সম্প্রীতির অনন্য নজির দিনহাটার বুড়ি মা - মায়ের স্বপ্নাদেশে আজও  মূর্তি গড়েন নরেন মালাকারের বংশধরেরা 

লেখকঃ বিশিষ্ট ছড়াকার, সাংবাদিক  শুভাশিস দাশ 





এখনও সাম্প্রদায়িকতার বিষ নষ্ট করেনি এই পুজো । এখনও হিন্দু-মুসলমান সম্প্রদায়ের মানুষ বুড়ি মার নাম নিয়ে দিন শুরু করেন এই অঞ্চলে । দুই সম্প্রদায়ের মানুষজন বলেন যতই ঝড় আসুক আমাদের একতা কে নষ্ট করতে পারবেনা কেউ । আর তাই দেখি চারদিকের বিগ বাজেটের পুজোর জৌলুস যতই দিনহাটার মানুষকে নাড়া দিক ,সব কিছু ছাপিয়ে যায় বন দুর্গা র এই সম্প্রীতির পুজো ।আক্ষরিক অর্থেই এটা প্রকৃত সার্বজনীন এবং দৃঢ় এক সম্প্রীতির পুজো । এবার তিথি অনুযায়ী দুর্গা পুজোর মধ্যে পড়েছে এই পুজো ।


হিন্দু মুসলমান দুই সম্প্রদায়ের মানুষ এখানে মিলিত হয়ে এই পুজো করেন । দিনহাটার পুটিমারিতে আশ্বিনের সংক্রান্তি তে বুড়িমাপুজিতা হন এখানে । হিন্দু ধর্মে অনেক অলৌকিক কাহিনী প্রচলিত আছে দেব দেবীকে নিয়ে । 

বুড়ি মা র এই পুজো নিয়ে একটি আলৌকিক কাহিনী প্রচলিত আছে । দিনহাটা র পুঁটিমারি গ্রামের আসমত উল্লাহ বক্সী ,হেমানন্দ রায় বক্সী ও শ্রী নাথ রায় বর্মা ছিলেন কোচবিহার রাজার রাজ কর্মচারী । এঁরা সকলেই কোচবিহার রাজার খাজনা আদায়ের কাজে নিযুক্ত ছিলেন ।একবার অবিভক্ত বাংলার রংপুর পরগনাতে কোচবিহারের রাজার খাজনা আদায়ে গিয়েছিলেন তাঁরা । কাজ শেষে বাড়ি ফিরতে রাত হলে পথে অন্নদা নগরে রাত্রি যাপন করেন । সেই রাতে দেবী বুড়ি মা তাঁদের কে স্বপ্ন দেখান গ্রামে ফিরে তাঁরা যেন মার পুজো করেন । পরদিন তাঁরা গাঁয়ে ফেরেন । এনিয়ে কাউকে কিছু বলেন নি তাঁরা । 

সপ্তাহ খানেক পর আবার মা তাঁদের একজনকে স্বপ্ন দেখান । তারপর গাঁয়ের মানুষদের কথাটা বলে। সবাই তখন পুজো করতে ইচ্ছে প্রকাশ করে । 

স্থানীয় কুমোর পাড়াতে গেলে জানতে পারে এই মূর্তির আদল তাঁদের জানা নেই । সেখান থেকে ফিরে সবাই চিন্তিতকে এই বুড়িমার মূর্তি গড়তে পারবে । আবার রাতে মা স্বপ্ন দেখান । ভেটাগুঁড়ির অদূরে বালাডাংগা গ্রামের এক মালাকার এই মূর্তি গড়তে পারবেন । 

পরদিন সেখানে গেলে নরেন মালাকারের সন্ধান মেলে এবং তাঁকে মূর্তি গড়ার দায়িত্ব দেয়া হয় ।সেই মালাকারের বংশ ধররা এই মূর্তি করে আসছে আজও । 

১৮৮৪ সালে প্রথম এই পুজো শুরু হয়। এবছর ১৩৪ সে পদার্পণ করলো এই পুজো । বন দুর্গা এখানে বুড়ি মা রূপে পুজিতা হন ।

এখানে হিন্দু মুসলমান মিলিত হয়ে এই পুজো করেন । বংশ পরম্পরায় এই পুজো তাঁরা করে আসছেন । উত্তরের অঙ্গনে এই পুজো সম্প্রদায়িক সম্প্রীতির এক অনন্য নজির । এই পুজো দেখতে উত্তরবঙ্গতো বটেই নিম্ন অসমের ভক্তপ্রাণ মানুষ এখানে আসেন । 

পুজোর কর্মকর্তা জানালেন পিতৃ পুরুষের প্রতিষ্ঠিত এই পুজো আমরা ধরে রেখেছি । আমাদের দিন শুরু হয় বুড়ি মাকে প্রণাম করে । এখানে পুজো তে আমরা স্বতস্ফুর্ত ভাবে অংশ নিই । 

এই পুজো কে কেন্দ্র করে এখানে একটি মেলার আয়োজন করেন পুজো উদ্যোক্তারা । হয় যাত্রাপালাও । তবে এবার করোনার কারণে সেসব বন্ধ ।

আশ্বিনের সংক্রান্তিতে এই পূজোতে উপস্থিত হয় হাজার হাজার মানুষ । বুড়ি মা এখনে সিংহের উপর অধিষ্ঠিত । এক হাতে শিশু আর হাতে অভয় মুদ্রা । 

আগে টিনের চালার মন্দির থাকলেও এখন এই মন্দির পাকা হয়েছে ভক্তদের অনুদানে ।  পুজোর কর্মকর্তারা বলেন এই বুড়িমা জাগ্রত তাই এই বিশ্বাস এখানের মানুষজনের মধ্যে গেঁথে আছে ফলে বাইরে চাঁদা তুলতে হয় না ভক্তরা মন্দিরে এসে যাঁর যা সাধ্য মা কে দান করেন । 

তবে যাই হোক এই পুজো কিন্তু সত্যিই এক সম্প্রদায়িক সম্প্রীতির অনন্য নজির যা এখানে এলেই বোঝা যায় । এবারও হবে এই পুজো । তবে করোনা পরিস্থিতির দিকে তাকিয়ে সব রকম বিধি নিষেধ মানা হবে বলেও জানিয়েছেন উদোক্তারা  । ইতিমধ্যেই সাজ সাজ রব উঠেছে এই অঞ্চলে !থাক না দুর্গা পুজো- সেই খুশির রেশ টেনে এই বন দুর্গা সেজে ওঠেন তাঁর আপন মহিমায় ! আর এই পুজোর জন্য অপেক্ষা করে থাকেন এই অঞ্চলের হিন্দু মুসলমান সব সম্প্রদায়ের মানুষ । এই পুজো থেকে আমরা শিক্ষা নিতেই পারি "মানুষের চেয়ে বড় কিছু নাই নহে কিছু মহীয়ান "