাল স্যালফিঙ্গো-উফেরেকটমি” করে তাঁর ডিম্বাশয় আর ফ্যালোপিয়ান টিউব বাদ দিয়ে দেওয়া হয়।


এর আগে জানুয়ারি ২০২০ তে তাঁর ডান স্তনে ক্যান্সার ধরা পড়েছিল। তখন অ্যাপোলো গ্লেনইগলস হসপিটালস, কলকাতার কনসালট্যান্ট অঙ্কো-সার্জেন ডাঃ শুভদীপ চক্রবর্তীর অধীনে ব্রেস্ট কনজার্ভেশন সার্জারি (যেখানে শুধু ক্যান্সারাস টিউমারটাকে কেটে বাদ দেওয়া হয়, কিন্তু বাকি স্তনের টিস্যু এবং বাইরের চেহারা বজায় থাকে) করা হয়। তখনই বি আর সি এ পরীক্ষা করা হয়েছিল, যার ফল পেতে কোভিডের কারণে দেরী হয় এবং শেষ পর্যন্ত পজিটিভ আসে।

Dr. Suvadip Chakrabarti, surgical oncologist, Apollo Gleneagles Hospitals, Kolkata, with the patient Mousumi Roy and her husband Soumya Roy




ইংরেজিতে এম এ এবং এক সাত বছরের মেয়ের মা মৌসুমী বললেন “আমার ক্যান্সার একটা মারণরোগ। আমি এটাকে সেভাবেই দেখেছি। আমার একমাত্র লক্ষ্য ছিল নিজেকে এই রোগের হাত থেকে পুরোপুরি মুক্ত করা। আমার স্বামীই আমার জোর হয়ে দাঁড়িয়েছেন। আমি অ্যাঞ্জেলিনা জোলির অপারেশনের কথা জানতাম, কিন্তু ভারতে এই অপারেশন হয় কিনা জানতাম না। ডাঃ চক্রবর্তী যখন বললেন উনি অ্যাপোলো কলকাতাতেই অপারেশনটা করতে পারেন, আমরা একটা আনন্দের সারপ্রাইজ পেয়েছিলাম।”


মৌসুমী জানালেন বাড়িতে কাজের লোক থাকলেও তিনি কিছু কিছু কাজ নিজে হাতে করতেই পছন্দ করেন। সেপ্টেম্বর ২০২০ তে অস্ত্রোপচারের এক মাস পরে বাড়ি ফেরার পর থেকে তা-ই করছেন।



তাঁর শল্যচিকিৎসক ডাঃ শুভদীপ চক্রবর্তী, অ্যাপোলো কলকাতার কনসালট্যান্ট সার্জিকাল অঙ্কোলজিস্ট, ডান স্তনে অস্ত্রোপচার করেছিলেন জানুয়ারি ২০২০ তে। তারপর কনসালট্যান্ট মেডিকাল অঙ্কোলজিস্ট ডাঃ ইন্দ্রনীল ঘোষের তত্ত্বাবধানে মৌসুমীর অ্যাডজুভ্যান্ট কেমোথেরাপি হয়, আর রেডিয়েশন অঙ্কোলজিস্ট ডাঃ তনবীর শাহিদের তত্ত্বাবধানে অ্যাডজুভ্যান্ট রেডিয়েশন দেওয়া হয় অ্যাপোলো কলকাতাতেই। গত মাসে আবার ডাঃ চক্রবর্তীর নেতৃত্বেই একটা দল বাম স্তনের উপর অস্ত্রোপচার করে এবং ডিম্বাশয়গুলো কেটে বাদ দেয়। ঐ দলে ছিলেন ডাঃ রমণা ব্যানার্জি (কনসালট্যান্ট গায়নোকোলজিস্ট), ডাঃ সপ্তর্ষি ভট্টাচার্য (কনসালট্যান্ট প্লাস্টিক সার্জন) এবং সার্জিকাল অঙ্কোলজির ডাঃ তাপস কর


