pic credit: pradiptasarkarfb
সুরশ্রী রায় চৌধুরী, কলকাতাঃ

আমপানের দাপটের পর থেকেই শুরু হয়েছে মানুষের হাহাকার। শুরু হয়েছে সব হারানোর দুঃখ, ক্ষোভ, হতাশা। ঝড় কবলিত এলাকার বাসিন্দাদের সামান্য দাবি (মাথা গোঁজার ছাদ, পানীয় জল,দু বেলার খাবারের যোগান) মিটছে না বহু জায়গায়। ত্রাণ পৌঁছে দেওয়ার কাজে অন্যতম বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে যোগাযোগ ব্যবস্থা। প্রশাসন জানিয়েছে, এর আগে কোনও ঝড়ে এত গাছ পড়েনি। যোগাযোগ ব্যবস্থা এভাবে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় নি।

পথের দু’ধারে নিচু কৃষিজমির আর আলাদা করে অস্তিত্ব নেই। পুরোটাই জলের তলায়। রাস্তার ও কোনো অস্তিত্ব নেই।শুধু জল আর জল। বাঁধ বাঁচানোর জন্য মানুষের লড়াই প্রায় শেষ। হালদারঘেরি-নস্করঘেরি মিলিয়ে প্রায় এক হাজার বিঘে চাষের জমি জলের তলায় চলে গিয়েছে। ধানের জমি তো বটেই, গাছ ভরা উচ্ছে, ঝিঙে, ঢেঁড়শ সবই জলের নীচে। বিঘের পর বিঘে জমি জুড়ে ভাসছে পানের বরজ। বিস্তীর্ণ সেই জমির উপর দিয়ে ঢুকছে জোয়ারের জল। জমি এখন শুধুই নদী। 

বাঁধ ভেঙে কৃষিজমি ভেসে যাওয়ার একই ছবি কুলতলির নদী ঘেঁষা দেউলবাড়িতেও। এখানে মাতলার পাড় ধরে কয়েকশো মিটার বাঁধ পুরোপুরি জলে মিশে গিয়েছে। নোনা জল ঢুকেছে চাষের জমিতে। স্থানীয় বাসিন্দা আব্দুল হকের কথায়, “উচ্ছে, ঝিঙের ফলন হয়েছিল ভালই। দিন দশেকের মধ্যেই বাজারে নিয়ে যাওয়ার কথা ছিল। সে আর হল না। সব শেষ। জানি না, এ জমি আর ফিরে পাব কিনা। পেলেও যে ভাবে নোনা জল ঢুকেছে, তাতে অন্তত বছর দু’য়েক চাষ করা যাবে না।” কৃষিবিজ্ঞানীরাও বলছেন, নোনা জলে ডোবা এই জমি থেকে জল সরলেও, স্বাভাবিক কৃষিকাজ শুরু করা যাবে না এখনই।

নদীবাঁধ ভাঙার পর থেকে একে একে নেতারা এসেছেন। বাঁধ পরিদর্শন করে ফিরেও গিয়েছেন। বিরোধী পক্ষ শাসক দলের মুণ্ডপাত করেছেন। শাসক দল এসে দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়ার আশ্বাস দিয়ে গিয়েছে। স্থানীয় বাসিন্দাদের মতে খাবারের ব্যবস্থা হয় তো হবে। মাথা গোঁজার একটা ঠাঁইও জুটে যাবে এক দিন। কিন্তু নোনা জলে ডোবা বিঘের পর বিঘে এই চাষের জমি আর ফিরবে কি, সেই প্রশ্নই এখন ঘুরপাক খাচ্ছে গ্রামের মানুষের মনে।

