কীভাবে প্রতিষ্ঠিত হল শ্রী শ্রী নিগমানন্দ সারস্বত আশ্রম এবং কীভাবে গড়ে উঠল নিগমনগর ? জানুন বিস্তারিত....
তপন বর্মন, সংবাদ একলব্য:
হে প্রভূ নিগমানন্দ, দাও প্রভু আনন্দ, নিরানন্দ লও কারিয়া"
ঠাকুর শ্রী শ্রী নিগমানন্দ পরমহংস দেব হলেন ভারতীয় আধ্যাত্মিক জগতে অন্যতম শ্রেষ্ঠ মহাপুরুষ । তাঁর আদর্শ ও বাণী যুগে যুগে ভক্ত ও সাধকদের পথপ্রদর্শক হয়ে উঠেছে। ১৮৮০ সালের ১৮ আগস্ট ঝুলন পূর্নিমা তিথিতে নদীয়া জেলার কুতুবপুরে শ্রী শ্রী ঠাকুরের আবির্ভাব । প্রথম জীবনে তার নাম ছিল নলিনীকান্ত চট্টোপাধ্যায় । তন্ত্র, যোগ, জ্ঞান ও প্রেম—এই চার সাধনায় তিনি ছিলেন সিদ্ধ পুরুষ। ভক্তদের কথায় তিনি হলেন বটবৃক্ষ,আর তার শীতল ছায়ায় এলে হৃদয় জুড়িয়ে যায়,পরম আনন্দ প্রাপ্তি ঘটে ,মেলে পরম সুখ।
আজ দিনহাটা মহকুমার নিগম নগরে পরম প্রেমময় ঠাকুর শ্রী শ্রী স্বামী নিগমানন্দ পরমহংস দেবের ১৪৬ তম শুভ আবির্ভাব তিথিতে নিগমানন্দ সারস্বত আশ্রমে সারাদিন ব্যাপি নানান আচার - অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে উদযাপিত হয়। অসংখ্য ভক্ত সমাগমে শ্রী শ্রী ঠাকুরের আশীর্বাদ ধন্য এ স্হান হয়ে ওঠে আনন্দপুরী।
এখন প্রশ্ন হল , কীভাবে এই স্হানে শ্রী শ্রী নিগমানন্দ সারস্বত আশ্রমের প্রতিষ্ঠা হল ? আশ্রমকে কেন্দ্র করে কীভাবে গড়ে উঠল নিগম নগর। তা জানুন বিস্তারিত....
এ প্রসঙ্গে শ্রী বিনোদ বিহারী বর্মন মহাশয়ের লেখা পুস্তিকা " নিগমতীর্থ নিগমনগর ও স্বামী সিদ্ধানন্দ" কিংবা স্বামী সিদ্ধানন্দের "বগুড়ার স্মৃতি" গ্রন্থে এর সুনির্দিষ্ট প্রমাণ মেলে।
আজ থেকে প্রায় সাত আট দশক আগের কথা - তখন কুচবিহার ছিল স্বাধীন দেশীয় রাজ্য। সেই সময় বর্তমানের কোচবিহার জেলার দিনহাটা মহকুমার একটি সমৃদ্ধ গ্রাম হল ২ য় খন্ড ভাগ্নি। এই সুজলা সুফলা গ্রামের পাশ দিয়ে বয়ে গেছে স্বচ্ছতোয়া নদী বানিয়াদহ। দিনহাটা শহর থেকে পাঁচ কিমি দূরে এই নদী তীরবর্তী অঞ্চলের পূর্ব দিকে বড়শাকদল গ্রাম পঞ্চায়েতের লাঙ্গুলিয়া গ্রাম, উত্তরে ভাগ্নি ও দুরাচাপরি, দক্ষিণে কিশামত দশ গ্রামের টিয়াদহ গ্রাম। সেই সময় এই স্হান ছিল নদী বেষ্টিত শ্বাপদসঙ্কুল একটি স্হান। এর চার পাশে বালির চর আর ঘন জঙ্গলে ভরা। মানুষের বসতি ছিল খুব কম । হিংস্র জন্তু জানোয়ারের ভয়ে রাত হলে মানুষ বাড়ির বাইরে বেরোতে ভয় পেত। রাতে আগুন জ্বালিয়ে রাখতে হত।কৃষি ক্ষেত্রে কিংবা কোথাও কাজ করতে গেলে সবাইকে দলবলে থাকতে হত। একটু রাত হলেই শুরু হত মশাল নিয়ে দৌড়।
অথচ আজ এই স্হান শ্রী শ্রী ঠাকুরের আশীর্বাদে হয়ে উঠল তীর্থভূমি।
কিন্তু কীভাবে?
