২৫০ বছর আগের কালী মা দেশভাগের পর এলো বামনহাটে, জানুন ইতিহাস 

পাথরশন মাধাঈখাল কালীবাড়ির ইতিহাস



কলমে : তপন বর্মন


"মা কালীর ভংড়িয়া খড়্গ নাথ আসিয়া,
অবতীর্ণ হইয়া অচৈতন্য জীবকে চৈতন্য করায়।
ভয় করো না প্রান, হও আগুয়ান, মাকে প্রতিষ্ঠা করো,
সপে ধন, মন ও প্রাণ।
আনন্দে মাতিয়া নাচরে গাওরে,
পরাণ ভরিয়া ডাক তাহারে। '
মান অভিমান মায়ের চরণে সপরে।"
( শরৎচন্দ্র বর্মন)



কোচবিহার জেলার জনপ্রিয় মেলাগুলির মধ্যে অন্যতম হল দিনহাটা মহকুমার সাহেবগঞ্জ থানার পাথরশনের মাধাঈখাল কালী মেলা। পনেরো দিন ধরে চলা এই মেলা দর্শনার্থীদের ঢল সত্যিই বিস্ময়কর। প্রত্যেক বছর অষ্টমীর স্নান অর্থাৎ চৈত্র কিংবা বৈশাখের বাসন্তী দেবীর পূজার পরের শনিবার বা মঙ্গলবার থেকে এই মেলার সূচনা ঘটে। তবে অষ্টমীর পরের শনিবার বা মঙ্গলবার যদি অমাবস্যা বা পূর্ণিমা হয় তবে এ মেলার শুরু হওয়ার দিনের পরিবর্তন হয়ে থাকে। এবারের মেলা ৭২ তম। ৭ই বৈশাখ ১৪৩১ থেকে ২১শে বৈশাখ১৪৩১ বঙ্গাব্দ ( ২০ এপ্রিল ২০২৪ থেকে ৪ঠা মে ২০২৪ ইং) পর্যন্ত ১৫ দিন ধরে চলবে এই মেলা । মেলাকে ঘিরে এলাকাবাসীর উন্মাদনা নজর কাড়ার মতো । দূর দূরান্ত থেকে ভক্তের ঢল নামে এই মেলায়। আসাম,আলিপুর,জলপাইগুড়ি, শিলিগুড়ি ,দুই দিনাজপুর জেলা ছাড়াও বিভিন্ন অঞ্চলের দর্শনার্থীরা এই মেলা দেখতে আসেন। অধুনা বাংলাদেশের লালমনিরহাট, কুড়িগ্রাম প্রভৃতি স্হান থেকে ও মানুষ একসময় এই মেলায় আসতেন।

অনেক ভক্ত বৃন্দ মায়ের কাছে মানত করা "ভেটি" নিয়ে আসে। তাদের বিশ্বাস মায়ের কাছে মানত অর্থাৎ মানসা করলে তা মায়ের কৃপায় পূরণ হয়। মা নিঃসন্তানদের সন্তান দেন, অনেক কঠিন রোগ থেকে মুক্তি দেন। পূজার সময় ছাড়াও প্রত্যেক শনিবার ও মঙ্গলবার মন্দিরে পূজা চলে। মন্দিরের সামনে পাঠা বলি দেওয়া হয়। এছাড়া অনেকে পায়রাও দিয়ে থাকেন। মেলা শুরু হওয়ার আট দিনের মাথায় শনিবার বা মঙ্গলবার মহিষ বলি দেওয়া হয়। ঐদিন সব থেকে মেলায় বেশি ভীর জমে। ঐদিনকে "অষ্টহারা" বলা হয়। মেলায় মন্দিরের চারপাশে ধূপ, মোমবাতি, সিঁদুর, বাতাসার দোকান পসরা করে বসে। দর্শনার্থীদরা সেখান থেকে "ভেটি" কিনে মায়ের কাছে নিবেদন করে।

মায়ের মূর্তির বিশালতা মাধাঈখাল কালীর একটা বড়ো বৈশিষ্ট্য। এছাড়াও মূল মন্দিরের পাশে শীতলা ,যকাযকিনী, সন্ন্যাসী, মাসানবাবা ,শ্রী হরি ঠাকুরেরও কয়েকটি ছোটো ছোটো মন্দিরে রয়েছে এবং এখানে পাগলাপীরেরও পুজো হয়ে থাকে l

