রাজ্য বাজেট থেকে ১৪ হাজার 'স্টেট এইডেড কলেজ টিচার'-রা সমাজের ট্রান্সজেন্ডারদের মতো বঞ্চিত কেন ?
লেখক: সুফল সরকার
রাজ্যের বিভিন্ন কলেজে সরকারিভাবে নিযুক্ত প্রায় ১৪ হাজার "স্টেট এইডেড কলেজ টিচার"-রা রাজ্য বাজেটে না স্থায়ী, না অস্থায়ী কর্মচারীদের মতো বিশেষ সুযোগ সুবিধা পেলো ! তবে এরা কি সমাজের ট্রান্সজেন্ডারদের মতো বঞ্চিত নয় ?
কেন্দ্রীয় সরকারের বাজেট অতি সাম্প্রতিক পেশ হয়ে গেছে । কিছু খবরে ও সামাজিক মাধ্যমে প্রকাশ এই বাজেটে নাকি সাধারণ জনগণ সহ অন্যান্যদেরও কোনো বিশেষ সুযোগ সুবিধার দিক দিয়ে একেবারেই চমক নেই । বরঞ্চ শিক্ষা সংক্রান্ত খাতে ব্যয় বরাদ্দ অতি নগণ্য এবং ক্রমাগত ও তুলনামূলক নিম্নমুখী । কারণ সকলের ধারণা কেন্দ্রীয় সরকারের সঙ্গে ধর্মের রাজা মর্যাদা পুরুষোত্তম শ্রী রাম আছেন । পাঁচশো বছর পরে তিনি নাকি ফিরে এসেছেন ! সেই আনন্দে আমরা আবেগী হয়ে বসে আছি । তার রেশ হয়তো ব্যালট বাক্সে প্রতিফলিত হবে । বলা যায়, সে কারণে অতি দ্রুত ভগবান রাম চন্দ্রের মন্দির নির্মাণ ও তাঁর দর্শনের দরজা খুলে দেওয়া হয়েছে । তাই কেন্দ্রের বিজেপি সরকার এখন ভোট বৈতরণী পার হতে প্রচন্ড এবং আরও বেশি করে আত্মবিশ্বাসী । মানে তাদের এখন "নো চিন্তা নো টেনশন, ওনলি চিল, গোল এন্ড রিক্রিয়েশন" । তাদের এবার স্লোগান "ইস্কি বার চারশো গন্ডি পার" । হয়তো এই স্লোগান এবং আত্ম-বিশ্বাস সম্পূর্ণ মিথ্যায় বা গিমীকে পরিণত হবে না । উপরন্তু খানিক সত্যি সত্যি হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনাই প্রবল ।
এবার মূল কথায় আসা যাক । এদিকে আবার কেন্দ্রীয় বাজেট পেশ হওয়ার কয়েকদিনের মধ্যে অর্থাৎ ৮ই ফেব্রুয়ারী রাজ্য বাজেটও পেশ করা হল । বিভিন্ন দৈনিকে এবং সামাজিক মাধ্যমে এও দেখা গেলো যে, মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দোপাধ্যায় সধবা থেকে বিধবা, আংশিক বা চুক্তিভিত্তিক থেকে স্থায়ী সকলের জন্যই কিছু না কিছু সুযোগ সুবিধা, বেতন বৃদ্ধি ও মহার্ঘভাতার কথা ঘোষণা করলেন । তা অতি উত্তমের কথা এবং প্রশংসনীয়ও বটে । যেহেতু রাষ্ট্রের সকলেরই সুস্থ ও পর্যাপ্ত অন্ন, বস্ত্র ও বাসস্থানের সহিত বেঁচে থাকার অধিকার আছে এবং তার ব্যবস্থা করে দেওয়াও রাজ্য কিংবা রাষ্ট্র বা সরকারের সাংবিধানিক দায়িত্ব ও কর্তব্য । এর কারণ আবার সামনেই ভোট বৈতরণী পার হওয়া বলা যায় । সে সব কথা না হয় ছেড়েই দিলাম । সে যাইহোক, কিন্তু রাজ্যের প্রায় ৫০০ কলেজের ১৪ হাজারের মতো "স্টেট এইডেড কলেজ টিচার"দের জন্য সামান্য কিছুর সুযোগ সুবিধাও ঘোষণা করলেন না মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রী তার বাজেটের মাধ্যমে, বেতন বৃদ্ধি তো অনেক দূরের কথা । এই সকল "স্টেট এইডেড কলেজ টিচার"রা যারপরনাই নিযুক্ত প্রতিষ্ঠানে অত্যন্ত নিষ্ঠাবান ও কর্মযোগী । এতদসত্ত্বেও সংখ্যাগরিষ্ঠ এই শিক্ষক শিক্ষিকাদের কথা মুখ্যমন্ত্রীর একটুও মনে পড়লো না । নাকি তিনি ইচ্ছে করেই মনে করলেন না ?