ডাঃ শুভদীপ চক্রবর্তী বললেন “শ্রীমতি রায়ের বি আর সি এ রিপোর্টে দেখা যাচ্ছিল তাঁর স্তন ক্যান্সার হওয়ার সম্ভাবনা ৯০ শতাংশের বেশি। কিন্তু অস্ত্রোপচারের পর সেটা এখন পাঁচ শতাংশের কমে নেমে এসেছে। তাঁর বয়সের একজন ভারতীয় মহিলার ক্যান্সার হওয়ার গড় সম্ভাবনা এর চেয়ে বেশি।”



সাংবাদিক সম্মেলনে উপস্থিত বিশিষ্ট ব্যক্তিদের মধ্যে ছিলেন ক্যান্সারের বিখ্যাত শল্যচিকিৎসক এবং অ্যাপোলো গ্লেনইগলস ক্যান্সার হসপিটালের সার্জিকাল অঙ্কোলজি বিভাগের ডিরেক্টর ডাঃ সৈকত গুপ্ত। মাল্টিস্পেশ্যালিটি হাসপাতাল হওয়ার কারণে রোগীকে যে বিভিন্ন দিক থেকে চিকিৎসা করার সুযোগ পাওয়া গেছে, তিনি সেই ব্যাপারটা বিশেষ করে উল্লেখ করেন। “এইরকম বিশেষ ধরনের জটিল কেসের ক্ষেত্রে চিকিৎসা প্রণালী ঠিক করা হয় একটা টিউমার বোর্ডে। সেই বোর্ডে থাকেন মেডিকাল, সার্জিকাল আর রেডিয়েশন অঙ্কোলজিস্টরা। কোন কোন কেসে দরকার পড়লে অন্য বিশেষজ্ঞদেরও আমন্ত্রণ জানানো হয়।”



এই কেসের চিকিৎসার অগ্রগতি ন্যাশনাল ক্যান্সার গ্রিডও সমর্থন করেছিল।


ডাঃ ইন্দ্রনীল ঘোষ, কনসালট্যান্ট মেডিকাল অঙ্কোলজিস্ট, অ্যাপোলো গ্লেনইগলস ক্যান্সার হসপিটাল, বলেন “বেশিরভাগ মহিলা, বিশেষ করে অল্পবয়স্ক মহিলারা, ঝুঁকি কমানোর জন্য অস্ত্রোপচার করাতে চান না। মৌসুমী দেবী তাঁদের জন্য উদাহরণ হয়ে থাকবেন।”


রাণা দাশগুপ্ত, সিইও, ইস্টার্ন রিজিয়ন, অ্যাপোলো হসপিটালস গ্রুপ, মৌসুমীর ভূয়সী প্রশংসা করেন। “পূর্ব ভারতে আমরা সর্বাধুনিক অস্ত্রোপচার এবং মেডিকাল প্রোসিডিওরগুলো করার জন্য তৈরি। আমাদের উপর বিশ্বাস রাখার জন্য শ্রীমতি রায়কে ধন্যবাদ জানাই। অনেককিছুই অ্যাপোলো গ্লেনইগলস ক্যান্সার হাসপাতালে প্রথম হয়েছে। সেই মুকুটে আরো একটা পালক যোগ করতে পেরে আমরা আনন্দিত।”


তাঁর কথার রেশ টেনে ডাঃ শ্যামাশিস বন্দ্যোপাধ্যায়ও রোগীর প্রশংসা করেন। পাশাপাশি তিনি ক্যান্সারের চিকিৎসায় শুরুতেই রোগনির্ণয় এবং চিকিৎসা চালু করার উপর জোর দেন। তিনি বলেন “আশা করব যে মহিলাদের স্তন ক্যান্সার বা ডিম্বাশয়ের ক্যান্সারে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা আছে তাঁরা শ্রীমতি রায়কে দেখে অনুপ্রেরণা পাবেন এবং ক্যান্সার জয় করার কী কী পথ আছে তা নিয়ে চিকিৎসকের সাথে কথা বলবেন। অসুখটা লুকিয়ে রেখে ওটাকে শক্তি বাড়াতে সাহায্য করবেন না।”

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