মেলায় নানান ধরণের দোকান বসে। নাগোরদোলা, লটারি, সার্কাস, মিষ্টি জিলিপির দোকান, বই, ফুলের, ঠাকুর পূজার উপকরণ, খেলনা, বাসনপত্র, নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিস পত্র, বিভিন্ন খাওয়ার দোকান, কাঠের আসবাবপত্র, মেলামাইন, মনোহারির দোকান, পুতুল নাচ, প্রভৃতি। রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে এই রকমারি দোকানগুলি এই মেলায় আসে। মেলা একপ্রকার জিনিস কেনা বেঁচার আর আনন্দ উপভোগের একটা পীঠস্থানে পরিণত হয়।

হাজার হাজার মানুষের সমাগম ঘটে এই মেলায়। হিন্দু মুসলমান সকল শ্রেণী মানুষ এই মেলায় এসে আনন্দ উপভোগ করেন।

সীমান্তবর্তী গ্রাম পাথরশনের এই মাধাঈখাল কালীবাড়ির অনেক ইতিহাস রয়েছে যা লোক মুখে প্রচলিত।

ইদানীং স্যোশাল মিডিয়ার দৌলেতে প্রচুর প্রামাণ্য ইতিহাস পাওয়া গেছে যার ফলে মাধাঈখাল কালীবাড়ির ইতিহাসের সঠিক তথ্য সংগ্রহ করতে অনেক সুবিধা হয়েছে।

মাধাঈখাল বলে বামনহাট পাথরশনে কোনো গ্রাম বা এলাকা বা পাড়া নেই। তাহলে এই কালী মন্দিরের নাম মাধাঈখাল কালীমন্দির কেন হল?

এ প্রশ্নের উত্তরে ইতিহাসের দিকে মুখ ফিরিয়ে নিতে হয়। বামনহাট পাথরশনে এই মেলা শুরু হয় ১৯৫২ সালে। আজ থেকে ৭২ বছর আগে। দেশ ভাগের পর বাংলাদেশ থেকে আসা খড়্গ ভংড়িয়ার হাত ধরে। তখন থেকে বামনহাট মাধাঈখাল কালী মেলা কোচবিহার জেলার তথা গোটা উত্তরবঙ্গের অন্যতম মেলা হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছে। কিন্তু অধুনা বাংলাদেশে যে এই মেলার প্রথম সূচনা ঘটেছিল তার বহু ব্যাখ্যাও লোকমুখে প্রচলিত ।

"দেশের কন্ঠ "নামে বাংলাদেশের অনলাইন পত্রিকা অনুয়ায়ী মাধাঈখাল কালী মেলা ২৫০ বছরের পুরনো। যা বাংলাদেশে বিলুপ্তির পথে ।

"দেশের কন্ঠ "(কুড়িগ্রাম থেকে সাঈদ বাবু) (শনিবার, ১৬ এপ্রিল ২০২২, বিকাল ৭:৪৯) পত্রিকা অনুযায়ী অবিভক্ত বাংলার মানুষের বার্ষিক সাংস্কৃতিক মহাউৎসবের পাদপীঠ হিসেবে পরিচিত ছিল কুড়িগ্রামের নাগেশ্বরী উপজেলার অন্তর্গত কালিগঞ্জ ইউনিয়নের এই মাধাঈখাল কালী মন্দিরের বার্ষিক মেলা যা মাধাঈখালের মেলা বলে পরিচিত। আজ সেখানে প্রায় বিলুপ্তির পথে প্রায় ২২৪ বছর মতান্তরে ২৫৭ বছরের পুরাতন ঐতিহ্যবাহী মাদাঈখালের মেলা।

মাধাঈখাল মন্দিরে তৈরি হওয়া নতুন দরজায় এর উৎপত্তি সাল ১২০০ বঙ্গাব্দ লেখা হলেও স্থানীয় বাসিন্দা যাদের বয়স ৮০ থেকে ৯০ এর কোঠায় এমনকি মেলার পূজারী ৯৩ বছর বয়সী মনাই চন্দ্রও জানেন না এর উৎপত্তি আসলে কয়েকশ বছর পূর্বে।

তবে পত্রিকা অনুযায়ী সেখানকার একজন প্রহরী জানান,এখনও যে ফটকটি রয়েছে এ ফটকের আগে আরেকটি ফটকে এর প্রতিষ্ঠাকাল লেখা ছিল ১১৭২ বঙ্গাব্দ। সে হিসেবে এটি প্রায় ২৫৭ বছর পূর্ব থেকে চলে আসছে।

