রাণীগঞ্জের সিয়ারসোলের পিতলের রথ, জানুন ইতিহাস
রামকৃষ্ণ চ্যাটার্জী, আসানসোল:
রথের প্রসঙ্গ উঠলেই সবার চোখের সামনে পুরীর জগন্নাথ দেবের রথযাত্রার চিত্র ভেসে ওঠে। লক্ষ লক্ষ ভক্তদের সমাগমে ভরে ওঠে এলাকা। সবার একটাই লক্ষ্য - রথের পবিত্র দড়ি স্পর্শ করা। পুরীর সমতুল্য নাহলেও রাণীগঞ্জের সিয়ারসোলে পিতল দিয়ে তৈরি রথের আকর্ষণে বহু ভক্তের ভিড় সেখানে দেখা যায়। এর পিছনে লুকিয়ে আছে দীর্ঘ ইতিহাস, যার শুরু কাশ্মীর থেকে।
আফগানদের অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে বহু কাশ্মীরি পণ্ডিত কাশ্মীর ছেড়ে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে চলে যায়। এদের অন্যতম হলেন সদাশিব পণ্ডিত। তার পুত্র গোবিন্দপ্রসাদ পন্ডিত কর্মসূত্রে বিভিন্ন প্রান্তে ঘুরে অবিভক্ত বর্ধমানের রানীগঞ্জের বোগড়াচটিতে বসবাস শুরু করেন। ধীরে ধীরে জমি ক্রয় করে তিনি এই এলাকার জমিদার হয়ে ওঠেন। তিনি সিয়ারসোলে একটি বাসভবন স্থাপন করেন যেটি পুরনো রাজবাড়ি নামে পরিচিত। রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে সেটি আজ অতীতের স্মৃতি হয়ে পড়ে আছে। তিনি দানশীল ও স্নেহপ্রবণ ছিলেন।
এই গোবিন্দপ্রসাদের কন্যা হলেন হরসুন্দরী। তার পাঁচ পুত্রের অন্যতম ছিলেন বিশ্বেশ্বর মালিয়া। পরবর্তীকালে মাতা হরসুন্দরী দেবী এবং পুত্র বিশ্বেশ্বর মালিয়া জনকল্যাণকর কাজে নিজেদের নিযুক্ত করেন। বিশ্বেশ্বর মালিয়া ও তার স্ত্রী গোলাপ সুন্দরীর নামে তৈরি হয় বিশ্ব-গোলাপ নতুন রাজবাড়ি। জনহিতকর কাজের জন্য ইংরেজরা হরসুন্দরী দেবীকে ‘রানী’ এবং বিশ্বেশ্বর মালিয়াকে ‘রাজা’ উপাধিতে ভূষিত করে।
এই হরসুন্দরী দেবীর উদ্যোগে ১৮৭৭ খ্রী. সিয়ারসোলে প্রথম রথের প্রবর্তন হয়। সেটি ছিল কাঠের তৈরি রথ। খড়ের ছাউনি যুক্ত আটচালায় সেটি রাখা হতো। হঠাৎ কাঠের তৈরি রথে আগুন লেগে সব পুড়ে ছাই হয়ে যায়। পরে বিশ্বেশ্বর মালিয়ার পুত্র প্রমথনাথ মালিয়ার উদ্যোগে ১৯২৩ খ্রী. কলকাতার শ্রী প্রসাদ চন্দ্র দাস এন্ড কোম্পানি পিতলের রথ তৈরি করে দেয়। ১৩৩০ বঙ্গাব্দের ২৬ শে আষাঢ়, রবিবার পিতল নির্মিত রথটির প্রতিষ্ঠা করা হয়।
ত্রিশ ফুট উচ্চতা বিশিষ্ট রথটি দৈর্ঘ্য ও প্রস্থে ষোলো ফুট তিন ইঞ্চি। বর্গাকার এই রথটি ত্রিতল বিশিষ্ট। সামনের দিকে প্রথম তলে যাওয়ার জন্য একটি প্রবেশপথ আছে। ভেতরে গা বরাবর সিঁড়ি দিয়ে উপরে ওঠা যায়। রথটিতে ন'টি চূড়া আছে। এই রথের ওজন ৮ থেকে ১০ টন। রথের চূড়ায় রাজ পরিবারের কুলদেবতা দামোদর চন্দ্র জিউ এর মূর্তি প্রতিষ্ঠা করা হয়।
টেরাকোটা নবরত্ন মন্দিরের আদলে তৈরি পিতলের রথের চারপাশে স্থায়ীভাবে বসানো আছে রামায়ণ, মহাভারত, পৌরাণিক যুগের এবং কৃষ্ণলীলা বিষয়ক নানা মূর্তি। রথের চারদিকে আছে ৩৬ জোড়া ময়ূর ও চোখ।
আগে রথটি মানুষ টানলেও ভারীর কারণে বর্তমানে এটি ট্রাকের সাহায্যে টানা হয়। যদিও এরজন্য ভক্তদের উৎসাহের কোনো ভাঁটা পড়েনি। আগে রথযাত্রার দিন রথটি পুরনো রাজবাড়ি থেকে টেনে এনে নতুন রাজবাড়িতে আনা হতো এবং উল্টোরথের দিন আবার সেটি পুরনো রাজবাড়িতে নিয়ে যাওয়া হতো। বর্তমানে উল্টোটা করা হয়। রথের মধ্যে থাকা মূল্যবান মূর্তি যাতে কেউ চুরি করতে না পারে তারজন্য রথটি খোলা আকাশের নীচে নতুন রাজবাড়ীর সামনে কড়া পাহারায় রাখা হয়।
রাণীগঞ্জের রথযাত্রা উৎসবকে কেন্দ্র করে বসে মেলা। পিতলের রথ ও মেলা দেখতে দূরদূরান্ত থেকে ভক্তদের সঙ্গে বহু সাধারণ মানুষ এই মেলায় ভিড় করে।
মোটামুটি এটাই হলো রাণীগঞ্জের সিয়ারসোলের পিতলের রথের কাহিনী। এই কাহিনী জানা গেল এলাকার বাসিন্দা রামেন্দু মুখার্জ্জী, রাজা চৌধুরী, বিপদতারণ বাদ্যকর প্রমুখদের কাছ থেকে।
রামেন্দু বাবু বললেন - এই ঐতিহ্যবাহী পিতলের রথের কাহিনী শুনেছি আমার বাপ-ঠাকুরদা ও পাড়ার প্রবীণদের কাছে। সত্যিই এটি আমাদের এলাকার গর্ব। একে ধরে রাখার দায়িত্ব আমাদের সবার।
0 মন্তব্যসমূহ
Thank you so much for your kindness and support. Your generosity means the world to me. 😊