কোচবিহারের সাহিত্য সাধনায় রবীন্দ্রনাথ : প্রসঙ্গ পরিচারিকা 


rabindra nath coochbehar


- সম্রাট দাস 


‘তোমার পায়ের পাতা সবখানে পাতা 
কোনখানে রাখবো প্রণাম !’ 
-প্রণমি/ দিনেশ দাশ 

‘রবীন্দ্রনাথ’- শুধু নাম নয় মাত্র । রবীন্দ্রনাথ একটা সময়, একটা ইতিহাস । রবীন্দ্রনাথ একটা সংস্কৃতি । জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়ি থেকে যার আলোর ছটা ছড়িয়ে পড়েছে সমস্ত বিশ্বে । রবীন্দ্রনাথ আমাদের অহংকার, আমাদের গর্ব । আর কোচবিহার, তোর্ষা নদীর তীরে অবস্থিত একটা ছোট্ট শহর । কোচবিহার রাজার শহর । বিশ্বসিংহ থেকে যে রাজত্ত্বের শুরু ভারতবর্ষের স্বাধীনতা প্রাপ্তির পর ১৯৪৯ এ পশ্চিমবঙ্গের একটি জেলা হিসাবে আজ সে সুপরিচিত । প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরা রাজার শহরে রবীন্দ্রনাথ কোনদিন আসেননি । তার এই না আসা কোচবিহারের কাছে একটা অপ্রাপ্তিই বটে । 

কোচ রাজ বঁধু সুনীতি দেবীর সাথে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পারিবারিক সম্পর্কের কথা আমরা জানি । রবীন্দ্রনাথ নিজে বলেছেন-‘মহারানীর সঙ্গে আমার সম্বন্ধ এক অংশে পৈত্রিক; এক অংশে ব্যক্তিগত । কেসব চন্দ্র যখন একদিন জোড়াসাঁকোর বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছিলেন তার অনতিকাল পূর্বেই আমার জন্ম । সেই সময়ে মহারানীর মাতৃদেবী আমাকে তার যে ক্রোড়ে লালন করেছিলেন, সেই ক্রোড়েই তার অনেক বৎসর পরে সুনীতি দেবী মাতৃস্নেহ সম্ভোগ করেছেন ...... অবশেষে তিনি যখন স্বামী গৃহে অধিশ্বরী হলেন, কতবার কতদিন তাদের আলিপুরের বাড়িতে, কমলকুটিরে, দার্জিলিংএ তার আতিথ্য লাভ করেছি।’(সূত্রঃ রবীন্দ্র জীবনী, তৃতীয় খন্ড, প্রভাত কুমার মুখোপাধ্যায় ) 

২ য় বর্ষ ১ম সংখ্যায় প্রকাশিত হয় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গান এবং স্বরলিপি 
তৃতীয় বর্ষ ১৩২৫ অগ্রহায়ণ ২৬ কার্ত্তিক প্রকাশিত হয় একটি গান 
চতুর্থ বর্ষ ১ম খন্ডে প্রকাশিত হয় ধার করা বিদ্যা এবং শিক্ষার আদর্শ সন্দর্ভ । 
পঞ্চম বর্ষ ১৩২৭ বঙ্গাব্দে প্রকাশিত হয় রবীন্দ্রনাথের পত্র ‘শান্তিনিকেতনে’ 
অষ্টম বর্ষ ১৩৩০ বঙ্গাব্দে প্রকাশিত হয় বেশ কয়েকটি রচনা , যথা- চীনের প্রতি, রেঙ্গুনে বাঙলা সাহিত্য সম্মিলনে সভাপতির অভিভাষণ, সাহিত্যের কথা, সাহিত্যের মূলতত্ত্ব 

