অসিতাভ দাস
শিক্ষক
জজান কেনারাম উচ্চবিদ্যালয়, মুর্শিদাবাদ
সময় থেমে থাকে না, একথা সর্বৈব সত্য। সময়ের এই দুরন্ত গতির সাথে মানিয়ে নিতে ‘শিক্ষা’ শব্দটি ব্যাপক অর্থে ভাবনার পরিসর কমেছে। শিক্ষা বলতে বর্তমান সমাজ-সংসার প্রথাগত শিক্ষাকেই বুঝে আসছে এবং সেই প্রথাগত শিক্ষা ঘিরেই তার মানসিক গঠন আবর্তিত হচ্ছে। বিশ্বজুড়ে মহামারীর করাল ছায়ায় এই শিক্ষার প্রসার এবং প্রচার বেড়েছে ভার্চুয়াল মাধ্যমে। অভিভাবকগণ থেকে ছাত্রছাত্রী সকলেই এই পাঠদানে এবং পাঠগ্রহণে যারপরনাই খুশি। শহরের নামী ইংরাজী মাধ্যমের বিদ্যালয়গুলি শিক্ষাদানের ডিজিটালাইজেশন করেছে অনেক আগে থেকেই। অডিও-ভিসুয়াল পাঠদানের মধ্য দিয়ে অনেক আগে থেকেই বিদ্যালয়গুলিতে ‘স্মার্ট ক্লাসরুম করেছে। বিদ্যালয়গুলি ব্ৰশিওর-এ ‘স্মার্ট ক্লাসরুম’-এর অস্তিত্বের রমরমা গর্ব করে বড় বড় অক্ষরে প্রকাশ করে থাকে আজকাল। আর অভিভাবকেরা মাছের মত হাঁ করে থাকে।ছিপে টোপ দেওয়াই আছে। সেই টোপ গিলবেন, না গিলবেন না বােঝার আগেই বঁড়শি যায় গেঁথে। আমার বাড়ির ছেলেটি বা মেয়েটি হবে স্মার্ট, কথায় কথায় আওড়াবে ইংরাজী, ম্যানারিসম শিখবে, পাচটা ভালাে বাড়ির ছেলে-মেয়ের সাথে মিশবে, সােশাল নেটওয়ার্কিং-এ চোস্ত হবে। আর স্টেটাস বলেও তাে একটা ব্যাপার আছে। বাংলা মাধ্যম স্কুলে কি আর পড়াশােনা হয়? কারা পড়ে? তাই বাংলা মাধ্যমও আর পিছিয়ে থাকে কেন? শুরু হল ইংরাজী মাধ্যমের পদাঙ্ক অনুসরণ। শিক্ষকদের দু-চার দিন প্রশিক্ষণ দিয়ে বৈতরণী পেরােনাের চেষ্টা চলল। গালভরা নাম দিয়ে K-YAN প্রশিক্ষণে শিক্ষকদের এক্সপার্ট করা হল। বিদ্যালয়ে বিদ্যালয়ে সরকারি উদ্যোগে প্রজেক্টর পাঠানাে হল। বিদ্যালয়ে প্রজেক্টর রুম গঠন হল। আবার সরকারি ঔদাসীন্যে সেই প্রজেক্টরে পুরু ধূলাের আস্তরনও পড়ে রইল।
বয়ােজ্যেষ্ঠ দাদু-ঠাকুরমাদের মুখে প্রায়ই একটা প্রবচন শুনতাম - খাজনার চেয়ে বাজনা বেশী। শিক্ষার এই আধুনিকীকরণের যজ্ঞে বাস্তবেই ‘বাজনা’ বেশী হচ্ছে বলে মনে হয়। যে দেশের প্রাচীন শিক্ষানীতি পাশ্চাত্যের দেশগুলি অনুকরণের চেষ্ঠা করেছে, যে দেশের শিক্ষানীতি একের পর এক উন্নত মেধার জন্ম দিয়েছে, সেই দেশের শিক্ষানীতি ক্রমশ পাশ্চাত্য শিক্ষানীতির উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ছে। আমরা ‘গ্লোবালাইজেশন’- এর নামে নিজেদের দেশীয় শিক্ষা ভুলতে বসেছি। অনেকে বলবেন, এটা হওয়ারই কথা। সময়ের সাথে তাল মিলিয়ে চলার নামই জীবন। কিন্তু সত্যিই কি শিক্ষায় উন্নয়ন হল নাকি অবনমন হল? শুধুমাত্র কেরিয়ারভিত্তিক জীবনের লক্ষ্যে শিক্ষা আত্মকেন্দ্রিক হয়ে পড়ছে। শিক্ষার সর্বাঙ্গীন বিকাশ সেখানে দূরস্ত। বর্তমানে একটি শিশুর পাঠ শুরু হয় কিছু ছন্দবদ্ধ মিনিংলেস ছড়ার মাধ্যমে। সেখানে নীতিশিক্ষার পাঠ ও চর্চার কোনও প্রয়ােজন। বর্তমান শিশুপাঠ্য সিলেবাস অনুভব