সম্পূর্ণ ব্যক্তিগতভাবে মনেকরি, সরকারের তরফে এদের প্রতি এমন নির্দয় ও অতি বৈষম্যমূলক কিংবা বিমাতৃসুলভ আচরণ চূড়ান্ত অমানবিক ও নীতিহীন কাজ ! কারণ উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষা প্রদান থেকে শুরু করে শিক্ষার সহিত জড়িত যাবতীয় এবং প্রতিষ্ঠানের উন্নতি ও অগ্রগতির জন্য সমস্ত রকমের কাজকর্ম এই সকল শিক্ষক শিক্ষিকারা করে থাকেন । বলতে গেলে তাদের উপর নির্ভর করেই উচ্চ শিক্ষা সংক্রান্ত কলেজগুলির পঠন পাঠন এখনো সুন্দর, স্বাভাবিক, সচল ও প্রতিষ্ঠানে প্রাণ রয়েছে । এদের আবার অধিকাংশরই নেট/সেট/বিএড/এমফিল/পিএইচডি ডিগ্রীও আছে । এছাড়াও শিক্ষার্থীদের সুবিদার্থে এবং শিক্ষার মান উন্নতিকল্পে তারা বিভিন্নভাবে আধুনিক গবেষণামূলক শিক্ষা প্রদান সংক্রান্ত কর্মশালা, শিক্ষাদান পদ্ধতি, সেমিনার, বই প্রকাশ এবং লেখালেখিও করে থাকেন, যাতে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম সাবলীল ও সুন্দরভাবে বিকশিত হতে পারে ও ক্রমে মেধার শ্রীবৃদ্ধি ঘটতে থাকে । যেহেতু শিক্ষক ও শিক্ষাই জাতির মেরুদন্ড সেহেতু এরা কেনো উপযুক্ত সম্মান ও সাম্মানিক (বেতন) থেকে বঞ্চিত হবেন ? এই শিক্ষক শিক্ষিকাদের হাত ধরেই অগণিত মেধাবী শিক্ষার্থী অনবরত তৈরী হয়েছে এবং হচ্ছে । অথচ এদেরকেই অর্থনৈতিক দিক দিয়ে দুর্বল করে রাখা হয়েছে এবং রাখা হচ্ছে । যুক্তিতে তাতে এদের মেধা ও শ্রমের কি কোনোরকম শোষণ হচ্ছে না ? অর্থনৈতিক উন্নতি সামাজিক ও সাম্মানিক (সম্মান) উন্নতির মাপকাঠি । তাই এদের সামাজিক মর্যাদাও সমাজে সঠিকভাবে প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে না । তাছাড়া সুপ্রিম কোর্টের এক রায় ও নির্দেশ "সমকাজে সমবেতন" । সেটা তো মানাই হয় না কোনো রাজ্যে এবং এখানেও । এটা না মানা মানে সংবিধানকেও তো অবমাননা ও বুড়ো আঙ্গুল দেখানো । কারণ সুপ্রিম কোর্ট ভারতের সর্বোচ্চ সাংবিধানিক বিধিবদ্ধ ব্যবস্থা ।
বর্তমানে যে হারে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি পেয়েছে এবং অনবরত পাচ্ছে তাতে করে "স্টেট এইডেড কলেজ টিচার"দের অতি সাধারণভাবেও জীবন-যাপন করা দুরুহঃ হয়ে পড়েছে । জীবনের মান উন্নতি তো "বহুত দূর কি বাত"। মাতাপিতা, স্ত্রী, কন্যা, পুত্র সকলকে নিয়ে একটু সুখে শান্তিতে সংসার চালানোই মুশকিল হয়ে পড়েছে । এর সঙ্গে