ঐতিহাসিক তথ্য অনুযায়ী
১৯৪৭ সালের ১৫ ই আগস্ট ভারতের স্বাধীনতা লাভের পর কোচবিহারের মহারাজা সঙ্গে ভারত সরকারের চুক্তি অনুযায়ী কোচবিহার ভারতের অন্তর্ভুক্ত হয় এবং ১৯৫০ সালের ১ লা জানুয়ারি কোচবিহার পশ্চিমবঙ্গের একটি জেলায় পরিণত হয়। ভারত স্বাধীন হওয়ার পর দেশ ভাগের যন্ত্রণাকে কাঁধে নিয়ে বহু মানুষ উদ্বাস্তু হয়ে পূর্ব পাকিস্তান থেকে ভারতে আসতে বাধ্য হয়। তারা এদেশের বিভিন্ন স্হানে পরবর্তীতে সরকারি সহায়তার বসবাস শুরু করেন।
পরম প্রেমময় ঠাকুর শ্রী শ্রী নিগমানন্দ পরমহংস দেবের বাংলাদেশের বগুড়ার আশীর্বাদ ধন্য শিষ্যগনও জন্মস্থানের ভিটেমাটি ছেড়ে ভারতে চলে আসেন। সেই সময় ঠাকুরের প্রিয় ভক্ত স্বামী সিদ্বানন্দ সরস্বতী মহারাজজিও বগুড়ার মায়া ত্যাগ করে হালিসহর দক্ষিণ বাংলা সারস্বত আশ্রমে চলে আসেন।
তিনি পরবর্তী কোচবিহার জেলায় একটি আশ্রম স্থাপনের জন্য উপযুক্ত স্হানের সন্ধান করতে থাকেন। তিনি জানতে পারেন ১৩৩৫ বঙ্গাব্দ তথা ১৯২৮ খ্রিস্টাব্দে শ্রী শ্রী ঠাকুর মহারাজ স্বয়ং তাঁর প্রিয় দুই শিষ্য স্বামী প্রজ্ঞানন্দ ও জিতেন ব্রহ্মচারীকে নিয়ে দিনহাটা মহকুমার দ্বিতীয় খন্ড ভাগ্নি গ্রামের লক্ষ্মীকান্ত সিংহের বাড়িতে পদার্পণ করেছিলেন এবং ঠাকুর সেখানে তিন দিন অবস্হান করেছিলেন। সেখানে কতিপয় ভক্ত তার শিষ্যত্ব গ্রহণ করেছিলেন।
এরপর শ্রী শ্রী ঠাকুরের শ্রীচরণরেণুপূত এই স্থানে দেবদূত হয়ে আসেন ঠাকুরের কর্মবীর সন্ন্যাসী সর্বজন শ্রদ্ধেয় স্বামী সিদ্ধানন্দ সরস্বতী মহারাজজি। তিনি এলাকার পুরোনো ভক্ত দের ঘরে ঘরে গিয়ে আশ্রম স্হাপনের বিষয়টি জানান, উৎসাহ ও আগ্রহ প্রকাশ করেন।
এরপর ভাগ্নি গ্রামের শিষ্যভক্ত গন শ্রী শ্রী ঠাকুরের আশ্রম স্হাপনের জন্য তাদের হরিসভার ঘরটি দান করেন। ১৩৫৭ বঙ্গাব্দ তথা ১৯৫০ খ্রিস্টাব্দের ১০ই ভাদ্র পুণ্য ঝুলন পূর্ণিমা তিথিতে সেই ঘরেই ঠাকুরের আসন মন্দির স্থাপন করা হয়। গড়ে ওঠে শ্রী শ্রী নিগমানন্দ সারস্বত আশ্রম। সুন্দর অরণ্য পল্লীতে এ এক মনোরম তপোবন।
পরবর্তীতে কালে শ্রী শ্রী ঠাকুরের আশ্রম গঠনে অনেক ভক্তই নিঃশর্তভাবে জমি ও অর্থ দান করেছিলেন। এরপর ১৩৬৯ বঙ্গাব্দে তথা ১৯৬২ সাল নাগাদ পাঁকা মন্দিরটি নির্মিত হয়।
বর্তমানে মূল মন্দিরের পাশে আনুমানিক দুই কোটি টাকা ব্যয়ে বিশালাকার মন্দিরের নির্মাণ কাজ চলছে। সম্পূর্ণ ভক্ত বৃন্দের আর্থিক আনুকূল্যে চলছে এই মন্দিরের নির্মাণ কাজ। মন্দিরের শুভ উদ্বোধন হবে ২০২৭ সালে ফ্রেব্রুয়ারি মাসে। মন্দিরের নীচ তলে থাকবে সভাকক্ষ এবং উপর তলায় শ্বেত পাথরের তৈরী ঠাকুরের বিগ্রহ প্রতিষ্ঠা পাবে। এছাড়াও থাকবে শঙ্করাচার্য ও চৈতন্য মহাপ্রভুর বিগ্রহ।
এবারে বিষয় হল কীভাবে গড়ে উঠল নিগম নগর?
আশ্রম প্রতিষ্ঠার কিছুদিন পর পশ্চিমবঙ্গ সরকার এর পক্ষ থেকে আশ্রমের চারপাশে ১৫০ বিঘা জমি খাস করে নেওয়া হয়। পূর্ববঙ্গ থেকে আসা উদ্বাস্তু মানুষদের জন্য পল্লী নির্মাণ কাজ শুরু হয়। তৎকালীন দিনহাটা মহকুমা শাসক জিতেন্দ্র কিশোর গুপ্ত উদ্বাস্তু দের জন্য জমি সংগ্রহ এবং তা বন্টনের ব্যবস্থা করেন। এরপর থেকে বানিয়াদহ নদীর তীরবর্তী এই শ্বাপদসঙ্কুল ঘন জঙ্গল কেটে বহু কষ্টে আশ্রমের চারপাশে গড়ে উঠে নতুন পল্লী। আর স্বামী সিদ্ধানন্দ সরস্বতী মহারাজ ঠাকুর শ্রী শ্রী নিগমানন্দ পরমহংস দেবের নাম অনুযায়ী এই পল্লীর নাম দেন নিগমনগর।
0 মন্তব্যসমূহ
Thank you so much for your kindness and support. Your generosity means the world to me. 😊