প্রণামের ইচ্ছে মনের মধ্যেই রয়ে যায়, স্নেহাশীষ রয়ে যায় আকাশের বুকে
রামকৃষ্ণ চ্যাটার্জী: সংবাদ একলব্য:-শুভ বিজয়ার প্রীতি ও শুভেচ্ছা। বড়দের প্রনাম। ছোটদের ভালোবাসা।
হারানো সেই দিনের কথা । একটা সময় ছিলো যখন পুজোর ২ মাস আগে থেকে বাবা-মার কাছে জানতে শুরু করতাম " আমরা কবে নতুন জামা কিনতে যাবো ? "
আর বাবা-মা হাসি মুখে বলতো - "আগে পরীক্ষা টা ভালো করে দিয়ে নে তারপর যাবো "
সেই আনন্দে চলতো পরীক্ষার প্রস্তুতি l দিন গুলো দেখতে দেখতে এক সময় পরীক্ষা এসে যেতো। একটা করে পরীক্ষা দিয়ে আসতাম আর মনে মনে হিসাব করতাম আর ৭ টা পরীক্ষা বাকী, ৬ টা পরীক্ষা বাকী l
এই ভাবে চলতে চলতে একদিন নতুন জামা কিনতে বেরোতাম উফ সেদিন কি আনন্দ সেদিন যেনো পৃথিবীর সমস্ত খুশী আমার কাছে এসে ধরা দিচ্ছে। তখন এতো Shopping Mall ছিলো না , ফলে জামা কিনে বাড়ীতে এনেই আমাদের পরিয়ে ট্রায়াল দিয়ে নেওয়া হতো। সে কি আনন্দ।
তখন খালি ভাবতাম মা দুর্গা আসতে এতো দেরী করছে কেনো ? কবে নতুন জামা পরে ঠাকুর দেখতে বেরোবো ?
তখন শুধুই মনে হতো পুজো আসতে কেনো এতো দেরী হচ্ছে । এক সময় পুজোর ছুটি পড়ে যেতো , তারপর এক সময় মহা ষষ্ঠি এসে যেতো। সেই সময় বাবার কাছে বায়না করে ক্যাপ খেলনা বন্দুক কেনা, আর সেগুলো নিয়ে পুজো প্যান্ডেলে চলে যাওয়া। তারপর সেখানেই শুরু হয়ে যেতো চোর-পুলিশ খেলা। রাতে মায়াবী আলোয় ঠাকুর দেখা।
প্রতিবার ঠাকুর দেখতে বেরোবার আগে ঠিক করে বের হতাম আজ যতো রাত হোক আমি ঘুমাবো না , কিন্তু নিদ্রা দেবী ঠিক এসে চোখে ভির জমাতো। আর মা শুধু বার বার বলতো বাবু ঘুমাস না , দেখ এখুনি বাড়ী পৌঁছে যাবো। ধীরে ধীরে কেটে জেতো পুজোর দিন, মায়ের বিদায়, বিজয়া দশমি, গুরুজনদের প্রণাম, নারকেল নাড়ু মিষ্টি। তারপর একসময় স্কুলের ছুটিও শেষ হয়ে আসতো; স্কুলে গিয়ে বন্ধুদের সাথে চলতো কে-কটা ঠাকুর দেখেছি সেই গল্প শোনান।
এই ভাবে চলতে চলতে কবে যেনো উপলব্ধি করলাম আমি/আমরা বড়ো হয়ে গেছি।
আগে ভাবতাম কবে বাবা-মা কে ছেড়ে বন্ধুদের সাথে ঠাকুর দেখতে বেরোব , আজ পুজো প্যন্ডেলের ভীড়ে বাবা-মা'র সেই ছোয়া কে বড্ড মিস করি।
আগে আমার হাত দুটো বাবা-মা র হাত ধরে অসীম নিরাপত্তা পেতো, আজ সেই হাত ধরা রয়েছে গার্লফ্রেন্ডের হাতে।
আজকাল শপিং করতে গিয়ে আমরা সবাই বড্ড খুত খুতে হয়ে পরেছি, কিন্তু আগে পুজোয় পাওয়া একটা নতুন জামা পৃথিবীর সব খুশি কে আমার হাতে এনে দিত। আর আমাদের সেই খুশি দেখে বাবার মনটা খুশিতে ভরে উঠতো। এমন কতো বার বাবাকে বলতে শুনেছি ' আমার তো আগের জামাটা ভালো আছে এই বছর আর কিনবো না '
আমাদের মুখে হাসি ফুটিয়ে তোলার একটা আপ্রান প্রচেষ্টা ।
আজও মা দুর্গা আসেন চারটে দিন বাপের বাড়ীতে কাটিয়ে আবার ফিরে যায় কৈলাস এ।
আজ হয়না বাবা-মার হাত ধরে ঠাকুর দেখা , হয় না বন্ধুদের সাথে হই-হই করে সারা রাত জেগে ঠাকুর দেখা।
দেখা হয়না সেই বন্ধুদের সাথে, জাদের সাথে সারা রাত জেগে ঠাকুর দেখেছি বিরিয়ানি, এগরোল চাউমিন একসাথে বসে খাওয়া সব যেন আজ ঝাপসা একটা পাতা।
বিশ্বাস করো বন্ধু আজ পুজোতে ঠাকুর দেখতে না বেরোলে এতো মন খারাপ হয়না , যতটা মন খারাপ হয় যখন দেখি একদল প্রিয় বন্ধু সারারাত জেগে ঠাকুর দেখে বাড়ী ফিরছে।
আজ ও পুজো আসছে পুজো যাচ্ছে শুধু আমরাই নতুন নতুন সব কি দেখছি, চিনছি জানছি ..