আবার প্রাকৃতিক নিয়মে অহরহ অসুখবিসুক জড়িয়েই থাকে । অর্থ কষ্টে যথাসময়ে উপযুক্ত চিকিৎসা গ্রহণ করাও সম্ভবপর হয় না । যেহেতু শিক্ষা প্রদানের সহিত জড়িত সেহেতু অন্যদের মতো বিকল্প কাজেও এরা যুক্ত হতে পারেন না । বিকল্প আয়ের রাস্তাও বন্ধ । এতে রাজ্য কিংবা সরকারেরই দুর্নাম এবং অশোভনীয় ব্যাপার । মোট কথা বর্তমানে কলেজগুলিতে স্থায়ী শিক্ষকদের তুলনায় সংখ্যায় এরাই ("স্টেট এইডেড কলেজ টিচার") অধিক । এরাও তো একটু অর্থনৈতিক উন্নতি করে সুখ সমৃদ্ধির মুখ দেখতে চায় । এদেরও তো সখ আহ্লাদ একটু থাকতে পারে । এরা এবং এদের পরিবারও তো ভোট দিতে যায় । এরাও তো ফ্যান ফলোয়ার তৈরী করতে পারেন । এদেরও তো কিছু অনুগামী আছে/আছেন । এদেরও দু' চারটে কথা রাস্তাঘাটের মানুষ শোনেন এবং যারা কিনা ভোটের সময় ভোটও দিতে যান । এই গুরুত্বপূর্ণ কথাগুলি সরকারের ভুলে গেলে কি চলবে ? সামনে কিন্তু রাজ্যে একটা বড় ঝড় বইবে । তার আন্দাজ করাই যায় । এই ঝড়ের মোকাবিলা করতে গেলে "স্টেট এইডেড কলেজ টিচার"-দের কথা আরেকটু গুরুত্ব দিয়ে এবং যত্ন সহকারে ভাবতে হবে মমতা বন্দোপাধ্যায়ের সরকারের ।
![]() |
ছবি: নিজস্ব |
দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি এবং অন্যান্য পরিস্থিতি বিবেচনা করে তাই মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রীর উচিৎ এই মুহূর্তে অতি দ্রুত রাজ্যের ৫০০ খানা কলেজের ১৪ হাজার "স্টেট এইডেড কলেজ টিচার"দের যোগ্যতামান অনুযায়ী বিহার ও আসাম সরকারের মতো সুনির্দিষ্ট বেতন কাঠামো পুনঃর্গঠনের মাধ্যমে সম্পূর্ণরূপে স্থায়ীকরণ করা । আর তা যদি একান্তই অসম্ভব হয় তবে তাদের বেতন ইউজিসি নির্ধারিত হারে কিংবা সুপ্রিম কোর্টের রায় ও নির্দেশের ভিত্তিতে "সমকাজে সমবেতন"-র মাধ্যমে বেতন কাঠামো পুনঃর্গঠন করা । কারণ আবার বলছি উচ্চ শিক্ষা প্রদানে এই সকল শিক্ষক শিক্ষিকাদের অবদান অসামান্য ও অতুলনীয় । শিক্ষা প্রদান করা ছাড়াও এরা শিক্ষা সংক্রান্ত বিভিন্ন কাজে সারা বছর নিযুক্ত থাকেন । সেই তুলনায় তারা যে মাসিক বেতন পান তা দিয়ে ক্রমাগত দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে চলতে হিমশিম খেয়ে যাচ্ছে । সারাবছর হাড়ভাঙ্গা পরিশ্রম বা খাটনি করে যদি জীবনের মান সামান্য উন্নতি ও অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি একটুও না হয় তবে তা রাজ্য কিংবা সরকার কিংবা রাষ্ট্রের পক্ষেই অমঙ্গল, অশোভনীয় ও দৃষ্টিকটূই বৈকি ।
