বাঙালির বিজয়া দশমী এবং কিছু প্রসঙ্গ
-ড. শুভদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়
শ্রদ্ধা, ভক্তি, রীতি, রেওয়াজ - সবকিছু মেনে দুর্গা পুজোর পর মহানবমী পেরিয়ে দশমী উপস্থিত। উমা এবার কৈলাসে ফিরবেন। তাই আনন্দের শেষে বিষাদের সুর। কারণ দুর্গাপুজোর শেষ যে বিজয়ার চলে যাওয়ায়। বিজয়া দশমীতে।
বিজয়া দশমী আসলে বিজয়ারই চলে যাওয়া। দেবী পুরাণে আছে - তিনি পদ্ম নামক অসুরকে নিহত করে বিজয়া নামে অভিহিত হন। দেবীর কৈলাসে ফিরে যাওয়ার দশমীর সঙ্গে সংযুক্ত হয়েছে বিজয়া। এই তিথি তাই বিজয় দশমী। কিন্তু দশমীর সঙ্গে বিজয়া কেন? এর উত্তরে বলা হয় যে, মহিষাসুরের সঙ্গে নয় দিন নয় রাত্রি যুদ্ধ করার পর দশম দিনে তাঁর বিরুদ্ধে বিজয় পেয়েছিলেন দেবী দুর্গা। দেবীর সেই বিজয়ই - বিজয়া।
বাস্তবে, মহিষাসুর তিন কল্পে তিনবার দেবীর তিন রূপের হাতে নিহত হন। তৃতীয়বার তিনি নিহত হন দেবী দুর্গার হাতে। বামনপুরাণ এবং কালিকাপুরাণ মতে, তৃতীয়বারে দেবী আশ্বিনের কৃষ্ণ চতুর্দশী তিথিতে কাত্যায়নের আশ্রমে দেবতাদের সম্মিলিত তেজ থেকে দশভুজা রূপে আবির্ভূত হন। এই তেজে সম্মিলিত হয় কাত্যায়নের তেজও। দেবী নিজেই কাত্যায়নের কন্যাত্ব স্বীকার করে কাত্যায়নী নামে বিরাজিত হন। দেবীভাগবত থেকে জানা যায় - মহিষাসুর শুক্লাষ্টমীতে দশভুজা দেবী দুর্গার হাতে পরাজিত এবং নিহত হন। কিন্তু অন্য মতও আছে। সেই মতে - আশ্বিনের কৃষ্ণা চতুর্দশীতে ইনি সৃষ্টি হয়ে শুক্লা সপ্তমী, অষ্টমী এবং নবমীতে কাত্যায়নের পুজো গ্রহণের পর দশমীতে মহিষাসুরকে বধ করেন। সেই জন্যই দেবী মহিষাসুরমর্দিনী।
রঘুনন্দন স্মৃতিতে ছটি কল্পের বিধান আছে। এই ছটি কল্প হলো - কৃষ্ণনবম্যাদি কল্প, প্রতিপদাদি কল্প, ষষ্ঠ্যাদি কল্প, সপ্তম্যাদি কল্প, মহাষ্টম্যাদিকল্প, এবং মহানবমীকল্প। বাংলায় ষষ্ঠ্যাদি কল্প প্রচলিত। এই ষষ্ঠ্যাদি কল্পের পুজো চার দিন।
বাংলায় দশমীতে দেবীর বিজয়ই বিজয়া। এই বিজয়ের সঙ্গে বাঙালির অনেক রীতিও জড়িয়ে রয়েছে। যেমন, অনেক বাড়িতে দেবীর দশমীতে পান্তা ভাত, কচুর শাক, চালতার অম্বল দেওয়া হয়। বহু বাড়িতেই প্রথা ছিল অপরাজিতা পুজো সেরে, নীলকণ্ঠ পাখি উড়িয়ে মাকে বিদায় জানানোর। ছিল তোপ দাগা। মহাসমারোহে বিসর্জনের শোভাযাত্রা বের করা। যাত্রাপথে সবার হাতে নানা রকমের ছানার মিষ্টি তুলে দেওয়া - ইত্যাদি। সময়ের সাথে সাথে অনেক প্রথা বজায় রাখা সম্ভব হয়নি। আবার অনেক প্রথা আজও রয়ে গেছে অতীতের পদচিহ্ন ধরে।
অতীতের প্রথা মেনে এখনও দুর্গাকে বিদায়বরণ করা হয় ছানার সন্দেশ দেবীর মুখে দিয়ে। দেবী প্রতিমায় সিঁদুর দেওয়ার পর সেই সিঁদুর তুলে রাখা হয় প্রতিদিনের ব্যবহারের জন্য। দশমীর দিন কোনও কোনও বাড়িতে দুর্গা নাম লেখা হয়, যাত্রাঘট পাতা হয়, জোড়া ইলিশ আনা হয়, আবার লক্ষ্মীপুজোর প্রথম প্রস্তুতি সূচনাও নিয়ে নেওয়া হয়। যাঁদের বাড়িতে দুর্গাপুজো হয় না, সেই রকম বহু পরিবারে নিয়ম আছে - দেবীর বিসর্জন দেখার। প্রচলিত বিশ্বাস - খুব কম করে একটি দেবী প্রতিমার বিসর্জন দেখতেই হয়। এবং তারপর দুর্গা স্মরণ করতে হয়। অনেকে আবার দেবীর বিসর্জনের পর দেবীর বেদিতে বসে দুর্গানাম জপ করেন। তারপর কোনও শুভ কাজে যাত্রার প্রস্তুতি গ্রহণ করেন। আমার প্রপিতামহ ভোলানাথ বন্দ্যোপাধ্যায় ছিলেন তন্ত্র সাধক। শুনেছি এই নিয়ম তিনি আজীবন পালন করেছিলেন। আমার অবশ্য ধারণা - এই নিয়ম এক সময় বহুল প্রচলিত ছিল। আরও একটি নিয়ম ছিল বহু পরিবারে - সেটি হলো দেবীর বিসর্জন পর্ব শেষ হলে বাড়ির মা এবং মাতৃস্থানীয় নারীদের কাপড় উপহার দিয়ে প্রণাম করা।
আর বিজয়া সামনে রেখে সিঁদুর খেলা, কোলাকুলি, মিষ্টিমুখ - সে তো বাঙালির নিজস্বতা। মালপোয়া, লবঙ্গলতিকা, কমলাপুলি, নারকেল নাড়ু, নারকেল ছাপা সন্দেশ, মুগের লাড্ডু, ছানার মুড়কি, নিখুঁতি তো আজও আছে। বহু সংযোজনের এবং বিয়োজনের মাঝখানেও।
0 মন্তব্যসমূহ
Thank you so much for your kindness and support. Your generosity means the world to me. 😊