ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর এবং আধুনিক প্রজন্ম  


ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর এবং আধুনিক প্রজন্ম



অনিন্দ্য পাল 

কলকাতার দক্ষিণতম রেলস্টেশন। এক ভদ্রমহিলা এবং তাঁর বছর বারো-চোদ্দর ছেলে প্লাটফর্মে অপেক্ষমান। পরিচিত এক ভদ্রলোকের সঙ্গে দেখা। ভদ্রলোক কুশল বিনিময়ের পর জিজ্ঞাসা করলেন, ছেলের স্কুল কি আজ ছুটি? মা সহাস্যে বললেন, হ্যাঁ, আজ ছুটি আছে, তাই একটু বেরোলাম। এবার ভদ্রলোক ছেলেটাকে জিজ্ঞাসা করলেন, 'ছুটি কেন আজ?' ছেলেটা একটু ভেবে বললো, 'কার যেন জন্মদিন বলছিল স্যার। ' এর পরের ঘটনা খুব সংক্ষিপ্ত। ভদ্রলোক বা ভদ্রমহিলা কেউই মনে করতে পারলেন না জন্মদিনটা কার। দিনটি ছিল ২৬ শে সেপ্টেম্বর, বিদ্যাসাগরের জন্মদিন। এই চিত্র কিন্তু সর্বত্রই। একাদশ - দ্বাদশ বা কলেজ ছাত্র-ছাত্রীদের কাছেও ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর কেবল একটা নাম। তাঁর স্মৃতি, তাঁর অবদান বিস্মৃতির গভীরে তলিয়ে গেছে। 


এই সাইবার যুগে, যখন সেলফোন পকেটের একটা অপরিহার্য জিনিস, যখন স্মার্টফোন ছাড়া একটা মুহূর্ত আট থেকে আশি কারো চলছে না, যখন পাশাপাশি থেকেও কেউ কাউকে চিনতে পারি না অথচ ফেসবুক হোয়াটস অ্যাপ এর মত ভারচুয়াল জগত আমাদের সামাজিকতাকে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছে এবং আমরা হারছি, হারছি কারণ আমাদের হারতে ভালো লাগছে তাই, তখন বিদ্যাসাগর কে আমরা প্রায় ভুলতে বসেছি -একথা প্রমাণ করার দরকার পড়ে না। এই সময় আমাদের চারধারে এক অদ্ভুত বাংলা, ইংরেজি, হিন্দির মিশ্রভাষা রেডিও, টেলিভিশন প্রভৃতি বিনোদন মাধ্যমগুলোতে অবাধে রাজত্ব করছে, তখন বিদ্যাসাগর এবং তাঁর অবদান, বিশেষত বাংলা গদ্য সাহিত্য আর শিক্ষা বিস্তারে - এই প্রজন্মের ছেলে মেয়েরা প্রায় ভুলতেই বসেছে। বর্ণপরিচয়, যা কিনা বাঙালির অক্ষরজ্ঞানলাভের প্রথম আলো তা আজ ব্যাঙের ছাতার মত গজিয়ে ওঠা ইংরেজি বাংলা মেশানো কিন্ডারগার্টেন স্কুলগুলো নিরন্তর নিশ্চিহ্ন করার চেষ্টা করে যাচ্ছে। 

বাঙালির এক অদ্ভুত অহমিকা এখন বাংলা না বলতে পারা। অথচ আজ থেকে দুশো বছর আগে, ১৮২০ খ্রীষ্টাব্দের ২৬ সে সেপ্টেম্বর ( ১২২৭ বঙ্গাব্দের ১২ ই আশ্বিন) জন্মানো এই দরিদ্র বিদ্বান চেষ্টা করেছিলেন বাংলা ভাষাকে লেখা ও পড়া উভয় ক্ষেত্রেই কিভাবে সহজসাধ্য করে তোলা যায়, চেষ্টা করেছিলেন কি ভাবে সংস্কৃতের জটিল ও কঠিন ব্যাকরণ -এর পরিবর্তে সহজ ব্যাকরণ শিখিয়ে বাংলাগদ্য তথা বাংলা সাহিত্যকে সাধারণের উপযোগী করে তোলা যায়।

ঈশ্বরচন্দ্রের আগে স্পষ্টতই বাংলা গদ্য সাহিত্য হাঁটি হাঁটি পা পা অবস্থায় ছিল। তখন পড়াশুনার জন্য বা সাহিত্য হিসেবে পাঠ্যবই বা অন্য ধরনের বই প্রায় পাওয়াই যেত না। বিদ্যাসাগরের আগে, একজন ব্রিটিশ যাজক উইলিয়াম কেরি মূলত খ্রীষ্টধর্ম প্রচার করার জন্য বাংলা গদ্য ছাপানো শুরু করেন। এছাড়াও শ্রীরামপুরের আরো কিছু মিশনারি এই কাজে ব্রতী হয়েছিলেন। কেরি আটজন পণ্ডিতদের সাহায্যে পনেরো বছরের মধ্যে ১৩টি বাংলা গদ্যের বই লেখেন এবং প্রকাশ করেন। কেরির কিছু পরে তাঁর চেয়ে এগারো বছরের ছোটো রাজা রামমোহন রায় প্রকৃত বাংলা গদ্যের ভিত্তি স্থাপন করেন। তিনি সংস্কৃত গ্রন্থের বাংলা অনুবাদ, ধর্ম সম্পর্কে বিতর্কমূলক রচনা প্রকাশ করেন। 

