দ্বিশতবর্ষে ফিরে দেখা ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর




যুগে যুগে বাংলার মাটিতে যে সকল মহাপুরুষের আবির্ভাব ঘটেছে, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর তাদের মধ্যে অন্যতম একজন । যার পান্ডিত্য, চারিত্রিক দৃঢ়তা, কর্মনিষ্ঠা, নির্ভিকতা, মানব সমাজে এক জলন্ত দৃষ্টান্ত । তিনি একাধারে একজনসংস্কৃত পন্ডিত,লেখক, শিক্ষাবিদ, সমাজ সংস্কারক, জনহিতৈষী। সংস্কৃত ভাষা ও সাহিত্যে অগাধ পান্ডিত্যের জন্য প্রথম জীবনেই তিনি বিদ্যাসাগর উপাধি লাভ করেন। তিনিই প্রথম বাংলা লিপি সংস্কার করে তাঁকে যুক্তিবহ ও অপরবোধ্য করে তোলেন। বাংলা গদ্যের প্রথম সার্থক রূপকার তিনিই। তাঁকে বাংলা গদ্যের প্রথম শিল্পী বলে অভিহিতি করেছেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। 




১৮২০ খ্রিঃ ২৬ শে সেপ্টেম্বর হুগলি জেলার বীরসিংহ গ্রামে এই মহামানবের জন্ম হয় এক ব্রাহ্মণ পরিবারে। মাত্র ৫ বছর বয়সের ঈশ্বরের লেখাপড়া শেখনোর ভার দেওয়া হয় কালীকান্ত চট্টোপাধ্যায় নামক এক শিক্ষককে। ১৮২৯ সালের ১লা জুন ঈশ্বর সংস্কৃত কলেজের ব্যাকরণ বিভাগের তৃতীয় শ্রেণীর ছাত্র হিসেবে ভর্তি হলেন। ১৮৪১ সালে ন্যায় শাস্ত্র এবং জ্যোতিষ এই দুই বিভাগের পাঠ সমাপ্ত করে কলেজের ছাত্রজীবন শেষ হয়। 


পরবর্তীকালে বিদ্যাসাগর সংস্কৃত কলেজের সহকারী সেক্রেটারি পদে নিযুক্ত হন। যা সেক্রেটারির সাথে বনতার কারনে ১৮৪৭ সালের ১৬ই জুলাই তিনি ইস্তফা দেন। আবার ১৮৫০ সালের ৫ই ডিসেম্বর থেকে সাহিত্যের লেকচারারের কাজ নিয়ে সংস্কৃত কলেজে ফিরে যেতে হল। ৬ মাস যেতে না যেতেই মাসিক ১৫০ টাকা বেতনে কলেজের প্রিন্সিপালের কাজে নিযুক্ত হন। 


একথা স্বীকার্য যে তখনকার রীতি অনুযায়ী বিদ্যাসাগরকে তাঁর পিতা মাত্র চোদ্দ বছর বয়সে বিবাহ দেন। আরও পড়ুনঃ  ১ অক্টোবর থেকে স্বাভাবিক হচ্ছে অনেক কিছুই- বড়  ঘোষণা মুখ্যমন্ত্রীর


সমাজের একজন প্রতিষ্ঠাবান মানুষ এক রহস্যময় সূত্র ধরে সর্বসম্মতিক্রমে এক একটি বিশেষ আখ্যায় ভূষিত করেন। তিনি ‘দয়ার সাগর’ বলেও সম্মানিত হন। জনগন যেন এই উপাধিটি দিয়ে তাঁর সেই সুনামটিকে নামমুদ্রাঙ্কিত করে দিল। নারীদের ন্যায্য অধিকার প্রতিষ্ঠা ও রক্ষার সংগ্রামে তিনি অটুট ছিলেন। বহুবিবাহের বিরোধিতা করার সময় তাঁর রচিত এক পুস্তিকাতে তিনি জানিয়েছেন – “স্ত্রী জাতি অপেক্ষাকৃত দুর্বল, ও সামাজিক নিয়ম দোষে পুরুষজাতির নিতান্ত অধীন। এই দুর্বলতা ও অধিনতা নিবন্ধন তাহারা পুরুষজাতির নিকট অনবত ও অপদস্থ হইয়া কালহরণ করিতেছেন.....................”। 


বিদ্যাসাগর মহাশয় নারীজাতির শিক্ষা প্রসারের জন্য একটি প্রতিজ্ঞাপত্রে স্বাক্ষর এর মাধ্যমে সর্বাত্মক আন্দোলন গড়ে তোলেন। সেই পত্রে শিক্ষিত ভদ্র সমাজকে অনুকূল অঙ্গীকারবদ্ধ করার জন্য স্বাক্ষর সংগ্রহ করেন। অঙ্গীকারগুলি ছিল- 


