এক নজরে দিয়াগো মারাদোনা 



সারা বিশ্ব যাকে এক নামে চেনে। মারাদোনা। ফুটবলের রাজপুত্র বলা হয় তাঁকে। বলা হয় ফুটবলের সম্রাট। যার খেলায় মুগ্ধ সারা বিশ্ব। যাকে সর্বকালের সেরা ফুটবলারও বলা হয়। তিনি আর নেই। পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করে পরলোকে পাড়ি দিয়েছেন গতকালই। তবে আপামর বিশ্ব বাসীর কাছে রয়ে গেছে তাঁর স্মৃতি। বিশ্বের অগণিত ভক্ত তাঁর প্রয়াণে শোকস্তব্ধ। শোক প্রকাশ করেছেন কিংবদন্তিরা। 


১৯৬০ সালের ৩০শে অক্টোবর জন্ম গ্রহণ করেন মারাদোনা। আর্জেন্তিনার রাজধানী বুয়েনস এয়ার্সের লানুস শহরের তাঁর জন্ম। তাঁর পুরোনাম দিয়েগো আর্মান্দো মারাদোনা। অত্যন্ত দরিদ্র পরিবারে জন্ম গ্রহণ করেন তিনি। আশপাশের এলাকায় ঘুরে ঘুরে গবাদি পশু বিক্রি করে সংসার চালাতেন তাঁর বাবা। পরে এক রাসায়নিক কারখানায় চাকরি পান। মারাদোনা হলেন ‘চিতরো’ দিয়েগো মারাদোনা এবং ‘দোনা তোতা’ দালমা সালভাদর ফ্রাঙ্কোর পঞ্চম সন্তান।


১০ বছর বয়সে এস্ত্রেয়া রোজার হয়ে খেলেন তিনি। আর্জেন্টিনোস জুনিয়র্সের যুব দল মূল খেলোয়াড় হিসেবেও স্থান লাভ করেন। এরপর ১৯৭৬ সালের ২০ অক্টোবর আর্জেন্টিনোস জুনিয়র্সের হয়ে মারাদোনার অভিষেক হয়। ১৯৮১ সালে বোকায় যোগ দিয়ে ১৯৮২ সালে তিনি প্রথম লীগ চ্যাম্পিয়নশিপ জেতেন।১৯৮২ বিশ্বকাপের পর বার্সেলোনায় যোগ দেন মারাদোনা। ১৯৮৩ সালে স্পেনীয় সুপার কাপ জেতেন। ১৯৮৪ সালে সিরি এ ক্লাব নাপোলিতে যোগ দেন তিনি। মারাদোনার সময়কালে নাপোলির ইতিহাসের সফলতম যুগ। মারাদোনার অধীনে নাপোলি ১৯৮৯–৯০ চ্যাম্পিয়নশিপ জেতে এবং ১৯৮৬–৮৭ ও ও ১৯৮৮–৮৯ মৌসুমে তারা রানার-আপ হয়। নাপোলি একবার কোপা ইতালিয়া জিতে (১৯৮৭) এবং একবার রানার-আপ (১৯৮৯) হয় এবং ১৯৯০ সালে ইতালীয় সুপার কাপ জিতে। ১৯৮৭–৮৮ মৌসুমের সিরি এ-তে মারাদোনা সর্বোচ্চ গোলদাতা ছিলেন। ড্রাগ টেস্টে ধরা পড়ে ১৫ মাসের নিষেধাজ্ঞা থেকে ফিরে ১৯৯২ সালে মারাদোনা নাপোলি ছেড়ে দেন। স্পেনীয় ক্লাব সেভিয়াতে যোগ দেন। এক বছর পর ১৯৯৩ সালে তিনি লিওয়েলস ওল্ড বয়েজের হয়ে খেলেন এবং ১৯৯৫ সালে তিনি বোকা জুনিয়র্সে ফিরে আসেন । 



আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারেও সফল তম ফুটবলার তিনি। ১৯৭৯ সালে ১৮ বছর বয়সে তিনি আর্জেন্টিনার হয়ে ফিফা বিশ্ব যুব চ্যাম্পিয়নশিপে অংশগ্রহণ করেন। চ্যাম্পিয়ন হয় আর্জেন্টিনা। তিনিই একমাত্র খেলোয়াড় যিনি ফিফা অনূর্ধ্ব ২০ বিশ্বকাপ (১৯৭৯) ও ফিফা বিশ্বকাপ (১৯৮৬) উভয় প্রতিযোগিতায় গোল্ডেন বল জিতেছেন। আর্জেন্টিনা জাতীয় ফুটবল দলের হয়ে মারাদোনা টানা চারটি বিশ্বকাপে অংশগ্রহণ করেন। এর মধ্যে ১৯৮৬-এ আর্জেন্টিনা বিজয়ী হয় এবং ১৯৯০-এ হয় রানার-আপ।


মারাদোনা ছিলেন একজন কৌশলী খেলোয়াড়। মারাদোনা ছিলেন একজন বাম পায়ের খেলোয়াড়। মারাদোনার জাদুকরি কিছু রণকৌশলের মধ্যে অন্যতম হল ডান উইংয়ে পূর্ণ গতিতে ড্রিবলিং, প্রতিপক্ষের গোল লাইনে পৌঁছানো এবং সতীর্থদের সঠিক পাস প্রদান। তার আরেকটি জাদুকরি নৈপুণ্য ছিল র‍্যাবোনা, যা হল পায়ের পিছনের অংশ ব্যবহার করে এক ধরনের রিভার্স-ক্রস পাস শট। এছাড়া মারাদোনা ছিলেন একজন বিপজ্জনক ফ্রি কিক গ্রহণকারী।



আর্জেন্টিনার অন্যতম মর্যাদাপূর্ণ সাংস্কৃতিক পুরস্কার হীরক কনেক্স পুরস্কার পান ১৯৯৯ সালে। ২০০০ সালে, মারাদোনা তার আত্মজীবনী Yo Soy El Diego (আমি দিয়েগো) প্রকাশ করেন। ২০০০ সালে, ফিফা মারাদোনাকে শতাব্দীর সেরা খেলোয়াড় নির্বাচিত করে। ২০০২ সালে বিশ্বকাপের সর্বকালের সেরা দলেও জায়গা পান। লন্ডনভিত্তিক সংবাদপত্র দ্য টাইমস তাকে বিশ্বকাপের সেরা দশ জন খেলোয়াড়ের তালিকায় প্রথম স্থান প্রদান করে।২০০৩ সালের ২৬ ডিসেম্বর, আর্জেন্টিনোস জুনিয়র্স মারাদোনার প্রতি সম্মান জানিয়ে তার নামে তাদের স্টেডিয়ামের নামকরণ করে।২০০৩ সালে, মারাদোনা লিবিয়ান ফুটবলার আল-সাদি গাদ্দাফির “কৌশলগত উপদেষ্টা” হিসেবে নিয়োগপ্রাপ্ত হন। ২০০৫ সালের ২২ জুন খেলাধুলা বিষয়ক ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবে বোকা জুনিয়র্সে যোগ দেন তিনি। বোকা জুনিয়র্স ২০০৫ আপের্তুরা, ২০০৬ ক্লাউসুরা, ২০০৫ কোপা সাউদামেরিকানা, ২০০৫ রিকোপা সাউদামেরিকানা জিতে। ২০০৫ সালের ১৫ আগস্ট, আর্জেন্টিনীয় টেলিভিশনের টকশো এর উপস্থাপক হিসেবে মারাদোনার অভিষেক হয়।পুরস্কারবিজয়ী সার্বিয়ান চলচ্চিত্র নির্মাতা এমির কুস্তুরিকা মারাদোনার জীবনের উপর ভিত্তি করে একটি চলচ্চিত্র নির্মাণ করেন। তিনা চলচ্চিত্রটির নামকরণ করেন মারাদোনার নামে। ২০০৬ সালের মে মাসে, মারাদোনা যুক্তরাজ্যের সকার এইডে অংশগ্রহণ করেন। ২০০৬ সালের সেপ্টেম্বরে, মারাদোনা তার বিখ্যাত নীল-সাদা ১০ নম্বর জার্সিতে আর্জেন্টিনা দলের অধিনায়কের দায়িত্ব পালন করেন। এটি ছিল তিন দিনের ইনডোর বিশ্বকাপ প্রতিযোগিতা। 



