হৃদয়ে বাজে শঙ্খধ্বনি-ফিরে দেখা শঙ্খ ঘোষ

হৃদয়ে বাজে শঙ্খধ্বনি-ফিরে দেখা শঙ্খ ঘোষ 




বিশিষ্ট প্রাবন্ধিক, রবীন্দ্র বিশেষজ্ঞ, অধ্যাপক, সাহিত্য সমালোচক সবকিছুকে ছাড়িয়ে শঙ্খ ঘোষের অন্যতম প্রধান পরিচয় তিনি একজন আধুনিক কবি। শক্তি চট্টোপাধ্যায়, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের পরে বাংলা কাব্য সাহিত্যের বৈঠা ও হাল ধরেছিলেন কবি অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত ও শঙ্খ ঘোষ।অলোক রঞ্জন আগেই চলে গেছেন। আজ চলে গেলেন ‘বাবরের প্রার্থনা’র স্রষ্টা শঙ্খবাবু(১৯৩২-২০২১)।করোনা নিয়ে গেল মুক্তচিন্তার প্রতীক; সদাহাস্যময়ী প্রতিবাদী কণ্ঠের এক ব্যতিক্রম চরিত্রকে।যেখানে অন্যায় সেখানেই শিরদাঁড়া খাঁড়া রেখে এগিয়ে গেছেন।শাসক গোষ্ঠীর মধ্যে থেকেও শাসকের বিরুদ্ধে পথে নেমেছেন সিঙ্গুর নন্দীগ্রাম পর্বে।পরবর্তিকালে কামদুনী, পার্কস্ট্রীটের পৈশাচিক অন্যায়ের বিরুদ্ধেও তিনি ছিলেন সামনের সারিতে।

কবির প্রকৃত নাম চিত্তপ্রিয় ঘোষ।বর্তমান বাংলাদেশের বরিশাল জেলায় ১৯৩২ সালে কবির জন্ম। পিতা মনীন্দ্র কুমার ঘোষ মাতা অমলাদেবী। পাবনা জেলা থেকে মাধ্যমিক পাশ করে তিনি কলকাতার প্রেসিডেন্সী কলেজ থেকে স্নাতক এবং কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেন। বঙ্গবাসী কলেজ, সিটি কলেজ, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়, দিল্লী বিশ্ববিদ্যালয় এবং বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি সুনামের সাথে অধ্যাপনা করেছেন।

ছাত্রাবস্থা থেকেই প্রতিবাদী ও স্পষ্টবাদী কবি সাহিত্যচর্চা করলেও কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় থেকে তাঁর কবি প্রতিভা মহীরূহ হতে থাকে। আজীবন তিনি ছিলেন সত্যের পূজারী।সাহিত্য ক্ষেত্রে বিশেষ অবদানের জন্য দেশ বিদেশ থেকে পেয়েছেন নানান সম্মান। পুরস্কার হিসেবে পেয়েছেন- ১৯৭৭ সালে ‘বাবরের প্রার্থনা’র জন্য ‘সাহিত্য একাদেমী’, ১৯৮৯ সালে ‘ধূম লেগেছে হৃদকমলে’র জন্য রবীন্দ্র পুরস্কার, ১৯৯৯ সালে ‘রক্তকল্যাণ’ অনুবাদ করে অনুবাদ সাহিত্যে লাভ করেছেন ‘সাহিত্য একাদেমী’ পুরস্কার। ১৯৯৯ এ বিশ্বভারতী দ্বারা দেশিকোত্তম পুরস্কার প্রদান, ২০১১ সালে ভারত সরকার তাঁকে প্রদান করেন পদ্মভূষণ সম্মান এবং ২০১৬ সালে ভারতীয় সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ পুরস্কার ‘জ্ঞানপীঠ’ অর্জন করেন।

শিশু সাহিত্যে ছিল তাঁর অগাধ পাণ্ডিত্য।কবি যতই বয়স অতিক্রম করেছেন ততোই যেন তিনি শিশু মনো প্রবৃত্তিকে আঁকড়ে ধরে বাঁচতে চেয়েছেন। তাই ২০১৮ তে তিনি নির্মাণ করেন শিশুসাহিত্য ‘আজকে আমার পরীক্ষা নেই’।যার ছত্রেছত্রে শিশু মনস্তত্বের বিভিন্নস্তর ও মনোভাব গুলিই বাস্তবরূপ পেয়েছে। শিশুদের সাথে কবি মন একাত্ম না হলে এত প্রাণদায়ক রচনা সম্ভব নয়। ‘ছোটদের গদ্য’ (২০১৭) পড়তে গেলে আমরা লীলা মজুমদার, সুকুমার রায়কেই যেন ফিরে পাই কবির লেখনীতে। ‘শব্দ নিয়ে খেলা : বানান বিষয়ক বই’ শুধুমাত্র বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের অন্যতম শিশুসাহিত্য হয়েই থাকেনি, তা হয়ে উঠেছে সকল স্তরের বাঙালির ভাষা উচ্চারণ শেখার অন্যতম মৌলিক গ্রন্থ।

স্ব্তন্ত্র্য ভাষা প্রয়োগ ও ভাষাশৈলী গঠনেও তিনি জীবনানন্দ দাশের সমকক্ষ। কাব্যে স্বতন্ত্র্য ভাষার মাধ্যমেই তিনি প্রতিবাদ জানিয়েছেন এবং পাশে দাঁড়িয়েছেন শ্রমজীবি নীপিড়িত মানুষের।দেশভাগকে তিনি দেখেছেন; দেশভাগের শিকার তিনি হয়েছেন। তাই উদ্বাস্তু সমস্যাকে তিনি এড়িয়ে যেতে পারেননি।বার বার তাঁর লেখায় উঠে এসেছে ভিটেমাটি হারানো অসহায় মানুষের আর্তনাদের কথা।

কবিকে নিয়ে বিতর্কও কম হয়নি।কিন্তু কবির কলম চলেছে নির্ভিক গতিতে। তিনি মনে প্রাণে বিশ্বাস করতেন অত্যাচারিত মানুষের সঙ্ঘবদ্ধ ক্ষমতাই অত্যাচারিদের ধ্বংস করবে।কিন্তু করোনাকালের দ্বিতীয় ঢেউ কবিকে আমাদের কাছ থেকে কেড়ে নিল। এই ক্ষতি প্রত্যেকটি বাঙালির, প্রত্যেকটি বাংলা ভাষা প্রেমীর।কবির কলম আর গর্জে উঠবেনা, কিন্তু বাঙালির হৃদয়জুড়ে শঙ্খধ্বনির সুর ও স্বর বাজবে চিরকাল।



প্রতিবেদক- ড. সঞ্জীবন মণ্ডল
গবেষক ও কলামিস্ট
পূর্বাঞ্চলীয় ভাষাকেন্দ্র, ভুবনেশ্বর

Post a Comment

thanks