সবশেষে বলবো, চারিদিকে ভোট মরসুম । তার কাঁসর-ঘন্টার প্রতিধ্বনি, কলরব ও হিসেব-নিকেশ শোনা যাচ্ছে চায়ের দোকান থেকে শুরু করে পাঁচতারা শপিং মলে । ২০২৪ শে লোকসভা । ভোটের কথা বিবেচনা করে সরকার কিংবা সকল পার্টির নেতা নেতৃত্বরা শব্দচয়ন করে চলেছেন । পার্টিগুলির ফিরিস্তি চলছে । এই কলরব বা হিসেব-নিকেশ থেকে যেন ১৪ হাজার "স্টেট এইডেড কলেজ টিচার"রা বাদ না পড়ে যান । আমরা সকলেই অবগত সরকারী নীতি নির্ধারণ থেকে শুরু করে যেকোনো আইন প্রণয়ন সব কিছুই ভোট সংখ্যার উপর ভিত্তি করেই করা হয় । বর্তমানে সাধারণ সচেতন ও অসচেতন সকল নাগরিকই তা ভালো করে জানেন । সরকারি স্থায়ী, অস্থায়ী কর্মচারী হয়তো একটু বেশি করে জানেন । তাই রাজ্য কিংবা রাষ্ট্রের সকলেই ভোট ঘোষণা হওয়ার প্রাগমুহূর্তে সরকারের ঘোষণার দিকে চাতক পাখির মতো তাকিয়ে থাকেন । ভোট ঘোষণার পূর্বে সকল ধরণের মানুষের মধ্যেই কিছু না কিছু অধিক সুযোগ সুবিধা সরকারের কাছ থেকে পাওয়ার আশার সঞ্চার হয় । এক্ষেত্রে ১৪ হাজার "স্টেট এইডেড কলেজ টিচার"রাও কিন্তু ব্যতিক্রমী ছিল না এবং এখনো নয় । এরাও মুখ্যমন্ত্রীর দিকে তাকিয়ে ছিলেন এবং এখনো তাকিয়ে আছেন । আপনার ঘোষণার দ্বারা যাতে ভবিষ্যতেও তারা তাকিয়ে থাকতে পারেন তা নিশ্চিত করুন সততার প্রতীক মুখ্যমন্ত্রী । আশাকরি এদের আপনি কখনোই নিরাশ ও হতাশায় আচ্ছন্ন করবেন না, এবং এ বিশ্বাস সঙ্গে রেখেই এদের এই কাকুতি মিনতি এখানে শেষ করা হল । "কিছু পেতে গেলে কিছু দিতেই হয়"- জনপ্রিয় এই বাঙলা প্রবাদ স্বরণ করেই ইতি টানলাম ।
বিঃদ্রঃ সম্পূর্ণ লেখাটি লেখকের ব্যক্তিগত ভাবনা, আশা আকাঙ্খা ও চিন্তার প্রতিফলন । এর সহিত সংবাদ একলব্য বা কোনো সংগঠন কিংবা রাজনৈতিক দলের একেবারেই কোনোরূপ সম্পর্ক নেই । ভালো লাগলে অবশ্যই লাইক, কমেন্ট ও শেয়ার করে বিষয়টি ছড়িয়ে দিয়ে সরকার কিংবা মুখ্যমন্ত্রী মমতা দিদি বা শিক্ষামন্ত্রীর নজরে আনুন ।
লেখক পরিচিতি :
সুফল সরকার
ঠাকুর পঞ্চানন মহিলা মহাবিদ্যালয়, কোচবিহার
1 মন্তব্যসমূহ
ভালো বলেছেন-কিছু পেতে কিছুতো দিতেই হয়।
উত্তরমুছুনThank you so much for your kindness and support. Your generosity means the world to me. 😊