উত্তরবঙ্গে মমতা, করলেন প্রশাসনিক বৈঠক, দিলেন একাধিক ঘোষনাও!
উত্তরবঙ্গ সফরে এসেছেন তিনি। দুর্গোৎসবের পর বন্যা ও ধসে বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে উত্তরবঙ্গ। বিপর্যস্ত এলাকা পরিদর্শনে কলকাতায় কার্নিভাল শেষ করে উত্তরবঙ্গে ছুটে ছিলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। সরজমিনে খতিয়ে দেখে ফেরার সময় জানিয়েছেন ফের তাড়াতাড়ি উত্তরবঙ্গে আসবেন পরিস্থিতি সরজমিনে খতিয়ে দেখতে। সেই মতোই সোমবার ফের উত্তরবঙ্গে আসেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। করেন প্রশাসনিক বৈঠক।
মুখ্যমন্ত্রী জানান, "উত্তরবঙ্গ বিধ্বংসী বন্যা ও ভূমিধসের পর এখন ধীরে ধীরে স্বাভাবিক ছন্দে ফিরছে। এর জন্য আমি পুনরায় জেলা প্রশাসন থেকে শুরু করে সকল মানুষ যাঁরা এই মহান কর্মকাণ্ডে নিজের জীবন বাজি রেখে সাধারণ মানুষের সেবার্থে নিজেদের উজাড় করে দিয়েছিলেন - তাঁদের সকলকে হৃদয় থেকে কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি। প্রাণহানি, জীবিকা ও সম্পত্তির বিপুল ক্ষয়ক্ষতি সরেজমিনে দেখার পর আজ আমি ৬ অক্টোবরের পর তৃতীয়বারের জন্য উত্তরবঙ্গে এলাম। আগের সফরে ক্ষতিগ্রস্ত এলাকাগুলিতে ত্রাণ, উদ্ধার, পুনর্বাসন ও পুনর্গঠন কার্যক্রম সরাসরি পরিদর্শন করেছিলাম। ইতিমধ্যেই মৃতদের পরিবারকে ৫ লক্ষ টাকার আর্থিক সাহায্য ও সেই পরিবারের একজন সদস্যকে হোমগার্ড পদে চাকরি প্রদান করা হয়েছে।"
তিনি জানান, "আজ উত্তরকন্যা রাজ্য সচিবালয় থেকে সামগ্রিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত ১১,৫৫৫টি ও গুরুতরভাবে ক্ষতিগ্রস্ত ৩,২৩৯টি পরিবারকে বাড়ি পুনর্নির্মাণের জন্য অনুদান প্রদান করা হয়েছে, যার মোট ব্যয় ১৬১.৩৩ কোটি টাকা। কেন্দ্রীয় সরকার হঠাৎ করেই গ্রামীণ আবাসন প্রকল্পে আর্থিক সহায়তা বন্ধ করে দেওয়ার আগে, পশ্চিমবঙ্গ ভারতের ১ নম্বর রাজ্য ছিল, যেখানে ৪৫.৭ লক্ষেরও বেশি ঘর নির্মিত হয়েছে। কেন্দ্রের সহায়তা বন্ধ হওয়ার পর রাজ্য সরকার ‘বাংলার বাড়ি’ সকলের জন্য নিয়ে এসেছে। এই প্রকল্পের আওতায় ইতিমধ্যেই ১২ লক্ষ পরিবারকে ১৪,৪০০ কোটি টাকার অনুদান প্রদান করা হয়েছে, যাতে তারা নিজেদের ঘর তৈরি করতে পারে। শীঘ্রই আরও ১৬ লক্ষ পরিবারকে এই সহায়তা দেওয়া হবে, যাতে গ্রামীণ বাংলার প্রতিটি উপযুক্ত পরিবার নিরাপদ ও মর্যাদাপূর্ণভাবে বসবাস করতে পারে।"
এদিন সাম্প্রতিক বন্যা ও ধস কবলিত কৃষকদের ফসলের বীজ প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম প্রদান করেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। সরষে, গম, মুসুর, ভুট্টা, খেসারি, আলু ও অন্যান্য ফসলের চাষের জন্য ১,১৬,০০০-এরও বেশি কৃষককে ৬.৫ কোটি টাকার বীজ ও প্রয়োজনীয় সামগ্রী বিতরণ করা হয়েছে এদিন। এছাড়া ২০,৭২৪ জন কৃষককে ৩.৫ কোটি টাকার মৌসুমি সবজি যেমন কুমড়ো, ঢেঁড়স, বেগুন, লঙ্কা, শসা, টমেটো, গাজরের বীজ ও প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম দেওয়া হয়েছে। দার্জিলিং জেলায় ১,০৫০ জন কৃষককে কমলালেবু, আদা ও বড় এলাচের চারা গাছ বিতরণ করা হয়েছে, যাতে পাহাড়ি অঞ্চলের উদ্যানপালন আরও শক্তিশালী হয়।