করে না। শিক্ষার অত্যাধুনিকরণে শিশুরা ইদুর দৌড়ে অভিভাবকদের সন্তুষ্টিকরণে এতটাই বাধ্য যে দলবদ্ধ আউটডাের গেমস্-এর হুজুগ কমেছে। ফলস্বরূপ, ভাল-মন্দের তফাৎ বােঝার ক্ষমতাও কমেছে শিশুদের। ইংরাজী মাধ্যমে একটি ৪ বছরের শিশুকে কম্পিউটারের পাঠ দেওয়া হচ্ছে। বােধবুদ্ধি প্রকাশের আগেই শিশুদের মস্তিষ্কে ঢুকিয়ে দেওয়া হচ্ছে। হাজার রকম অ্যাকটিভিটি। শিশুরাও খুশি, অভিভাবকেরাও খুশি। ভেবে দেখুন তাে, সময়ের আগেই যে ফল আপনি কৃত্রিম পদ্ধতিতে পরিপক্ক করার খেলায় মেতেছেন সেই ফল আদৌ কি সুমিষ্ট হবে? কিন্তু অত ভাবার সময়ই বা কোথায়! এগােতে হবে, সবাই পারছে, সবাই এইভাবেই শিখে নিচ্ছে। যান্ত্রিক শিক্ষার নিয়মগুলি। তবেই তাে সফল কেরিয়ার, তবেই তাে সফল জীবন। বাবা-মায়ের পরিশ্রম সার্থক। একগাল চওড়া হাসি। গর্বে বুকের ছাতি প্রশস্ত।।
শিক্ষার এই চটজলদি প্রসার শিক্ষার মানােন্নয়ন ঘটাতে পারে না। ছাত্র-ছাত্রীদের মধ্যে শিক্ষার গুরুত্ব হয়তাে বাড়ছে, কিন্তু শেখার খিদেটা বড়ড় কমে যাচ্ছে। প্রাচীনকালে গুরুকূলে যে শিক্ষা গুরুর কাছে পাওয়ার জন্য সাধনা করতে হত, যে গুরুর কাছে পৌছানাের জন্য অনেক পরীক্ষার সম্মুখিন হতে হােত, যেখানে গুরু দ্রোণাচার্যের মূর্তি গড়ে একলব্যকে কঠোর সাধনা করতে হত, সেই শিক্ষার স্পষ্টতা এখনকার ভাসা-ভাসা শিক্ষার মধ্যে কোথায়? বর্তমান সমাজে ছাত্র-ছাত্রীদের আন্তরিক প্রচেষ্টায় সে লক্ষণ নেই বলেই শিক্ষক-শিক্ষিকাদের এগিয়ে আসতে হয়। কিন্তু এইভাবে শিক্ষায় উৎকর্ষ সাধন সম্ভব নয়। আপাতদৃষ্টিতে বিভিন্ন অ্যাপ্লিকেশনের মাধ্যমে ইংরাজী মাধ্যম থেকে শুরু করে বাংলা মাধ্যমের বিদ্যালয়গুলি যেভাবে ভার্চুয়াল শিক্ষাদানের সাফল্য তুলে ধরে অভিভাবকদণদের খুশি করার চেষ্টায় মত্ত হয়েছেন তার তাৎক্ষণিক সুফল সুদূরপ্রসারী কুফলে নিমজ্জিত থাকবে। সরকার-বিদ্যালয়অভিভাবক এই শৃঙ্খলকে বুঝতে হবে বিদ্যালয় শুধুমাত্র পাঠদান এবং পাঠগ্রহণের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে না। এখানে শিক্ষার সাথে সাথে ক্রীড়া, সাংস্কৃতিক, বৌদ্ধিক, মানসিক - এককথায় একটি শিশুর সার্বিক বিকাশের পীঠস্থান। তাই বিদ্যালয়ের বিকল্প বিদ্যালয়ই।
অডিও-ভিসুয়াল ক্লাসের ব্যবহার করে বিজ্ঞান বিষয়গুলি পড়ানাে যেতেই পারে। কিন্তু সাহিত্য? মনে রাখতে হবে অডিও ভিসুয়াল ক্লাসের অধিক প্রয়ােগ শিশুদের প্রাকৃতিক প্রবৃত্তিগুলির মধ্যে মূলত কল্পনাশক্তির, চিন্তনের প্রবণতা দ্রুতহারে বিনষ্ট করছে। বিদেশী শিক্ষারীতির যে বীজ ভবিষ্যতে আমাদের দেশ বপন করার চিন্তাভাবনা শুরু করেছে তাতে আখরে সরকারী লাভ থাকলেও শিক্ষার সর্বনাশ হবে এবং মেধার বিচারে ভারতবর্ষ অন্যান্য উন্নতশীল দেশের থেকে ক্রমশ পিছিয়ে যাবে।
0 মন্তব্যসমূহ
Thank you so much for your kindness and support. Your generosity means the world to me. 😊