মাধাঈখাল কালীমন্দির ও সংশ্লিষ্ট মেলার উৎপত্তি সম্পর্কে জানা যায়, তৎকালীন বা আদিকালের মানুষের বিশ্বাস ছিল যে, রোগ থেকে বা যেকোনো ধরনের বিপদ থেকে মুক্তির জন্য মানত বা মানসা করলে মানুষের ইচ্ছা পূরণ হয়। আড়াইশো বছর পূর্বে মাধাঈখাল নামক এই বিলের পাশের গ্রামে 'পৌষনাথ' নামে একজন কবিরাজ ছিলেন। তার কাছে কেউ রোগমুক্তি বা অন্য কোন সমস্যা নিয়ে গেলে তিনি মাদাইখাল মন্দিরের এই স্থানটিতে মানত বা মনসা করতে বলতেন। সে বিশ্বাসে রোগমুক্তি ও সমস্যা সমাধান হলে তারা এসে এখানে সেই মানসার বস্তু বা জন্তু দিয়ে যেত, তখন থেকে এর প্রচলন ঘটে এবং সে সময়ে ওই স্থানে ঠাকুরদা রসরাজ সরকার নামে এক ব্যক্তি ওই স্থানটিতে এই কালী মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন। আর মাধাঈখাল বিলের নামানুসারে এই মন্দিরের নাম এবং মেলার নামটি যুক্ত হয়ে যায়।

সেই থেকে প্রচলিত বিশ্বাস শুরু হয়ে তখন থেকে এই কালী মন্দিরে পূজার্চনার পাশাপাশি প্রতি বছর আট থেকে নয় দিন ধরে পঞ্জিকা তিথি দেখে এ মেলা হতো। যাতে সারাদেশের বিভিন্ন জেলা থেকে হিন্দু ধর্মের লোকজন ছাড়াও পার্শ্ববর্তী দেশ হিসেবে ভারত, নেপাল থেকেও ভক্ত বৃন্দরা মেলায় আসতো। সেখানকার মূল মন্দিরের ভেতরে বিশালাকৃতির একটি কালী মূর্তি রয়েছে। যার উচ্চতা ১৮.৫ ফুট । এর পাশাপাশি নিচে আরও ছয় থেকে সাত টি দুর্গা ও অন্যান্য মূর্তি রয়েছে।

একটা সময় কিলোমিটারের পর কিলোমিটার এতো বেশি পরিমাণ মানুষ হতো যে চোখের পলকে একজন আড়াল হলে তাকে আর খুঁজে পাওয়া যেত না। মন্দিরের মাইকে মাইকিং করে নির্ধারিত স্থানে আসতে বললে তাকে পেতেও অনেক সময় লেগে যেত। আর বর্তমানে সেখানে মেলা সেরকম হয় না। মেলার পরিধিও ক্রমশ ছোট হয়ে আসছে। সাড়ে তিন বিঘা জমির উপর এটির অবস্থান। তবে শনিবার মঙ্গলবার এখনও সেখানে নিত্য পূজা হয়।

সেই ওপার বাংলার মাধাঈখাল কালী দেশবিভাগের পর দীর্ঘ ৭২ বছর ধরে এপার বাংলার কোচবিহার জেলার দিনহাটা মহকুমার বামনহাট অঞ্চলের পাথরশনে পূজিত হয়ে আসছে। বর্তমানের পূজা কমিটির সম্পাদক ললিত বর্মন ও এলাকার কিছূ প্রবীন ব্যক্তি জানান দেশ বিভাগের পর বাংলাদেশের মাধাঈখাল কালী মন্দিরের পূজারি খড়্গ ভংড়িয়া ভারতে চলে আসেন। সেই সাথে অনেক ভক্তবৃন্দও এখানে এসে বসবাস শুরু করেন। প্রচলিত কাহিনী অনুসারে মাধাঈখাল কালী মা নাকি এখানে চলে আসা ভক্তদের স্বপ্নে বলত " তোরা চলে আসছিস, আমার পূজা এখন কারা করবে? আমাকে এখানে স্হান দে। " এরপর বিষয়টা এলাকার বিশিষ্ট মানুষ যেমন কান্তেশ্বর বর্মন, বুদ্ধেশ্বর বর্মন, হরিপদ বর্মন,লোকনাথ বর্মন ,পাদুড়া বর্মন, জ্যোতিষ বর্মন, শেল্লা , ক্ষেতারু,জোগলা ভদ্রমোহন প্রমূখ ব্যক্তি বর্গের গোচরে আসলে তাদের সহযোগিতায় ,বর্তমানে যেখানে মায়ের মূল মন্দির সেখানে একটি জগদ্ধাত্রী দেবীর মন্দির রয়েছে এর পাশেই মায়ের থান দিয়ে পূজা ব্যবস্থা করা হয়। শোনা যায় মাধাঈখাল কালী মন্দির স্থাপনের মুহূর্তে খড়্গ ভংড়িয়া ভর ওঠে আর উনি নৃত্য করতে করতে পায়ের গোড়ালি দিয়ে যেখানে যেখানে গর্ত করতেন সেখানে সেখানে বর্তমানের মন্দির সহ মন্দিরের পাশের বিভিন্ন দেবতার মন্দির গুলি নির্মিত হয়েছিল। প্রথমে ছন খড়ের ঘরে মায়ের মন্দির নির্মিত হয়েছিল। পরবর্তীতে প্রায় সত্তরের দশকে বর্তমানের এই বিশাল মন্দিরটি নির্মাণ করা হয়। শোনা যায় সেই সময় ভক্তরা শিব,কালী ,যকা যকিনী সেজে বাড়ি বাড়ি দক্ষিণা আদায় করত। একে" মাক্তা" বলত। এর মধ্য দিয়ে তারা মন্দির সংস্কারের জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ জোগাড় করত।

