উত্তরে মিহির দক্ষিনে শুভেন্দু- তৃণমূল কংগ্রেস এই জোর ধাক্কা কতটা সামলে নিতে পারে, তাই নিয়ে উত্তপ্ত রাজ্য রাজনীতি 



কৈলাস বিজয়বর্গীয়ের উপস্থিতিতে সাংসদ নিশীথ প্রামাণিকের হাত ধরে আজ দিল্লীতে বিজেপিতে যোগ দিলেন কোচবিহার দক্ষিণের তৃণমূল বিধায়ক মিহির গোস্বামী। বেশ কিছুদিন থেকেই দলের প্রতি ক্ষোভ উগরে দিচ্ছেলেন তিনি। রবীন্দ্রনাথ ঘোষ, পার্থপ্রতিম রায়ের নেতৃত্বে চলা কোচবিহারের রাজনীতিতে কোণঠাসা হয়ে পড়েছিলেন মিহির গোস্বামী। এমনকি রাজ্য নেতৃত্বও তাঁকে গুরুত্ব দিচ্ছিলেন না বলে অভিযোগ করেন। 

আজ তৃণমূল কগ্রেস থেকে সমস্ত সম্পর্ক ছিন্ন করে বিজেপিতে যোগ দেবার আগে একটি প্রেস বিবৃতি প্রকাশ করেন মিহির গোস্বামী। প্রেস বিবৃতিতে তিনি জানান- 

আজ আমার অর্ধশতাব্দীর রাজনৈতিক জীবনের এক গুরুত্বপূর্ণ সন্ধিক্ষণে এসে দাঁড়িয়েছি। এই বিবৃতির শুরুতেই এক ঝলক পেছনের দিকে তাকাতে চাই। 

শ্ৰীমতী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে রাজনীতি করেছি ১৯৮৯ সাল থেকে। কিন্তু আমার রাজনৈতিক জীবন শুরু সত্তর দশকের গােড়াতেই। ১৯৭৩ সালে কোচবিহার জেলা ছাত্র পরিষদের সভাপতি নির্বাচিত হয়েছিলাম রীতিমত ভােটে জিতেই। তবে মূল কংগ্রেসের হয়ে কাজ শুরু করেছিলাম ১৯৭৪ থেকেই। শহুরে কংগ্রেসি রাজনীতি ছেড়ে প্রত্যন্ত গ্রামীণ রাজনীতিতে মনােনিবেশ করেছিলাম, ফলে অচিরেই বিরােধীদের ক্রোধের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিলাম। ১৯৮৩ সালে তুফানগঞ্জে কাশিরডাঙ্গা গ্রামে দলের মিটিং করতে গিয়ে সিপিএমের ঠ্যাঙ্গাড়ে বাহিনীর আক্রমণের মুখে পড়েছিলাম। অজস্র লাঠির ঘায়ে মৃতপ্রায় অচৈতন্য অবস্থায় পড়ে থাকবার পরে হাসপাতালে ভর্তি করেছিলেন এক পুলিশ কর্মী। প্রায় তিন মাস হাসপাতালে যমে-মানুষে টানাটানির পরে সুস্থ হয়ে রাজনীতিতে ফিরে এসেছিলাম মানুষের ভালবাসাতেই। জেলা জুড়ে সফল হরতাল প্রতিবাদেই তা প্রমাণিত হয়েছিল। 

১৯৮৬ সালে জেলা যুব কংগ্রেসের সভাপতি নির্বাচিত হই। ১৯৮৮ সালে ভেজাল তেলের বিরুদ্ধে আইন অমান্য আন্দোলনে পুলিশের গুলিতে শহীদ হন তিন সহকর্মী বিমান-রবীন-হায়দার। সেদিনের নেতৃত্ব দিতে গিয়ে সাথী হারাবার সেই ব্যাথা আজও মনে বয়ে বেড়াই। সেই আন্দোলন কোচবিহার থেকে ছড়িয়ে পড়েছিল সারা বাংলায়। প্রথমবার প্রদ্যুত গুহ ও দ্বিতীয়বার দলনেত্রীর হাত থেকেই দীঘায় নিয়েছিলাম সেরা জেলা যুব সভাপতি হওয়ার পুরস্কার। ১৯৯৬ সালে কোচবিহার জেলা থেকে একমাত্র গ্রেস বিধায়ক নির্বাচিত হই। এরপরই তৃণমূল কংগ্রেসের প্রতিষ্ঠা এবং আমার যােগদান। ২০১১ সালের প্রবল বাম বিরােধী হাওয়ায় বাংলার পটপরিবর্তন ঘটলেও কোচবিহার দক্ষিণ কেন্দ্রটি তৃণমূলের অধরাই থেকে যায়। ২০১৬ সালের নির্বাচনে নেত্রীর অনুরােধে সেই কোচবিহার দক্ষিণ কেন্দ্র থেকে দাড়িয়ে উনচল্লিশ বছরের অপরাজিত বাম-দুর্গ ভেঙ্গে জিতে আসি, সেই মানুষের ভালবাসাতেই। 

