নিজেদের মনের চাপ কমাতে বড়রা ছোটদের কাছে মনের কথা বলুন… 

Elder ones can reduce stress through opening heart to younger ones

-Dr. Nita Mitra Chanda


পরিবারে ছোটদের সমস্যা নিয়ে এর আগে কয়েকটি পর্যায়ে আলোচনা করেছি। অভিভাবকদের ভূমিকা নিয়েও কিছু কথা বলেছি ।এই প্রসঙ্গে অভিভাবকদের মনে হতেই পারে , - “আমাদের অসুবিধা, আমাদের সমস্যা, আমাদের কষ্টের কি কোনো স্থান নেই এইসব আলোচনায় ?” 

ঠিক তাই, অবশ্যই আছে। আজ আপনাদের নিয়ে আলোচনা করবো। বরঞ্চ বলা ভালো, আজ আমরা নিজেদের জন্য আলোচনা করবো। সাধারণভাবে মনস্তত্ত্বের ভাষায় নব্যতারুণ্যের পরবর্তী এবং বার্ধক্যের আগের অবস্থাকে মধ্যবয়স্ককাল( Middle Adulthood) বলা হয়। অবশ্য , নব্যতারুণ্যের শেষ ও বার্ধক্যের শুরু বয়স দিয়ে বোঝা খুব মুশকিল। বিভিন্ন মানুষের ক্ষেত্রে বিভিন্ন হতে পারে। নব্যতারুণ্য যখনই নিজের ভালো লাগার জায়গা খুঁজে পেলো তারপর থেকেই মধ্যবয়স শুরু হয়েছে বলা যায়। আবার যতদিন মানুষ নিজের মানসিক ও শারিরীক শক্তি ব্যবহার করে সমাজকে কিছু দেওয়ার জায়গায় থাকে ততদিন বার্ধক্য শুরু হয় নি বলা যায়। এই মধ্যবয়সে বয়স বাড়ার সাথে সাথে হঠাৎ কোনো পরিবর্তন না হলেও ধীর গতিতে পরিবর্তন আসতেই থাকে। অনেকে বলতে পারেন , এই তথ্য সকলেরই জানা আছে। কিন্তু মনস্তত্ত্ববিদেরা এই পরিবর্তনকে বিজ্ঞানসম্মতভাবে বুঝতে চেষ্টা করেন যাতে পরিকল্পনা করার মতো নির্ভরযোগ্য পরিস্থিতি পাওয়া যায়। 

এই বিষয়ে সবচাইতে বেশী আলোচিত মনস্তত্ত্ববিদ হলেন এরিক এরিকসন। তাঁর মতে মধ্য বয়সে মানুষের মধ্যে মুখ্য যে বিরোধ কাজ করে, তা হলো সৃষ্টিশীলতা (generativity) বনাম স্থবিরতা (stagnation)। সৃষ্টিশীল হওয়ার অর্থ নতুন কিছু করতে পারা যা অন্যের বা সমাজের কাজে লাগবে, উদ্ভাবনী শক্তির অধিকারী হওয়া, পরবর্তী প্রজন্মকে তার সাংস্কৃতিক পরিবেশে সুস্থ জীবনের জন্য প্রস্তুত করা ইত্যাদি । নিজেদের তৃপ্তিমতো এই কাজ করতে না পারাকেই এরিকসন বলেছেন স্থবিরতা (stagnation)। সৃষ্টিশীল কাজকে এরিকসন মূলত: তিনটি ভাগে ভাগ করেছেন :- কাজের জগতে তৃপ্তি , বিবাহিত জীবনে তৃপ্তি আর পরবর্তী প্রজন্মকে জীবনের জন্য প্রস্তুত করার তৃপ্তি। এই প্রেক্ষাপটে আমরা যারা মাঝবয়সী তাদের অসুবিধাকে চিনে নেওয়া সহজ হতে পারে। 

ছোটদেরকে কেন্দ্র করে মাঝবয়সীদের আবেগ শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত ছড়িয়ে থাকে। এই প্রসঙ্গে একজন লেখক , Peter De Vries - এর মন্তব্য উল্লেখ না করে পারছি না:- “the value of marriage is not that adults produce children, but that children produce adults”( অর্থাৎ, বৈবাহিক জীবনে বড়রা শিশুদেরকে তৈরী করেন না, বরঞ্চ শিশুরা বড়দেরকে তৈরী করে)। সংসারে নতুন মুখ আসার প্রতীক্ষাজনিত মানসিক চাপ, নতুন মুখ এলে তাকে বড় করার মানসিক চাপ, তাকে স্কুলে পাঠানোর মানসিক চাপ, স্কুলে ভালো রেজাল্ট করার চাপ – এইরকমের হাজারো চাপ মা-বাবাকে ক্রমাগত নতুন করে গড়ে তোলে । তারও পরে আসে সমাজে - কর্মজগতে সন্তানকে প্রতিষ্ঠিত দেখতে চাওয়ার আকাঙ্খা, কর্মজগতে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর বিবাহিত জীবনে সুখী দেখতে চাওয়ার আকাঙ্খা, এমনকি সন্তানের বিবাহিত জীবনে পরবর্তী প্রজন্মকে দেখতে পাওয়ার সাধ। ছোটদেরকে সার্থকভাবে বড় করে তোলার মধ্য দিয়ে বড়রা ধীরে ধীরে পরিণত হয়ে ওঠে। 