সুন্দরবনের সাগরদ্বীপ-সহ বেশ কিছু জায়গার ও একই অবস্থা। এলাকার সঙ্গে যোগাযোগ করা যায়নি। পূর্ব মেদিনীপুরে মোটরবাইকে করে ত্রিপল আনতে হয়েছে পঞ্চায়েত সদস্যকে। ত্রাণ না পৌঁছনোয় বিক্ষোভ বাড়ছে এলাকায় এলাকায়।

ডায়মন্ড হারবার, কাকদ্বীপ, গোসাবা, বাসন্তী, ক্যানিং, সাগরদ্বীপ-সহ দক্ষিণ ২৪ পরগনার বহু এলাকা ঝড়ের পরে কার্যত বিচ্ছিন্ন। সাগরদ্বীপ-সহ বেশ কিছু এলাকায় প্রশাসন জলপথে পৌঁছনোর চেষ্টা করছে। আয়লার অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নিয়ে দক্ষিণ ২৪ পরগনা জেলা প্রশাসন আগে থেকেই বিভিন্ন সরকারি অফিস, পঞ্চায়েত অফিসে ত্রাণ সামগ্রী মজুত করে রেখেছিল। প্রশাসনের বক্তব্য, বাঁধ ভেঙে, রাস্তা ধসে, গাছ পড়ে অবস্থা এমন দাড়িয়েছে যে ১০ কিলোমিটার দূরের গ্রামেও ত্রাণ পৌঁছনো যাচ্ছে না। যদিও শনিবার গোসাবা-বাসন্তীর মধ্যে খেয়া পারাপার শুরু হওয়ায় ওই এলাকায় ত্রাণ পৌঁছনোর সমস্যা কিছুটা মিটেছে।

হিঙ্গলগঞ্জ, সন্দেশখালির দু’টি ব্লক, হাসনাবাদ-সহ বিভিন্ন এলাকায় বাঁধ ভেঙে যে ভাবে মাইলের পর মাইল জলের তলায়, তাতে পরিস্থিতি কবে শুধরাবে, তা কেউ বলতে পারছেন না। কেওড়াতলিতে গিয়ে দেখা গেল, জলে ভাসছে বাড়িঘর। ইটের উঁচু রাস্তায় দিন কাটছে দুর্গতদের। ত্রিপল, প্লাস্টিক টাঙিয়ে তার নীচেই গরু-ছাগল, মুরগির পাশাপাশি ঠাঁই মিলেছে মানুষজনের।

রাস্তার পাশেই জমা জলে ভাসছে গরু-ছাগলের দেহ। স্থানীয় বাসিন্দারা বলেন, ‘‘দিন যত গড়াচ্ছে, চার দিক থেকে পচা গন্ধ আসছে।’’ তাঁরা জানালেন, বুধবার থেকে শনিবার পর্যন্ত পানীয় জল মেলেনি। রবিবার কিছু জলের পাউচ আসে। তা-ও পর্যাপ্ত নয়। হিঙ্গলগঞ্জ পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতি অর্চনা মৃধা জানান, প্রতিটি পঞ্চায়েত এলাকায় কয়েক হাজার করে জলের পাউচ পাঠানো হচ্ছে। জলের ট্যাঙ্কও পাঠানো হচ্ছে।

বিশপুর পঞ্চায়েত কিছু এলাকায় জল থেকে মরা মাছ তুলে মাটিতে পুঁতে ব্লিচিং ছড়ানোর কাজ শুরু করেছে। হিঙ্গলগঞ্জ ব্লক স্বাস্থ্য আধিকারিক অভিষেক দাঁ বলেন, ‘‘বন্যা কবলিত এলাকায় স্বাস্থ্য শিবির হয়েছে। ওষুধ দেওয়া হচ্ছে।

রাজনীতির পুরনো খেলা মাথা চাড়া দিচ্ছে ইতিউতি। তা নিয়ে অভিযোগ রয়েছে বিস্তর। তবে সব হারানো মানুষগুলোর হা-হুতাশ সব ওই জলে ডুবে যাওয়া ধান-আনাজের জমি ঘিরে।