গত ৩ অক্টোবর ২০২০ তারিখে সেই তৃণমূল কংগ্রেসের যাবতীয় সাংগঠনিক দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি ঘােষণার সঙ্গে সঙ্গে এও জানিয়েছিলাম, দলনেত্রীর নির্দেশ পেলে আমি বিধায়ক পদ থেকে ইস্তফা দিতে পারি। কিন্তু গত ৪৫ দিনে সেরকম নির্দেশ আমি দলনেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছ থেকে পাইনি। আর এর আগে আপনারা সবাই লক্ষ্য করেছেন, বেশ কিছু বিধায়ক অন্য দল ছেড়ে তৃণমূল কংগ্রেসে যােগ দিয়েছেন, কিন্তু কেউ তাদের বিধায়ক পদ থেকে ইস্তফা দেননি বা কোথাও তাঁদের বিধায়ক পদ থেকে ইস্তফা দিতে বলা হয়নি, তাঁরা তৃণমূলের বিধায়ক হিসেবেই গণ্য হয়েছেন। কংগ্রেস থেকে তৃণমূলে আসবার সময়ও কাউকে বিধায়ক পদ ছেড়ে আসতে হয় নি। সেই নিয়ম মেনে নিলে বলতে হয়, দল ছাড়লেই বিধায়ক পদ ছাড়তে হবে তার কোনও মানে নেই। তবু দলনেত্রীর নির্দেশ পেলে আমি বিধায়ক পদে ইস্তফা দিতে রাজি আছি। 

রাজনীতিতেও মানুষের সমর্থন সঙ্গে থাকলে ছুৎমার্গ বলে কিছু হয় না। আগেও বলেছি, বাইশ বছর আগে কংগ্রেস ছেড়ে তৃণমূল কংগ্রেসে যােগ দিয়েছিলাম দিদির সঙ্গে হাত মিলিয়ে বাম অপশাসনের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের জন্য। সিপিএম সরকারকে উৎখাত করার জন্য আমাদের নেত্রী বিভিন্ন সময়ে নানা দলের সঙ্গে হাত মিলিয়েছেন, কখনও বিজেপি কখনও কংগ্রেস কখনও ফের বিজেপি ফের কংগ্রেস। পরবর্তীকালে জিতে এসে সিপিএমের বহু নেতাকর্মীদের তিনি কাতারে কাতারে দলে নিয়েছেন। অর্থাৎ কোনও দলই তাঁর কাছে অছুৎ ছিল না। সেই নিয়ম মেনে নিলে ধরে নেব তৃণমূল ছেড়ে অন্য দলে যােগ দেওয়ার মধ্যেও ছুৎ-অছুৎ বলে কিছু থাকে না। 

গত বাইশ বছর ধরে, বিশেষ করে গত দশ বছর তৃণমূল দলের একনিষ্ঠ কর্মী হিসেবে জেলায় দলের মধ্যে বারবার অবহেলিত অপমানিত হয়েছি, দলের রাজ্য নেতৃত্ব তাতে নীরব ও প্রচ্ছন্ন মদত যুগিয়ে গিয়েছেন। দলনেত্রীকে সেসব কথা বারংবার জানিয়েও পরিস্থিতির ইতরবিশেষ হয়নি। আজ সব সহ্যের সীমা অতিক্রম করার সময়ও দেখছি, নেত্রী একইরকমের আশ্চর্য নীরবতা পালন করছেন। সম্ভবত তিরস্কার-বহিস্কারের ক্ষমতাও তাঁর লুপ্ত হয়েছে, দলের চালক সিটে তিনি আর নেই। আজ এই তৃণমূল দলের সঙ্গে যাবতীয় সম্পর্কের অবসান ঘটিয়ে দলের প্রাথমিক সদস্য পদ থেকে ইস্তফা দিলাম।" 


একদিকে উত্তরে মিহির গোস্বামী, অপরদিকে দক্ষিনে শুভেন্দু অধিকারী- একই দিনে দুই শক্তিশালী নেতার তৃণমূলের সাথে সম্পর্ক ত্যাগ রাজ্যরাজনীতিতে বিশেষ গুরুত্ব বহন করবে- যার প্রভাব ২১ এর নির্বাচনে পরবে বলেই রাজনৈতিক অভিজ্ঞ ব্যক্তিদের ধারণা। এখন দেখার তৃণমূল কংগ্রেস এই জোর ধাক্কা কতটা সামলে নিতে পারে।