তবে, বড় হয়ে ওঠার সময় ছোটদের চাহিদা আর অভিভাবকদের আকাঙ্খার সংঘাত অনেকসময়েই বেদনাদায়ক হয়ে ওঠে। এই সংঘাতকে মূল দুটো ভাগে ভাগ করা যেতে পারে। 

প্রথম ভাগ, আমরা যখন মাঝবয়সের প্রথম দিকে আর ছোটরা বড়জোর নব্যতারুণ্যস্তর অতিক্রম করেছে বা করছে। দ্বিতীয় ভাগ , আমরা যখন মাঝবয়সের শেষের দিকে আর আমাদের সন্তানেরা মাঝবয়সের প্রথম দিকে। আজকের ছোট পরিসরে প্রথমভাগ নিয়েই আলোচনা করা যাক। 

বড়দের সাথে ছোটদের সংঘাত সরাসরি নজরে আসে বয়ঃসন্ধিকালের সময় থেকে। এই সময়ে ছোটরা তাদের ভালো লাগা আর খারাপ লাগার মধ্য দিয়ে নিজেদের পরিচয় খুঁজে পেতে চায়, আর ঠিক তখনই অভিভাবকদের ভালো বা খারাপ লাগা তাকে নিজের মতো করে গড়ে তুলতে চায়। একইরকম ঘটনা ঘটে নব্যতারুণ্যের সময়। ছোটরা খুঁজে ফেরে কাজের জগতে নিজের পরিচয়। এখানেও অভিভাবকদের মতামত প্রতিনিয়ত ছোটদেরকে ক্লান্ত করে। আসলে ছোটদের থাকে অচেনাকে চেনার আনন্দ, আর অভিভাবকদের থাকে অভিজ্ঞতার সম্ভার। এই কথাটা আমরা সাধারনভাবে জানলেও এবং মনস্তত্ত্ববিদেরা গবেষণার মাধ্যমে নিশ্চিত করলেও আমরা মনে করি ছোটরা অভিজ্ঞতার অভাবে ভুল করতে পারে তাই তাদেরকে জোর করা উচিত সঠিক পথে চলার জন্য। ছোটরা মনের গভীরে গুমরে মরে ; আমরা বড়রা ছোটদের প্রতিবাদী মনোভাবে আহত হই। 

মজার ব্যাপার , প্রকৃতি কিন্তু ছোটদের নতুন নতুন ভাবনারই পক্ষে। ছোটদের অভিনব চিন্তার সাথে বড়দের অভিজ্ঞতা যোগ হলে অভাবনীয় সাফল্য আসার সম্ভাবনা বেড়ে যায়। উল্টোদিকে বড়দের অভিজ্ঞতার চাপে ছোটদের অভিনব চিন্তার স্বাধীনতা কমে গেলে অনেকসময়েই বিরূপ প্রতিক্রিয়া আসতে পারে। 

আরও মজার ব্যাপার ছোটদেরকে নিয়ে বড়দের মানসিক চাপ কমানোর সবচাইতে ভালো উপায় ছোটদের সাথে কথা বলা। এর আগের পর্যায়গুলোতে বলেছি ওদের কথা শুনুন। এখানে বলছি ওদের কাছে নিজের কথা বলুন। না, কোনো চাপানো পরামর্শ নয় , নিজের জীবনের অভিজ্ঞতা গল্পের মতো করে বলুন, সাফল্যের- বিফলতার- আনন্দের- বেদনার গল্পকথা । ওরা শুনতে চায় বড়দের ছোটবেলার কথা। অবাক বিস্ময়ে ওদের কল্পনা আপনার জগতে একান্ত সহমর্মী হয়ে ঘুরে বেড়ায়। অবাক হবেন ,ওরাই হয়তো ভালোবেসে কোনো বেদনার স্মৃতিতে চন্দনের প্রলেপ দেবে, কোনো আনন্দের স্মৃতিতে হেসে কুটি কুটি হবে। ওরা আপনার অভিজ্ঞতার জগতে রসদ খুঁজে নেবে নিজেদের মত করে, তাই দিয়ে সমৃদ্ধ করবে নিজেদের অভিনব সাহসী ভাবনাকে। ওরা পুরনো প্রজন্মের নকল হবে না, হয়ে উঠবে পুরানোর ভিত্তিতে নতুন প্রজন্ম। আর আপনারা? যে কোনো মনস্তত্ত্ববিদকে জিজ্ঞেস করুন, আপনার সবচাইতে প্রিয় মানুষের কাছে উজার করে বলতে পারলে কি আর মনের কষ্ট কোথাও লুকিয়ে থাকার সুযোগ পাবে ? 

তাই বলি , আগে বলেছি ওদের কথা শুনুন, আজ বলছি ওদের কাছে আপনার মনের কথা বলুন । 

Writer
Dr. Nita Mitra Chanda, Honorary Coordinator of Find_Mind, Siliguri 
(Psychological Research and Counseling Unit), 
and Associate Professor, Siliguri B.Ed.College ,