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সেনেট হলের প্রথম বক্তৃতা থেকে অনুলিখিত ‘সাহিত্যের মূলতত্ত্ব’ শিরোনামে একটি লেখা প্রকাশিত হয় পরিচারিকার ৮ম বর্ষ ১ম খন্ড ৪র্থ সংখ্যায় ২৫৮ পৃষ্ঠায় । সেখানে দেখি , মানুষের আত্মার তিনটি রূপ রয়েছে বলে মনে করেন রবীন্দ্রনাথ । I EXIST, I KNOW, I EXPRESS – এই তিন রূপের মধ্যে ‘সাহিত্যের মূলতত্ত্বে’ব্যাখ্যা করা হয়েছে তৃতীয় রূপ তথা ‘I express’ এর । রবীন্দ্রনাথ জানিয়েছেন- ‘প্রকাশের মূলে ঐশ্বর্য । কৃপণতায় প্রকাশ নেই । তাই সত্যম অনন্তম । কোন প্রকাশে সবচেয়ে মুগ্ধ হলাম্‌ ।- অনন্তের ঐশ্বর্যের প্রকাশে এবং আমি ভাগ পাওয়াতে।’ 

এই সেনেট হলেই ২রা মার্চ রবীন্দ্রনাথ যে বক্তৃতা প্রদান করেছিলেন তা শ্রী যুক্ত তারানাথ রায় দ্বারা লিপিবদ্ধ হয়ে ‘সাহিত্যের রসতত্ত্ব’ শিরোনামে একই সংখ্যায় ২৬১ পৃষ্ঠায় প্রকাশিত হয় । মনে হচ্ছে ‘সাহিত্যের মূলতত্ত্ব’ শিরনামের লেখাটিও তারানাথ রায় দ্বারা অনুলিখিত । 

এই সংখ্যাতেই আমরা রবীন্দ্রনাথের আরও একটি গুরুত্ত্বপূর্ন রচনা পাচ্ছি ‘চীনের প্রতি’ শিরোনামে ,যা রেঙ্গুনে চৈনিক অভিনন্দনের প্রতুত্তরে লেখা । 

৩৮৬ থেকে ৩৮৯ পৃষ্ঠা জুড়ে রয়েছে ‘রেঙ্গুনে বাঙলা সাহিত্য সম্মিলনীতে কবি সম্বর্ধনা উপলক্ষেরবীন্দ্রনাথের অভিভাষণ।’ এটি নেহাতই অভিভাষণ নয়, একজন সাহিত্যিকের কাছে যথার্থ প্রাপ্তি কি হওয়া উচিৎ সে বিষয়ে দিক্‌ নির্দেশ রয়েছে – 

‘যারা উপকার করে বা করতে পারে সম্মান তাদেরই পাওনা । আনন্দ দেওয়া যাদের কাজ তাদের প্রাপ্য হচ্ছে প্রীতি । সম্মান জিনিষটাকে খুব মোটা করে ফাঁপিয়ে তোলবার জন্যে তাতে বিস্তর ভেজাল চলে । যত রঙ মশাল জ্বালাবে, যত ঢাক ঢোল বাজাবে, সম্মানের সমারোহটা ততই আকাশ পূর্ণ করবে । রাজপুত্র আসেন, ঘতা দেকে তিনি খুসি হন। কিন্তু প্রীতি সম্পূর্ন অকৃত্রিম যদি না হয় তাহলে যে আগাগোড়া ঠকানো হ’ল । তাকে বড় আয়তন দিয়ে সেই ঠকাটাতে ত পূর্ণ করা যায় না ...... 

যে পিয়াসী প্রেম চায় সে যে খাঁটি রসটিকেই চায়, পরিমাণের উপর তার মূল্য নির্ভর করেনা।’ 

