নতুন শ্রম আইন নিয়ে শ্রম বাজারে এক ঐতিহাসিক পরিবর্তনের সূচনা কেন্দ্রের
নতুন শ্রম আইন নিয়ে সরকারের দ্রুত অগ্রগতি দেশের শ্রম বাজারে এক ঐতিহাসিক পরিবর্তনের সূচনা করেছে। দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা পুরনো আইনগুলিকে একীভূত করে চারটি শ্রম কোডে রূপান্তরিত করা হয়েছে, যা শ্রমিকদের সামাজিক নিরাপত্তা, মজুরি সুরক্ষা, কর্মক্ষেত্রের স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তা এবং শিল্প সম্পর্কের ক্ষেত্রে এক নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেছে। এই সংস্কারের সবচেয়ে বড় দিক হলো নারী শ্রমিকদের জন্য সমান সুযোগ নিশ্চিত করা। এখন থেকে মহিলারা ভূগর্ভস্থ খনি থেকে শুরু করে ভারী শিল্প পর্যন্ত সব ক্ষেত্রেই কাজ করতে পারবেন, তবে এর জন্য তাদের সম্মতি আবশ্যক। প্রতিটি কর্মক্ষেত্রে নিরাপত্তা কমিটি গঠন করা হবে, যেখানে মহিলাদের প্রতিনিধিত্ব বাধ্যতামূলক থাকবে। অভিযোগ প্রতিকার কমিটিতেও নারীদের অন্তর্ভুক্তি নিশ্চিত করা হয়েছে। পরিবার সংজ্ঞায় শ্বশুরবাড়ির সদস্যদের অন্তর্ভুক্ত করা এবং নির্ভরশীলদের কভারেজ বৃদ্ধি করা নারীদের জন্য এক গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হিসেবে দেখা হচ্ছে।
সামাজিক নিরাপত্তার ক্ষেত্রে বড় পরিবর্তন এসেছে। কর্মীরা এখন থেকে ESIC-এর আওতায় আসবেন এবং দেশব্যাপী স্বাস্থ্য সুবিধা পাবেন। বিপজ্জনক শিল্পে একজন কর্মী থাকলেও প্রতিষ্ঠানকে ESIC কভারেজ নিতে হবে। আধার-সংযুক্ত ইউনিভার্সাল অ্যাকাউন্ট নম্বরের মাধ্যমে সুবিধাগুলি সহজে পাওয়া যাবে এবং অভিবাসনজনিত কোনও বাধা ছাড়াই সব রাজ্যে তা কার্যকর হবে। চুক্তিভিত্তিক কর্মীদের জন্যও সুযোগ বৃদ্ধি করা হয়েছে। একটানা এক বছর কাজ করার পর তারা গ্র্যাচুইটির অধিকারী হবেন। স্বাস্থ্য সুবিধা ও সামাজিক সুরক্ষা তাদের জন্যও নিশ্চিত করা হয়েছে। খনি শ্রমিক ও বিপজ্জনক শিল্পের কর্মীদের জন্য বিনামূল্যে বার্ষিক স্বাস্থ্য পরীক্ষার ব্যবস্থা করা হয়েছে, বিশেষ করে ৪০ বছরের বেশি বয়সী শ্রমিকদের জন্য এটি বাধ্যতামূলক করা হয়েছে।
গিগ এবং প্ল্যাটফর্ম কর্মীদের জন্যও নতুন আইন বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছে। সুইগি, উবার, জোমাটো বা আরবান কোম্পানির মতো অ্যাগ্রিগেটরদের তাদের বার্ষিক টার্নওভারের ১-২ শতাংশ সামাজিক নিরাপত্তা তহবিলে জমা দিতে হবে, যা সর্বোচ্চ ৫ শতাংশ পর্যন্ত হতে পারে। প্রথমবারের মতো গিগ কর্মীদের আইনি স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। বাধ্যতামূলক নিয়োগপত্রে কর্মীর পদবী, বেতন এবং সামাজিক নিরাপত্তার অধিকার স্পষ্টভাবে উল্লেখ করতে হবে। একাধিক ওভারল্যাপিং ফাইলিংয়ের পরিবর্তে একক-উইন্ডো নিবন্ধন, লাইসেন্সিং এবং রিটার্নের ব্যবস্থা করা হয়েছে। জাতীয় পেশাগত সুরক্ষা ও স্বাস্থ্য বোর্ড অভিন্ন মানদণ্ড নির্ধারণ করবে। ৫০০ জনের বেশি কর্মী থাকলে কর্মক্ষেত্রে নিরাপত্তা কমিটি গঠন বাধ্যতামূলক হবে।