পাশাপাশি, বন্যা ও ধস কবলিত দার্জিলিং, জলপাইগুড়ি, আলিপুরদুয়ার ও কোচবিহার জেলার ৮০৭ জন কৃষককে কৃষি জমি পুনরায় চাষযোগ্য করার জন্য ৪৭ লক্ষ টাকার আর্থিক সাহায্য প্রদান করা হয়েছে। ফসলহানির মূল্যায়ন শেষ হলে শীঘ্রই বাংলা শস্য বীমা প্রকল্পের আওতায় ক্ষতিপূরণ প্রদান করা হবে। এখন পর্যন্ত এই প্রকল্পের মাধ্যমে ১.১৩ কোটি কৃষক ৩,৯৩৮ কোটি টাকার ক্ষতিপূরণ পেয়েছেন।
আজ উত্তরবঙ্গের ৮টি জেলার ৩,৪৯১ জন উপভোক্তাকে পাট্টা দেওয়া হয়েছে। আমাদের সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকে মোট ৬.৫৬ লক্ষেরও বেশি পাট্টা বিতরণ করা হয়েছে — যার মধ্যে রয়েছে ৩.১৭ লক্ষেরও বেশি গৃহ পাট্টা, ১.৯৩ লক্ষেরও বেশি কৃষি পাট্টা, ৫৯ হাজারেরও বেশি উদ্বাস্তু পাট্টা, ৪৭ হাজারেরও বেশি বনপাট্টা এবং ৩৯ হাজারেরও বেশি চা-বাগান পাট্টা।
মুখ্যমন্ত্রী আরো বলেন, "উত্তরবঙ্গের চা-বাগান অঞ্চলে আমরা মোট ৫৩টি নতুন স্বাস্থ্যকেন্দ্র স্থাপন করছি, যার মধ্যে আজ জলপাইগুড়ি, আলিপুরদুয়ার ও দার্জিলিংয়ে ১৪টি কেন্দ্রের উদ্বোধন করা হয়েছে। আমি আজ চা-বাগান শ্রমিকদের শিশুদের জন্য ১৫টি নতুন ক্রেশ উদ্বোধন করেছি। এখন পর্যন্ত মোট ৯৫টি ক্রেশ নির্মিত হয়েছে। শিশুদের নিরাপদে স্কুলে পৌঁছানোর জন্য ১০টি বাস পরিষেবারও ব্যবস্থা করা হচ্ছে। সম্প্রতি ২৪টি চা-বাগান পুনরায় খোলা হয়েছে, যাতে ২২,০০০ শ্রমিক উপকৃত হয়েছেন। এর আগে ৫৯টি চা-বাগান পুনরায় চালু করা হয়েছিল।আমরা চা-বাগান শ্রমিকদের মজুরি উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি করেছি, তাঁদের জন্য ‘চা সুন্দরী’ প্রকল্পের মাধ্যমে মাথার উপর ছাদ, রেশন, জল, বিদ্যুৎ, স্বাস্থ্যসেবা ও প্রয়োজনীয় দৈনন্দিন সুবিধা নিশ্চিত করেছি।
তিনি এদিন বিশ্বজয়ী রিচার নামে শিলিগুড়িতে ক্রিকেট স্টেডিয়াম গড়ার ঘোষনা দেন। তিনি বলেন, "আমি আনন্দের সঙ্গে জানাচ্ছি, বিশ্বকাপজয়ী এবং বাংলার গর্ব রিচা ঘোষের নামে একটি ক্রিকেট স্টেডিয়াম নির্মাণের বিষয়ে আমাদের সরকার উদ্যোগ গ্রহণ করেছে — যা তরুণী ক্রীড়াবিদদের জন্য অনুপ্রেরণার উৎস হয়ে উঠবে, যাতে তারাও স্বপ্ন দেখতে ও তা পূরণে এগিয়ে যেতে পারে।"
পাশাপাশি মহাকাল মন্দির গড়া নিয়ে তিনি বলেন, আমরা ইতিমধ্যেই ১৭.৪ একর জমি ‘মহাকাল মন্দির’-এর জন্য বরাদ্দ করেছি। HIDCO-কে আহ্বায়ক করে প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে এবং মুখ্যসচিবের নেতৃত্বে একটি ট্রাস্ট গঠন করা হয়েছে যাতে সমগ্র প্রকল্পটি নির্বিঘ্নে সম্পন্ন করা যায়।
তিনি আরো বলেন, ভারতের মধ্যে পশ্চিমবঙ্গ অন্যতম বন্যাপ্রবণ রাজ্য — প্রতি বছর প্রায় বাংলার প্রায় ৪৩% ভৌগোলিক এলাকা বন্যার প্রভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এই দীর্ঘস্থায়ী সমস্যার স্থায়ী ও সমন্বিত সমাধান প্রয়োজন। আমি আবারও কেন্দ্র সরকারের কাছে আহ্বান জানাচ্ছি — ভারত–ভুটান যৌথ নদী কমিশন গঠনের মাধ্যমে নিয়মিত পর্যবেক্ষণ, তথ্য বিনিময় ও বন্যা ব্যবস্থাপনা নিয়ে একযোগে পদক্ষেপ করা হোক।
তিনি আরও বলেন, বর্তমানে রাজ্যে SIR প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। আমি রাজ্য সরকারের সমস্ত আধিকারিকদের কাছে আবেদন জানাচ্ছি — মানুষকে সম্পূর্ণ সহযোগিতা করুন, প্রতিটি ধাপে তাঁদের পাশে থাকুন। আমাদের সংবিধানিক কর্তব্য এবং নৈতিক দায়িত্ব — আমাদের মা, মাটি, মানুষ-এর অধিকার ও মর্যাদা রক্ষা করা।
0 মন্তব্যসমূহ
Thank you so much for your kindness and support. Your generosity means the world to me. 😊