১. “কন্যাকে বিদ্যাশিক্ষা করাইব। 
২. একাদশবর্ষ পূর্ণ না হইলে কন্যার বিবাহ দিব না। 
৩. কুলীন, বংশজ, শ্রেত্রিয় অথবা মৌলিক ইত্যাদি গণনা না করিয়া স্বজাতীয় সৎপাত্রে কন্যাদান করিব। 
৪. কন্যা বিধবা হইলে এবং তাঁর সম্মতি থাকিলে পুনরায় তাহার বিবাহ দিব। 
৫. অষ্টাদশ বর্ষ পূর্ণ না হইলে পূত্রের বিবাহ দিব না। 
৬. এক স্ত্রী বিদ্যমান থাকিতে আর বিবাহ করিব না। 
৭. যাহার এক স্ত্রী বিদ্যমান আছে, তাহাকে কন্যাদান করিব না। 
৮. যেরুপ আচরণ করিলে প্রতিজ্ঞা সিদ্ধির ব্যাঘাত ঘটিতে পারে, তা করিব না। 
৯. মাসে মাসে স্ব স্ব মাসিক আয়ের পঞ্চাশতম অংশ নিয়োজিত ধনাধ্যক্ষের নিকট প্রেরণ করিব। 
১০. এই প্রতিজ্ঞাপত্র স্বাক্ষর করিয়া কোন কারণে উপরি নির্দিষ্ট প্রতিজ্ঞা পালনে পরাঙ্মুখ হইব না।” 


১৮৫৬ সালে সরকার বিধবা বিবাহ আইনসিদ্ধ ঘোষণা করেন। তবে শুধু আইন প্রণয়নেই ক্ষান্ত থাকেননি বিদ্যাসাগর মহাশয়। তার উদ্যোগে একাধিক বিধবা বিবাহের অনুষ্ঠান আয়োজিত হয়। তার পুত্রও( নারায়ণচন্দ্র) এক ভাগ্যহীনা বিধবাকে বিবাহ করেন। 

তিনি ব্যক্তিগত উদ্যোগ নিয়ে ১৮৫৮ খ্রিস্টাব্দে মে মাসের মধ্যে নদীয়া, বর্ধমান, হুগলী ও মেদিনীপুর জেলায় ৩৫ টি বালিকা বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন। প্রায় ১৩০০ ছাত্রী এই স্কুলগুলিতে পড়াশোনা করত। পরবর্তীকালে তিনি সরকারের কাছে ধারাবাহিক তদবির করে সরকার এই স্কুলগুলোর কিছু আর্থিক ব্যয়ভার বহন করতে রাজি হয়। ১৮৬৪ খ্রিস্টাব্দে বাংলায় বালিকা বিদ্যালয়ের সংখ্যা দাঁড়ায় ২৮৮ টি। এরপর কলকাতায় ১৮৭২ খ্রিস্টাব্দে মেট্রোপলিটন ইনস্টিটিউশন (বর্তমান বিদ্যাসাগর কলেজ ) এবং নিজের মায়ের স্মৃতির উদ্দেশ্যে নিজ গ্রাম বীরসিংহে ভগবতী বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন। 

১৮৭৫ সালের ৩১ মে নিজের উইল প্রস্তুত করেন বিদ্যাসাগর মহাশয়। পরের বছর ২৬ ফেব্রুয়ারি হিন্দু ফ্যামিলি অ্যানুয়িটি ফান্ডের ট্রাস্টি পদ থেকে ইস্তফা দেন। এপ্রিল মাসে কাশীতে পিতা ঠাকুরদাস বন্দ্যোপাধ্যায়ের মৃত্যু হয়। এই সময় কলকাতার বাদুড়বাগানে বসতবাড়ি নির্মাণ করেন। বর্তমানে এই বাড়ি সংলগ্ন রাস্তাটি বিদ্যাসাগর স্ট্রিট ও সমগ্র বিধানসভা কেন্দ্রটি বিদ্যাসাগর নামে পরিচিত। ১৮৭৭ সালের জানুয়ারি থেকে বাদুড়বাগানে বাস করতে থাকেন বিদ্যাসাগর মহাশয়। এ বছর বাংলার গভর্নর কতৃক সন্মাননা লিপি প্রদান করা হয় তাকে। এপ্রিল মাসে গোপাললাল ঠাকুরের বাড়িতে উচ্চবিত্ত ঘরের ছেলেদের পড়াশোনার জন্য বিদ্যালয় স্থাপন করেন। ছাত্রদের বেতন হয় মাসিক ৫০ টাকা। ১৮৭৯ সালে মেট্রোপলিটান কলেজ (কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়) কর্তৃক দ্বিতীয় থেকে প্রথম শ্রেণীর কলেজে উন্নীত হয়। 