১৬টি খেলায় জাতীয় দলের অধিনায়ক হিসেবে মাঠে নেমেছেন, যা একটি বিশ্বকাপ-রেকর্ড.। আর্জেন্টিনার হয়ে টানা ২১টি খেলায় মাঠে নামেন মারাদোনা।বিশ্বকাপের ২১টি খেলায় ৮টি গোল করেন এবং অন্য ৮টি গোলে সহায়তা করেন। যার মধ্যে ১৯৮৬ বিশ্বকাপে করেন ৫টি গোল এবং ৫টি সহায়তা।


খেলেই ছাড়েননি তিনি। এরপর যোগ দেন কোচের ভূমিকায়। ২০০৮ সালের ডিসেম্বর থেকে মারাদোনা জাতীয় দলের প্রধান কোচের দায়িত্ব পান।



১৯৭৮ সালে আর্জেন্টিনীয় প্রিমেরা দিভিশনের শীর্ষ গোলদাতা (৫) ছিলেন তিনি। ১৯৭৯-তে ফিফা বিশ্ব যুব চ্যাম্পিয়নশিপ গোল্ডেন বল ও ফিফা বিশ্ব যুব চ্যাম্পিয়নশিপ সিলভার শু, বর্ষসেরা খেলোয়াড় (গুয়েরিন স্পোর্তিভো) হন। ৪ বার ১৯৭৯, ১৯৮০, ১৯৮১, ১৯৮৬ সালে আর্জেন্টিনার বর্ষসেরা ফুটবলার হন তিনি। ১৯৭৯ ও ১৯৮০-তে দক্ষিণ আমেরিকান বর্ষসেরা ফুটবলার নির্বাচিত হন। অলিম্পিয়া দি অরো ২ বার, গুয়েরিন দ'অরো ১বার, অঞ্জে দি ব্রোঞ্জ ২ বার। ১৯৮৬ সালে ফিফা বিশ্বকাপ গোল্ডেন বল , ফিফা বিশ্বকাপ সিলভার বুট, ফিফা বিশ্বকাপ সর্বোচ্চ সহায়তা পুরষ্কার পান। ২বার ফিফা বিশ্বকাপ অল-স্টার ও ২বার অঞ্জে দ'অর পাওয়ার কৃতিত্ব রয়েছে তাঁর। 


আর্জেন্টাইন স্পোর্টস রাইটার্স বর্ষসেরা ক্রীড়াবিদ, ইউনাইটেড প্রেস আন্তর্জাতিক বর্ষসেরা অ্যাথলেট পুরস্কার, ওয়ার্ল্ড সকার পুরস্কার বর্ষসেরা ফুটবলার, দক্ষিণ আমেরিকান বর্ষসেরা খেলোয়াড় (৪), ক্যাপোক্যানোনিয়েরে (সিরি এ সর্বোচ্চ গোলদাতা) পুরষ্কার লাভ করেন। কোপা ইতালিয়া সর্বোচ্চ গোলদাতা, ফিফা বিশ্বকাপ ব্রোঞ্জ বল, অঞ্জে দ'অর (ফরাসি সংবাদপত্র অঞ্জে মন্দিয়াল বর্ষসেরা খেলোয়াড়), ফিফা বিশ্বকাপ অল-টাইম দল, মার্কা লেইয়েন্দা, বিংশ শতাব্দির সেরা দল, ওয়ার্ল্ড সকার বিংশ শতাব্দির সেরা খেলোয়াড়গন লাভ করেন তিনি। 


২০০০ সালে ফিফা শতাব্দির সেরা খেলোয়াড় নির্বাচিত হন। ২০০২-এ ফিফা বিশ্বকাপ ড্রিম টিম, ২০০৪-এ ফিফা ১০০ জীবিত ফুটবলার, ২০১৩-তে ওয়ার্ল্ড সকার সর্বকালের সেরা একাদশ ও নাপোলি সর্বকালের সর্বোচ্চ গোলদাতা মারাদোনা। ফুটবল সেবার জন্য গোল্ডেন বল (ফ্রান্স ফুটবল), আর্জেন্টাইন স্পোর্টস রাইটার্স শতাব্দীর সেরা ক্রীড়াবিদও নির্বাচিত হন। আর্জেন্টিনীয় সিনেট "দমিনগো ফাউস্তিনো সারমিয়েন্তো" জীবনকাল কৃতিত্বের জন্য স্বীকৃতি লাভ করেন।