১২৬২ থেকে নদিয়ার রানাঘাটে পূজিত হচ্ছেন বুড়ো মা
সূচনা সেই ১২৬২ খ্রিষ্টাব্দে। সুতরাং প্রাচীনত্বে এ পুজো হার মানাতে পারে বাংলার অন্য যে কোনও প্রাচীন পুজোকে। নদিয়ার রানাঘাটের ‘বুড়ো মা’-র পুজো তাই এক জীবন্ত ইতিহাস। এই পুজোর সূচনা হয় রামকুমার চক্রবর্তী হাত ধরে। এর পিছনে আছে এক আশ্চর্য স্বপ্নাদেশের কাহিনি।
শোনা যায়, ১২৬২ খ্রিষ্টাব্দে পদব্রজে রাঢ়বঙ্গ ভ্রমণে বের হয়েছিলেন শাস্ত্রজ্ঞ পণ্ডিত রামকুমার চক্রবর্তী। তিনি ছিলেন মা দুর্গার সেবক তো বটেই, সাধকও। ভ্রমণ শেষে যখন তিনি বাড়ি ফিরছেন, সেদিনের ব্রহ্মডাঙা - আজকের রানাঘাটে এসে দেখলেন প্রকৃতিতে শরৎ তার ছায়া ফেলেছে। বেজে উঠেছে আগমনী সুর। জনশ্রুতি, তখনই একদিন দেবী দুর্গার স্বপ্নাদেশ পান মাতৃ সাধক রামকুমার। মাতৃ আরাধনা করার। এর পরই শুরু হয় তোড়জোড়। আশেপাশের পাঁচ বাড়ি থেকে ভিক্ষা করেন তিনি পুজোর আয়োজনের জন্য। সেই ভিক্ষা সম্বল করেই শুরু হয় দেবীর পুজো - যা বুড়ো মার পুজো হিসেবে বিখ্যাত।
সাধক রামকুমার ছিলেন নিঃসন্তান। তাঁর পালিতা কন্যার দুই মেয়ের একজনের বিবাহ হয় মুখোপাধ্যায় পরিবারে। সেই পরিবারই এই পুজোর আয়োজন করতে থাকেন পরবর্তী সময়ে।
এক সময় নদিয়ার রাজা কৃষ্ণচন্দ্র এই দেবীর মাহাত্ম্যের পরিচয় পান। শোনা যায়, এখানে দেবীর প্রত্যক্ষ উপস্থিতির প্রমাণ পেয়ে তিনি এই পুজোর পৃষ্ঠপোষক করতে থাকেন। এ প্রসঙ্গে এই বাড়ির বর্তমান প্রজন্মের প্রতিনিধি সৌরভ শর্মা চৌধুরী বলেন, পূর্বপুরুষদের কাছে শুনেছি - মায়ের চিন্ময়ী রূপ দেখে অভিভূত হয়ে যান কৃষ্ণচন্দ্র। তখন তিনি নাকি প্রতিমার একটি আঙুল কেটে দেখতে চান সত্যিই মা এখানে বিরাজমান কি না। শোনা যায়, তখন নাকি মাতৃ মূর্তির সেই কাটা আঙুল দিয়ে রক্ত ঝরতে থাকে। যা দেখে কৃষ্ণচন্দ্র মায়ের কাছে ক্ষমা চেয়ে নেন এবং তাঁর অগাধ বিশ্বাস জন্মায় বুড়ো মায়ের প্রতি। এরপর কৃষ্ণচন্দ্রই এই মুখোপাধ্যায় পরিবারের সদস্যদের শর্মা চৌধুরী উপাধিতে ভূষিত করেন।
এখানে দেবীর পুজোর আয়োজন শুরু হয় উল্টোরথ থেকে। উল্টোরথের দিন পাটে সিঁদুর মাখিয়ে শুরু হয় প্রতিমা নির্মাণ। চতুর্থীর দিন পাটে ওঠেন সকলের ‘বুড়ো মা’। এর পর পঞ্চমীতে দেবীকে গয়না পরানো হয়। ষষ্ঠী থেকে শুরু হয় পুজো। প্রতিদিনই মায়ের কাছে বিবিধ ভোগ নিবেদিত হয়।
এই পুজোর বিশেষত্ব হলো ধুনো পোড়ানো। দেবীর কৃপায় যাঁদের মনের কামনা পূর্ণ হয় - তাঁরা এই ধুনো পোড়ানোয় অংশগ্রহণ করেন। এছাড়াও এই পুজোর বিশেষত্বয় আছে কাদা খেলা।
এ বাড়ির আরেকটি নিজস্বতা হলো একটি প্রাচীন পারিবারিক পুঁথি মেনে দেবীর আরাধনা। এই তালপাতার পুঁথিটি বহু পুরনো। এই পুঁথিটির প্রসঙ্গে এই পরিবারের প্রবীণ সদস্য শম্ভুনাথ শর্মা চৌধুরী জানান, এই পুঁথিটির বয়স খুব কম করে ৩৫০ বছর বা তার বেশি। এটি একটি মূল পুঁথির অনুলিপি। সেই মূল পুঁথিটি অবশ্য এখন নেই। নষ্ট হয়ে গিয়েছে। এ প্রসঙ্গে পুরাণ গবেষক ড. শুভদীপ বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, এই পুঁথিটি যে যথেষ্ট পুরনো সে বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই। তবে মূল পুঁথিটি পাওয়া গেলে ভালো হতো। কারণ তার লিপি নিশ্চিতভাবে মধ্যযুগের বাংলা লিপির নমুনা হিসেবে গ্রাহ্য হতো।
প্রতিদিনই মায়ের এই পুজোয় অসংখ্য মানুষের ভিড় জমে। দেশ-বিদেশ থেকেও আসেন ভক্তরা। ভক্তদের বিশ্বাস - ‘বুড়ো মা’- প্রতিমুহূর্তে পূর্ণ করেন মনের কামনা।
0 মন্তব্যসমূহ
Thank you so much for your kindness and support. Your generosity means the world to me. 😊