ডা: অজয় মন্ডল
করোনা ভাইরাস কী ও তার ইতিহাস :
করোনাভাইরাস ১৯৬০-এর দশকে প্রথম আবিষ্কৃত হয়। প্রথমদিকে মুরগির মধ্যে সংক্রামক ব্রঙ্কাইটিস ভাইরাস হিসেবে এটি প্রথম দেখা যায়। পরে সাধারণ সর্দি-হাঁচি-কাশিতে আক্রান্ত রোগীদের মধ্যে এরকম দুই ধরনের ভাইরাস পাওয়া যায়। মানুষের মধ্যে পাওয়া ভাইরাস দুটি ‘মনুষ্য করোনাভাইরাস ২২৯ই’ এবং ‘মনুষ্য করোনাভাইরাস ওসি৪৩’ নামে নামকরণ করা হয়।এরপর থেকে বিভিন্ন সময় ভাইরাসটির আরো বেশ কিছু প্রজাতি পাওয়া যায় যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো ২০০৩ সালে। ‘এসএআরএস-সিওভি’, ২০০৪ সালে ‘এইচসিওভি এনএল৬৩’, ২০০৫ সালে ‘এইচকেইউ১’, ২০১২ সালে ‘এমইআরএস-সিওভি’ এবং সর্বশেষ ২০১৯ সাল চীনে ‘নোভেল করোনাভাইরাস’।
করোনা ভাইরাসটির আরেক নাম ২০১৯-এনসিওভি। এটি এক ধরনের করোনা ভাইরাস। ভাইরাসটির অনেক রকম প্রজাতি আছে, কিন্তু এর মধ্যে মাত্র ৭টি মানুষের দেহে সংক্রমিত হতে পারে।
বিজ্ঞানীরা বলছেন, ভাইরাসটি হয়তো মানুষের দেহকোষের ভেতরে ইতোমধ্যে ‘মিউটেট করছে’, অর্থাৎ গঠন পরিবর্তন করে নতুন রূপ নিচ্ছে এবং সংখ্যাবৃদ্ধি করছে। ফলে এটি আরও বেশি বিপজ্জনক হয়ে উঠতে পারে। বিশেষজ্ঞরা নিশ্চিত করেছেন, এ ভাইরাস একজন মানুষের দেহ থেকে আরেকজন মানুষের দেহে ছড়াতে পারে। এগুলোর মধ্যে অধিকাংশ ভাইরাসের ফলে শ্বাসকষ্টের গুরুতর সংক্রমণ দেখা দেয়।
কতটা ভয়ংকর এই ভাইরাস
এই ভাইরাস মানুষের ফুসফুসে সংক্রমণ ঘটায় এবং শ্বাসতন্ত্রের মাধ্যমেই এটি একজনের দেহ থেকে আরেকজনের দেহে ছড়ায়। সাধারণ ফ্লু বা ঠান্ডা লাগার মতো করেই এ ভাইরাস ছড়ায় হাঁচি-কাশির মাধ্যমে। তবে এর পরিণামে অরগ্যান ফেইলিওর বা দেহের বিভিন্ন প্রত্যঙ্গ বিকল হয়ে যাওয়া, নিউমোনিয়া এবং মৃত্যু ঘটারও আশঙ্কা রয়েছে। এখন পর্যন্ত আক্রান্তদের দুই শতাংশ মারা গেছেন, হয়তো আরও মৃত্যু হতে পারে। তাছাড়া এমন মৃত্যুও হয়ে থাকতে পারে যা চিহ্নিত হয়নি। তাই এ ভাইরাস ঠিক কতটা ভয়ংকর, তা এখনও স্পষ্ট নয়।
এক দশক আগে সার্স (পুরো নাম সিভিয়ার অ্যাকিউট রেসপিরেটরি সিনড্রোম) নামে যে ভাইরাসের সংক্রমণে পৃথিবীতে ৮০০ লোকের মৃত্যু হয়েছিল সেটিও ছিল এক ধরনের করোনা ভাইরাস। এতে আক্রান্ত হয়েছিল ৮ হাজারের বেশি মানুষ। আর একটি ভাইরাসজনিত রোগ ছিল মিডল ইস্টার্ন রেসপিরেটরি সিনড্রোম বা মার্স। ২০১২ সালে এতে মৃত্যু হয় ৮৫৮ জনের।
করোনা ভাইরাসের লক্ষ্মণ কী:
• জ্বর
* অবসাদ
* শুষ্ক কাশি
* শ্বাস কষ্ট
* গলা ব্যাথা
* মাথা ব্যাথা
* প্রচন্ড শ্বাসকষ্ট থেকে অজ্ঞান হয়ে যাওয়া
* হাঁচি
* গায়ে ব্যাথা , গা ম্যাজ ম্যাজ করা
* কিছু রোগীর ক্ষেত্রে উপরোক্ত সকল উপসর্গ দেখা গেলেও জ্বর নাও থাকতে পারে ।
করোনা ভাইরাস সংক্রমণ হলো ফুসফুসের আর প্রধান লক্ষণ হলো, শ্বাস নিতে কষ্ট হওয়া, জ্বর এবং কাশি। বিজ্ঞানীরা বলছেন, ভাইরাসটি শরীরে ঢোকার পর সংক্রমণের লক্ষণ দেখা দিতে প্রায় পাঁচ দিন লাগে। প্রথম লক্ষণ হচ্ছে জ্বর। তারপর দেখা দেয় শুকনো কাশি। এক সপ্তাহের মধ্যে শ্বাসকষ্ট দেখা দেয় এবং তখনই কোনও কোনও রোগীকে হাসপাতালে ভর্তি হতে হয়। রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা যাদের কম তাদের ক্ষেত্রে এই ভাইরাসের সংক্রমন হওয়ার সম্ভাবনা প্রবল । এই সংক্রমনে ফুসফুসে জল জমতেও পারে । ডায়ালেসিসে থাকা রোগীর থেকে ক্যান্সারে আক্রান্ত বা কিডনি বা লিভারের অসুখে ভুক্তভোগীদের খুব সহজেই কাবু করে দিতে পারে এই করোনা ভাইরাস । যা থেকে মৃত্যু পর্যন্তও হতে পারে।