এই মাধাঈখাল কালী মন্দির নামকরণ খড়্গ ভংড়িয়াই দেওয়া ,যা ওপার বাংলার মায়ের মন্দিরের নাম অনুযায়ী এখানেও একই নামকরণ করেছিলেন।

মন্দিরে মায়ের পূজা যে যে ভংড়িয়া করছিল তারা হলেন ১ম খড়্গ নাথ, পরবর্তীতে সুনীল, গিরীধর, আলসিহা,পচা ভংড়িয়া ও বর্তমানে শান্তি ভংড়িয়ানী।

ব্রাক্ষ্মণ মধ্যে যারা ছিলেন শুরুতে বিশ্বেশ্বর ভাগবতী, আদ্যনাদ ভাগবতী,মিন্টু শর্মা, বাবলু শর্মা পূজা প্রমূখ। এছাড়াও দেউরি ও ভাড়ালিও আছে।

ওপার বাংলার মায়ের মন্দিরের পাশে যেমন বিশাল আকার মাধাঈখাল রয়েছে তেমনি পাথরশনের মাধাঈখাল মন্দিরের পানির একটি বড়ো পুকুর খনন করা হয়েছে।

বিগত কয়েক বছর ধরে মন্দিরের পাশে শিবলিঙ্গ স্হাপন করা হয়। প্রত্যেক শ্রাবন মাসে এবং শিবরাত্রিতে পূজা দেওয়ার জন্য শিব ভক্তদের ঢল নামে।

মেলা শুরু হওয়ার প্রথম দিকে কুশান ও দোতারা গানের নরক হত। মেলার জন্য স্পেশ্যাল ট্রেন ও স্পেশ্যাল বাসেরও ব্যবস্থা করা হত।

বাজারে সবকিছুই কিনতে পাওয়া যায় কিন্তু সুখ ও শান্তি কিনতে পাওয়া যায় না। আমাদের অন্তরের আলোই শ্রেষ্ঠ সম্পদ। নির্মল আনন্দই, অন্তরই সুখ ও শান্তি দিতে পারে, আত্মার ক্ষুধা মেটায়।

তাই মায়ের সেবক শরৎচন্দ্র বর্মন বলেছেন-

" মা কালীর উপর থাকলে ভরসা,
সবার কামনা হয় ফরসা।
সব সমস্যার সমাধান,
মায়ের প্রতি রইলে টান।
অন্তর সবার মধুময় হয়,
সুশিক্ষা লাভের ফলে,
ছিন্ন জীবন জোড়া লাগে ভাই,
মাধাঈখাল কালীবাড়ি গেলে। "


পরিশেষে একথা বলাই যায়-দেশভাগের যন্ত্রনা ,আত্মীয় স্বজনদের বিচ্ছেদের যন্ত্রনা মানুষের জীবনে যখন হৃদপিন্ডের প্রকোষ্ঠ গুলিকে উই পোকার মতন করে কামড়ে খাচ্ছিল, তখনই এপার বাংলায় চলে এসে আবারও সকলের মধ্যে মহামিলনের এক পীঠস্থান ছিল এই মাধাঈখাল মেলা। যা আজও স্বমহিমায় মায়ের কৃপায় বিস্তৃত লাভ করেই চলছে।


কলমে : তপন বর্মন
বড়শাকদল, দিনহাটা, কোচবিহার।
৯০০২৮১২৬৭৩
তারিখ:২২/০৪/২০২৪ ইং।


তথ্য সূত্র: 
১) বামনহাট দর্পন, ফেসবুক পেজ, নিশীথ কুমার সেনের প্রবন্ধ।
২) দেশের কন্ঠ পত্রিকা (শনিবার, ১৬ এপ্রিল ২০২২) 

ব্যক্তি ঋণ:
১) শরৎচন্দ্র বর্মন
২) ললিত বর্মন