নতুন শ্রম কোডে শাস্তিমূলক পদক্ষেপের চেয়ে সচেতনতা, নির্দেশনা এবং সম্মতির উপর জোর দেওয়া হয়েছে। বিরোধ দ্রুত সমাধানের জন্য দুই সদস্যের শিল্প ট্রাইব্যুনাল গঠন করা হবে। সমঝোতার পর সরাসরি ট্রাইব্যুনালে যাওয়ার সুযোগ থাকবে। বিপজ্জনক শিল্পে একজন কর্মী থাকলেও EPFO-এর আওতায় আসবেন। এর ফলে ব্যবসার জন্য সম্মতির বোঝা কমবে এবং সামাজিক নিরাপত্তা বৃদ্ধি পাবে। আইটি ও আইটিইএস কর্মীদের জন্য ৭ তারিখের মধ্যে বেতন পরিশোধ বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। সমান কাজের জন্য সমান বেতন নিশ্চিত করা হয়েছে। স্থায়ী কর্মচারীরা এক বছর পর থেকেই গ্র্যাচুইটির অধিকারী হবেন, যা আগে পাঁচ বছর ছিল। কর্মঘণ্টা ৮ থেকে বাড়িয়ে ১২ করা হয়েছে, তবে অতিরিক্ত সময়ের জন্য দ্বিগুণ বেতন এবং লিখিত সম্মতি প্রয়োজন হবে।
ডিজিটাল, অডিও-ভিজ্যুয়াল কর্মী যেমন সাংবাদিক, ডাবিং শিল্পী এবং স্টান্ট কর্মীরাও এই সুবিধার আওতায় আসবেন। চুক্তিবদ্ধ কর্মীদের জন্য সামাজিক নিরাপত্তা এবং আধার-সংযুক্ত পোর্টেবিলিটি নিশ্চিত করা হয়েছে। তবে নতুন আইন নিয়োগকর্তাদের জন্যও নমনীয়তা এনেছে। ছাঁটাইয়ের অনুমতি দেওয়া হয়েছে এবং কোনও কোম্পানি বন্ধ করার জন্য সরকারি অনুমোদনের সীমা ১০০ থেকে বাড়িয়ে ৩০০ কর্মীতে উন্নীত করা হয়েছে। কারখানার কর্মঘণ্টা ৯ থেকে ১২ ঘন্টা করা হয়েছে, দোকান ও অন্যান্য প্রতিষ্ঠানে শ্রমিকরা দিনে ১০ ঘন্টা কাজ করতে পারবেন।
এই সংস্কার নিয়ে শ্রমিক সংগঠনগুলির মধ্যে তীব্র সমালোচনা দেখা দিয়েছে। দশটি শ্রমিক সংগঠনের যৌথ ফেডারেশন আইনগুলিকে শ্রমবিরোধী ও অগণতান্ত্রিক বলে অভিহিত করেছে। তাদের মতে, এগুলি শ্রমিকদের উপর অবিচার করেছে এবং নিয়োগকর্তাদের পক্ষে অনুকূল। অন্যদিকে ভারতীয় মজদুর সংঘ (বিএমএস) বলেছে, চারটি শ্রম কোড শ্রম বাজারের উদ্বেগ সমাধান করে এবং অসংগঠিত ক্ষেত্রে মজুরি কভারেজ ও সামাজিক নিরাপত্তা বৃদ্ধি আধুনিক কর্মীবাহিনীর প্রত্যাশার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ।
২৯টি বিদ্যমান আইনকে একীভূত করে চারটি শ্রম কোড তৈরি করা হয়েছে—সামাজিক নিরাপত্তা কোড ২০২০, মজুরি কোড ২০১৯, পেশাগত নিরাপত্তা ও স্বাস্থ্য কোড ২০২০ এবং শিল্প সম্পর্ক কোড ২০২০। এগুলি শ্রম আইনের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় সংস্কার হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ বলেছেন, এই চারটি কোড বিশ্বজুড়ে শ্রম আইনের জন্য একটি রোল মডেল হবে। শ্রমমন্ত্রী মনসুখ মান্ডব্য জানিয়েছেন, নতুন আইন আত্মনির্ভর ভারতের দিকে একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ, যা ২০৪৭ সালের মধ্যে উন্নত ভারতের লক্ষ্যে নতুন প্রেরণা জোগাবে। আগামী ৪৫ দিনের মধ্যে নিয়মাবলী জারি করা হবে। শ্রম আইন কেন্দ্র ও রাজ্যের যৌথ বিষয় হওয়ায় উভয় সরকারকে নিয়ম তৈরি করতে হবে। পশ্চিমবঙ্গ বাদে বেশিরভাগ রাজ্য ইতিমধ্যেই তাদের শ্রম আইন সংশোধন করেছে।
সব মিলিয়ে নতুন শ্রম আইন শ্রমিকদের সামাজিক নিরাপত্তা, স্বাস্থ্য সুরক্ষা এবং সমান সুযোগ নিশ্চিত করার পাশাপাশি নিয়োগকর্তাদের জন্যও নমনীয়তা এনেছে। একদিকে এটি শ্রমিকদের জীবনযাত্রার মান উন্নত করবে, অন্যদিকে ব্যবসার জন্য সম্মতির বোঝা কমাবে। তবে শ্রমিক সংগঠনগুলির সমালোচনা ইঙ্গিত করছে যে বাস্তব প্রয়োগে নানা চ্যালেঞ্জ আসতে পারে। তবুও, এই সংস্কার ভারতের শ্রম বাজারকে আধুনিক ও আন্তর্জাতিক মানের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ করার পথে এক বড় পদক্ষেপ হিসেবে দেখা হচ্ছে।

0 মন্তব্যসমূহ
Thank you so much for your kindness and support. Your generosity means the world to me. 😊