আমরা এক একজন এক এক প্রান্তে থাকি। সুখে দুঃখে পাশে এসে দাঁড়াই। ঝগড়া হয়। মনোমালিন্য হয়। চোখের জলে, অভিমানে কয়েক দশকের বসন্ত পার হয়। কিন্তু ভালোবাসাটুকু রয়ে যায় চিলেকোঠার ঘরে ॥
এখন এক অদ্ভুত সময়ের মধ্যে দিয়ে আমরা চলেছি। একদিকে নতুন প্রজন্ম ধীরে ধীরে শাখা প্রশাখা বিস্তার করছে, অন্যদিকে বিগত প্রজন্মের এক একটি অধ্যায় সমাপ্তির পথে। দেওয়ালের পরিসর ক্রমে ক্রমে ছোটো হচ্ছে প্রিয়জনের ফটোফ্রেমে ॥
হারিয়ে যাচ্ছে সেই সব মানুষেরা যাদের বকুনি শোনার জন্যই মন চাইতো আরো দুষ্টুমি করতে। উৎসবের দিনগুলোয় যাদের ভালোবাসা, আগলে রাখা - আমাদের আবদার আরো বাড়িয়ে দিতো।দিনের শেষে যাদের ভয়ে অষ্টমীর রাতে তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরতাম। আবার পরদিন সকালেই তাদের হাতে 'নতুন ক্যাপ বন্দুক' দেখে ভুলে যেতাম নতুন জামার আনন্দ। সেই মানুষগুলো একে একে বিদায় নিচ্ছে এই রঙ্গমঞ্চ থেকে। যেন উত্তরসূরীদের হাতে তুলে দিয়ে যাচ্ছে নাটকের পরবর্তী অংকের গুরুদায়িত্ব ॥
আমরা সকলেই সাধারণ, কিন্তু পরিবারের সদস্যদের মধ্যে খুঁজে পাই সেই অসাধারণ মানুষগুলোকে যারা সামনে থাকলে মনে হয় 'না, আর কোনো চিন্তা নেই, সব ঠিক হয়ে যাবে'॥
আকাশের দিকে তাকিয়ে ছোটরা যখন জিজ্ঞেস করে "ওই দাদুটা ষ্টার হয়ে গেছে তাই না?" - বুঝে পাই না কি উত্তর দেব ॥
যদি তাই হয়, তাহলে কালো আকাশে যখন তারা খসে, সেই 'দাদু' বা 'দিদুন' রা কি ফিরে আসে কোনো নতুন রূপে সেই উত্তর আজও খুঁজে বেড়াই ॥
বছর ঘুরে ফিরে আসে বিজয়া দশমীর বিকেল, কিন্তু ধীরে ধীরে হারিয়ে যাচ্ছে পায়ের সংখ্যা। প্রণামের ইচ্ছে মনের মধ্যেই রয়ে যায়, স্নেহাশীষ রয়ে যায় আকাশের বুকে। তোমরা ভালো থেকো। তাহলেই আমরা ভালো থাকবো ॥
0 মন্তব্যসমূহ
Thank you so much for your kindness and support. Your generosity means the world to me. 😊