শুধুমাত্র যে কোচবিহারের সাহিত্যচর্চ্চা ক্ষেত্রে পরিচারিকা পত্রিকায় রবীন্দ্রনাথের লেখা প্রকাশিত হয়েছে তা নয়- এই সময় বেশ কিছু রচনা পরিচারিকা পত্রিকায় প্রকাশিত হয় রবীন্দ্রনাথ কে নিয়ে । রবীন্দ্রচর্চার ক্ষেত্রে কোচবিহারের গুরুত্বও এক্ষেত্রে কোন অংশে কম নয় । এমনি কিছু গুরুত্ত্বপূর্ণ রচনা হচ্ছে কমুদরঞ্জন মল্লিকের ‘শান্তিনিকেতনে রবীন্দ্রনাথ’ । কুমুদরঞ্জনের চোখে দেখা শান্তিনিকেতনের রবীন্দ্রনাথ যে অন্য রবি ঠাকুর তাই উঠে এসেছে এই লেখায় –‘...সেই আশ্রমের মালতীর মত শুভ্র মৃদু হাস্যে ‘তুমি আসিয়াছ’ বলিয়া যে অভ্যর্থনা করিলেন তাহাতেই প্রাণ ভরিয়া গেল, একটু হাসিতে এত আদর থাকিতে পারে তাহা ইহার আগে জানি নাই। তারপর আমি প্রণাম করিলে আমার পৃষ্ঠে হাত দিয়া যে আদর করিলেন তাহাই মূর্ত্ত আশীর্ব্বাদের মত আমার মনে হইল । তারপর দুইজনে ভ্রমণ করিতে বাহির হইলাম। কত কথা, কত আলোচনা...’ (৩য় বর্ষ ১০ সংখ্যা, ৬৭৮ পৃষ্ঠা) 

রবীন্দ্রনাথকে জানতে গেলে কুমুদরঞ্জনের এই লেখাটির গুরুত্ত্ব অনেক । 

৪র্থ বর্ষ ২য় খন্ডে ৩য় সংখ্যায় ২২৭ পৃষ্ঠায় শ্রী কৃষ্ণবিহারী গুপ্তের ‘রবীন্দ্র সদনে’ লেখাটিও অনুরূপ সাক্ষাৎকার ধর্মী । এখানে রবীন্দ্রনাথ প্রভাত বাবু এবং লেখকের একটি সাক্ষাৎকার বর্ননা করা হয়েছে । তৎকালীন সময়ে রবীন্দ্র বিরধীতা এবং সেই প্রসঙ্গে রবীন্দ্র ভাবনা সুন্দরভাবে ফুটে উঠেছে লেখাটিতে । ‘রবিবাবু। আমাকেই সবাই আক্রমণ করে কেন বোল দেখি? এ সম্বন্ধে বাঙলা সাহিত্যে আমার আর জুড়ী খুঁজে পাবে না । হেমবাবু, নবীন সেন প্রভৃতি সকলেই বেশ কাটিয়ে গিয়েছেন। আমাকেই সবাই কেমন অসঙ্কোচে গালি দেয়। তোমাদের দু’একজনকে যদি দলে পাওয়া যেত তবু মনটা একটু ভাল থাক্‌ত। পরস্পরের দুঃখ ব্যাথা জানিয়ে কিছু তৃপ্তি পাওয়া যেত।’ (২২৯ পৃষ্ঠা) 

একই সংখ্যায় ‘বিলাত যাত্রী রবীন্দ্রনাথের পত্র’ শিরোনামে একটি পত্র প্রকাশিত হয় । এই লেখাটি বর্তমানে www.http://bichitra.jhttp://bichitra.jdvu.ac.in/manuscript/manuscript_viewer.php?manid=598&mname=BMSF_045 এই লিংকে পাওয়া যাচ্ছে যা বসুমতি পত্রিকায় ১৩৩৬ বঙ্গাব্দে প্রকাশিত বলে উল্লেখ রয়েছে । অথচ তার অনেক আগেই ১৩২৭ বঙ্গাব্দে নবপর্যায় পরিচারিকায় প্রকাশিত হয়েছিল । 

২য় বর্ষ ৫ম সংখ্যায় ৩৪৫ পৃষ্ঠায় রবীন্দ্রনাথের 
‘ওরে সাবধানী পথিক,বারেক 
পথভুলে মর্‌ ফিরে 
খোলা আঁখি দুটো অন্ধ করে দে 
আকুল আঁখির নীরে।’ 
গানটি এবং সেই সাথে দ্বিজেন্দ্রলাল ঠাকুরের তৈরি সুর ও স্বরলিপি প্রকাশিত হয় । এই দ্বিতীয় বর্ষেই ৭ ম সংখ্যায় আরো একটি গান স্বরলিপি সহ প্রকাশিত হয় – 
‘মিশ্র বারোয়াঁ –একতালা । 
আমার মন মানে না (দিন রজনী)! 
আমি কি কথা স্মরিয়া এ তনু ভরিয়া পুলক রাখিতে নারি! 
ওগো কি ভাবিয়া মনে এ দুটি নয়নে উথলে নয়ন-বারি। 
(ওগো সজনি!) 