সেই সময় আবার অক্ষয়কুমার দত্তের 'তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা' বাংলা গদ্য সাহিত্যের বিকাশে সাহায্য করেছিল। কিন্তু রামমোহন বা সমসাময়িক অন্যান্যদের অবদান স্বীকার করেও বলা যায় বাংলা গদ্য বিদ্যাসাগরের স্পর্শ ছাড়া বড়ো হতে পারতো না। তিনি বাংলা ভাষার অগোছালো ভাব কাটানোর জন্য বাংলার কাঠামো তৈরি করে লিখিতভাবে প্রকাশের উপযুক্ত করে তুলতে চেয়েছিলেন। বস্তুত বাংলা গদ্য সাহিত্যের জনক বলতে গেলে তাঁর নাম নিয়ে কোনো দ্বিমত হবে না। বিদ্যাসাগর প্রথমে একটি ইংরেজি বই অবলম্বনে ' বাংলার ইতিহাস ' (১৮৪৮ খ্রী) রচনা করেন। এরপর 'জীবন চরিত '(১৮৪৯ খ্রী), তারপর শিশুদের পাঠ্য 'বোধোদয় '(১৮৫১খ্রী), 'কথামালা' (১৮৫৬ খ্রী) ও 'আখ্যান মঞ্জরী'(১৮৬৩ খ্রী) রচনা করেন। এই বই গুলো অনেক সহজ বাংলায় লেখা ছিল ফলে সাধারণের উপযোগী যেমন হয়েছিল তেমনি সমাদৃত ও হয়েছিল। তবে তাঁর অনন্য প্রয়াস সংস্কৃত ব্যাকরণের উপক্রমণিকা (১৮৫১খ্রী) এবং চার খন্ডে 'ব্যকরণ কৌমুদী'(১৮৫৩,২৮৫৪,১৮৬২ খ্রী) , এগুলো ছিল সংস্কৃত থেকে আধুনিক সহজসাধ্য বাংলার আঁতুড়ঘর। 

বিদ্যাসাগরের আগের ক্লান্তিকর দীর্ঘাকার সংস্কৃত ঘেঁষা এবং শব্দবহুল গদ্য বিদ্যাসাগরের স্পর্শে হয়ে উঠেছিল সাবলীল আর দুর্বোধ্যতা বর্জিত। তিনি সাধুভাষার মান নির্দিষ্ট করে বাংলা ভাষাকে সৌন্দর্যে, গাম্ভীর্যে এক শক্তিশালী ভাষা হিসেবে আত্মপ্রকাশের উপযোগী করে তুলেছিলেন। তিনি বাংলাভাষাকে যুক্তিসঙ্গত ,সহজসাধ্য করে তোলার জন্য ছেদ- যতিছিহ্ন প্রবর্তন করেন এবং সুষম শব্দ দিয়ে বাক্য গঠনের শৈল্পিক রীতি চালু করলেন। তাঁর বর্ণপরিচয় তো আপামর বাঙালির বাংলা অক্ষরজ্ঞানের প্রথম পাঠ হিসেবে একশো বছরেরো বেশি সময় ধরে প্রাথমিক শিক্ষার অঙ্গ ছিল এবং এখনও আছে। 


একবিংশ শতকে বাংলা এবং বাঙালি অনেক পরিণত এবং শিক্ষিত। বহুমুখী শিক্ষার বিস্তারের সঙ্গে সঙ্গে বিশ্বায়ন এবং শিক্ষার- পণ্যায়ন শিক্ষাকে গভীরতা দানের চেয়ে ঝাঁ চকচকে মোড়কে বন্দী করে ফেলেছে। এমন শিক্ষার প্রথম এবং প্রধান লক্ষ্যই হল অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠা। হয়ত তাই বাংলা ভাষার কলেজ ছাত্রও মূল কবিতা বা গদ্য সম্পর্কে কিছু না জেনেও শুধু মাত্র প্রশ্ন উত্তর এবং প্রাইভেট টিউটরের নোট মুখস্থ করে ক্লাসের পরীক্ষায় উচ্চ নম্বর নিয়ে উৎরে যায়। তবে শুধু ক্লাসের পরীক্ষায় নয়, একই ভাবে চাকরির পরীক্ষাতেও উত্তীর্ণ হয়ে যায়। আর এর ফল হয়েছে মারাত্মক। বাংলা ভাষার ছাত্র অথচ বাংলা কবিতা পড়া বা শোনায় অনাগ্রহ, বাংলা গল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ পড়ার প্রতি অনীহা হয়ত এই আধুনিক শিক্ষারই প্রতিফলন। তবুও এই দোলাচল আর ভাবতে, গভীর চিন্তা করতে ভয় পাওয়া শিক্ষিত আধুনিক সমাজ আজো বিদ্যা সাগরকে অস্বীকার করতে পারবে না।