সাহিত্য জগতে বিদ্যাসাগরের বিশেষ অবদান লক্ষ্য করা যায়। তিনি প্রতিটি আন্দোলন তাঁর লেখনীর মাধ্যমেও সমাজের কাছে তুলে ধরেছেন। বিধবা বিবাহ, বাল্য বিবাহ, স্ত্রী শিক্ষা, কুসংস্কার দূরীকরণ এছাড়াও বিভিন্ন বিষয়ের উপর তিনি তাঁর রচনার মাধ্যমে সমাজকে সচেতন করে তুলতেন। বিদ্যাসাগর সর্বপ্রথম বাংলা গদ্যকে শৃঙ্খলাবদ্ধ সাহিত্যে পরিণত করেন। তাঁর প্রথম রচনা ‘ভাগবতের কিয়দংশ এর অনুবাদ’।

বর্ণপরিচয় (১৮৫১) প্রকাশের আগ পর্যন্ত প্রথম শিক্ষার্থীদের জন্যে এরকমের কোনো আদর্শ পাঠ্যপুস্তক ছিল না। তাঁর বর্ণপরিচয়ের মান এত উন্নত ছিল যে, প্রকাশের পর থেকে অর্ধশতাব্দি পর্যন্ত এই গ্রন্থ বঙ্গদেশের সবার জন্যে পাঠ্য ছিল। এর মতোই সাফল্য অর্জন করেছিল বোধোদয়(১৮৫১), কথামালা(১৮৫৬), চরিতাবলী(১৮৫৬) এবং জীবনচরিত(১৮৫৯)। সংস্কৃত ব্যাকরণের উপক্রমণিকা ও বর্ণপরিচয়ের মতো অভিনব। এটিই প্রথম বাংলা ভাষায় সংস্কৃত ব্যাকরণ। চার খন্ডে লেখা ব্যাকরণ কৌমুদীও তাঁর রচনার ঐতিহাসিক অবদান। 


এছাড়াও তাঁর উল্লেখযোগ্য রচনাগুলি হল-
অনুবাদিত গ্রন্থ : হিন্দি থেকে বাংলা 'বেতাল পঞ্চবিংশতি' (১৮৪৭), সংস্কৃৃত থেকে বাংলা 'শকুন্তলা' (১৮৫৪), 'সীতার বনবাস' (১৮৬০), 'মহাভারতের উপক্রমণিকা' (১৮৬০), 'বামনাখ্যানম্' (১৮৭৩); ইংরেজি থেকে বাংলা 'বাঙ্গালার ইতিহাস' (১৮৪৮), 'জীবনচরিত' (১৮৪৯), 'বোধোদয়' (১৮৫১), 'নীতিবোধ' (১৮৫১), 'কথামালা' (১৮৫৬), 'চরিতাবলী' (১৮৫৭), 'ভ্রান্তিবিলাস' (১৮৬১); ইংরেজি গ্রন্থ : 'পোয়েটিক্যাল সিলেকশনস্', 'সিলেকশনস্ ফ্রম গোল্ডস্মিথ'; মৌলিক গ্রন্থ : 'সংস্কৃত ভাষা ও সংস্কৃৃত সাহিত্য বিষয়ক প্রস্তাব' (১৮৫৩), 'বিধবা বিবাহ চলিত হওয়া উচিত কিনা এতবিষয়ক প্রস্তাব' (১৮৫৫), 'বহুবিবাহ রহিত হওয়া উচিত কিনা এতবিষয়ক প্রস্তাব' (১৮৭১), 'অতি অল্প হইল' (১৮৭৩), 'আবার অতি অল্প হইল' (১৮৭৩), 'ব্রজবিলাস' (১৮৮৪), 'রত্নপরীক্ষা' (১৮৮৬)। 

তাঁর বিচিত্র জীবনকথা, বিশ্লেষণাত্মক তিন্তাধারা উনিশ শতকের মানুশকে তরান্বিত করেছিল। মানবতার উন্মেষের যুগের এই মহান সার্থক পথপ্রদর্শক ১৮৯১ সালের ২৯ জুলাই পরলোক গমন করেছিলেন।