কীভাবে ছড়িয়েছে এই ভাইরাস :
মধ্য চীনের উহান শহর থেকে এই রোগের সূচনা। ৩১ ডিসেম্বর এই শহরে নিউমোনিয়ার মতো একটি রোগ ছড়াতে দেখে প্রথম চীনের কর্তৃপক্ষ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাকে সতর্ক করে। এরপর ১১ জানুয়ারি প্রথম একজনের মৃত্যু হয়।
তবে ঠিক কীভাবে এর সংক্রমণ শুরু হয়েছিল, তা এখনও নিশ্চিত করে বলতে পারেরনি বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, সম্ভবত কোনও প্রাণী এর উৎস ছিল। প্রাণী থেকেই প্রথমে ভাইরাসটি কোনও মানুষের দেহে ঢুকেছে এবং তারপর মানুষ থেকে মানুষে ছড়িয়েছে।
করোনা ভাইরাসের ক্ষেত্রে উহান শহরে সামুদ্রিক প্রাণী যেমন বেলুগা জাতীয় তিমি করোনা ভাইরাস বহন করতে পারে। বন্য প্রানী যেমন সাপ ,বাদুর , বন্য মুরগী খরগোস তার সাথে মাছ ও বন্য পশুর লোম মল মুত্র থেকে নোভেল করোনা ভাইরাসের সংক্রমন হয়েছে এমনটা ভাবা হচ্ছে ।
এর চিকিৎসা কী ?
ভাইরাসটি নতুন হওয়াতে এখনই এর কোনও প্রতিষেধক আবিষ্কার হয়নি। এমনকি এমন কোনও চিকিৎসাও নেই, যা এ রোগ ঠেকাতে পারে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ইতোমধ্যে মানুষকে নিয়মিত হাত ভালোভাবে ধোয়া নিশ্চিত করার পরামর্শ দিয়েছে। হাঁচি-কাশির সময় নাক-মুখ ঢেকে রাখা এবং ঠান্ডা ও ফ্লু আক্রান্ত মানুষ থেকে দূরে থাকতে হবে । বহু অংশের মানুষ সার্জিক্যাল মুখোশ পরা শুরু করেছে। তার সাথে মেনে চলুন ।
1. জনকোলাহল বর্জন করুন
2. আক্রান্ত ব্যক্তির থেকে ১ মিটার দুরত্ব বজায় রাখুন ।হ্যান্ডসেক দুরত্ব সংক্রমন ঘটাতে পারে ।
3. আপাতত প্রতিকার হিসেবে এ ভাইরাস বহনকারীদের সংস্পর্শ এড়িয়ে চলুন।
4. বারবার হাত ধোয়া, হাত দিয়ে নাক-মুখ স্পর্শ না করা ও ঘরের বাইরে গেলে মুখোশ পরুন।
5. হাত সবসময় পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখুন বারবার হাত ধুন ।
6. মাছ মাংস ভালো করে সিদ্ধ করে রান্না করে গরম গরম খান
7. সকালের খাবার বিকালে বিকালের খাবার রাতে খাবেন না ।
8. বাসি বা অপরিস্কার অপরিচ্ছন্ন খাবার থেকে বিরত থাকুন ।
9. সবুজ শাক সব্জী প্রচুর পরিমানে খান ।
10. জল প্রচুর মাত্রায় পান করুন।
11. আপনি যদি অসুস্থ হয়ে থাকেন তাহলে মুখোশ পরুন,
12. আর নিজে অসুস্থ না হলেও, অন্যের সংস্পর্শ এড়াতে মুখোশ পরুন।’
13. আক্রান্ত ব্যাক্তিকে আইসোলেশন করুন যতক্ষন না রোগী বিপদমুক্ত হচ্ছে ।
14. বিদেশ থেকে কোনো লোক যদি আপনার এলাকাতে আসে তার সম্বন্ধে খোঁজ খবর নিন । নিকটবর্তী হসপিটালে খবর দিন ।
15. খুব দরকার না হলে বিদেশ ভ্রমন স্থগিত রাখুন ।
16. সব শেষে সর্দি, জ্বর ,কাশি ,গলা ব্যাথা ,গা ব্যাথা তার সাথে শ্বাসকষ্টের সমস্যী হলে নিকটবর্তী চিকিৎসক বা চিকিৎসাকেন্দ্রে যত তাড়াতাড়ি পারবেন যোগাযোগ করুন । সুস্থ থাকুন সবাইকে সুস্থ রাখুন।
Social Plugin