এই গানটির কথা ও সুর রবীন্দ্রনাথের আর স্বরলিপি তৈরি করেন শ্রীমতী মোহিনী সেনগুপ্তা । 

৪র্থ বর্ষ ১ম সংখ্যায় পৌষ ১৩২৬ বঙ্গাব্দে ১১৫ পৃষ্ঠায় ‘ডালি’ শিরোনামে ৬ টি সন্দর্ভ প্রকাশিত হয় যার মধ্যে ‘ভারতে নারীর অধিকার’ শ্রী যুক্ত জানকীবল্লভ বিশ্বাস এর লেখা , ‘ভারতে নারীর স্থান’ -শ্রী যুক্ত নগেন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায়ের, শ্রী যুক্ত মাধুরী মোহন মুখোপাধ্যায়ের ‘বট’, শ্রী যুক্ত রাজেন্দ্র কুমার ঘোষের ‘বঙ্গ শিশুর স্বাস্থ’ এবং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘ধারকরা বিদ্যা’ ও ‘শিক্ষার আদর্শ’ প্রকাশিত হয়। অর্থাৎ ‘ডালি’ হচ্ছে এই পাঁচ জন লেখকের ৬ টি সন্দর্ভের একটি সংকলন । তবে রবীন্দ্রনাথের এই লেখাদুটি বিষয়ে কয়েকটি কথা না বললেই নয়। 

প্রথমতঃ ‘ডালি’ র প্রথম সন্দর্ভের শেষে লেখকের নাম ‘-জ’ অর্থাৎ জানকীবল্লভ , দ্বিতীয় লেখায় ‘-ন’ অর্থাৎ নগেন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায় এবং ‘ধারকরা বিদ্যা’ ও ‘শিক্ষার আদর্শ’ লেখা দুটি বাদ দিয়ে বাকি দুটো লেখায় লেখকের নাম রয়েছে । শুধুমাত্র এই দুটি সন্দর্ভের শেষে ‘(শান্তিনিকেতন)’ লেখা রয়েছে । তবে সূচিপত্রে লেখা দুটির লেখক হিসাবে রবীন্দ্রনাথের নাম উল্লেখ রয়েছে । 

দ্বিতীয়তঃ ‘ধারকরা বিদ্যা’ শিরোনামের লেখাটির শুরু হয়েছে ‘শান্তিনিকেতন পত্রিকায় শ্রী যুক্ত রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর মহাশয় লিখিয়াছেনঃ-’ দিয়ে এবং এরপর শুরু হয়েছে মূল লেখাটি । সন্দর্ভের এই ধরনের উপস্থাপন দেখে একটু অস্বাভাবিকই লাগে । 

যতদূর জানা যায়, একমাত্র এই নবপর্যায় পরিচারিকা পত্রিকাতেই রবীন্দ্রনাথের এবং তার সম্পর্কিত লেখা প্রথম প্রকাশিত হয়েছে, কোচবিহারের আর কোন পত্রিকায় রবীন্দ্রনাথ কোন লেখা দেননি । অর্থাৎ কোচবিহারের ইতিহাসে নবপর্যায় পরিচারিকা’ই একমাত্র দলিল- যা কোচবিহারে রবীন্দ্রনাথ কোনদিন না আসার দুঃখটাকে কিছুটা হলেও শান্তি দিয়েছে আপামর রবীন্দ্রপ্রেমী বা রবীন্দ্রানুরাগী কোচবিহার বাসীকে ।


সহায়ক গ্রন্থঃ
1.nabaparjay paricharika vol-1 to vol-9

অন্যান্যঃ
website: bichitra