Maa Manasa Puja: মা মনসা পূজা কবে? জানুন মনসা পূজার আদি ইতিহাস
শ্রাবণ মাসের শেষ দিনে হিন্দুধর্মাবলম্বীদের প্রতিটি ঘরে ঘরে সর্পদেবী মনসার পূজা অনুষ্ঠিত হয়। বিষধর সাপের কবল থেকে রক্ষা পেতে এবং জীবনের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে এই পূজা প্রাচীনকাল থেকেই প্রচলিত। কিন্তু কেন এই বিশেষ দিনে মনসা দেবীর পূজা করা হয়, এবং এই পূজার পেছনের ইতিহাস ও তাৎপর্য কী, তা নিয়ে একটি বিস্তারিত আলোচনা নিচে দেওয়া হলো।
সর্প পূজার আদি ইতিহাস:
সৃষ্টির আদিকাল থেকেই সর্প এক বিষধর প্রাণী, যার এক মোক্ষম ছোবলেই প্রাণীর প্রাণহানি ঘটে। এই অধিভৌতিক সংকট থেকে বাঁচতে বিপন্ন মানুষ এককালে সর্পের অধিষ্ঠাত্রী এক দেবীর কল্পনা করেছিলেন, যিনি বঙ্গদেশে কালক্রমে মনসা নামে পরিচিতা হন।
তবে সুপ্রাচীন কাল থেকে ভারতে সর্প পূজা প্রচলিত থাকলেও, সর্প-সংস্কৃতির সূচনা ঘটেছিল আজ থেকে প্রায় ছয় হাজার বছর আগে প্রাচীন মিশরে। পিরামিডের মধ্যে ও অন্যত্র মিশরের রাজা অর্থাৎ ফারাওদের ব্যবহৃত যেসব রাজকীয় সামগ্রী পাওয়া গিয়েছে, তার মধ্যে তাঁদের যে শিরস্ত্রাণ মিলেছে, তাতে সর্পচিহ্নলাঞ্ছিত মুকুটও রয়েছে। উদ্যত ফণা সর্পের এই প্রতিকৃতি মুকুটে শোভিত হওয়ার ফলে ধারণা করা হয় যে মিশরে সর্প-সংস্কৃতি রাজকীয় পৃষ্ঠপোষকতা পেয়েছিল। এছাড়া 'মেডুসা' নামে যে মিশরীয় দেবীর উল্লেখ পাওয়া যায়, তাঁর মূর্তিটি বিস্ময়করভাবে সর্প শোভিত; তিনি গলা, হাত, বাজু, কোমর ও পায়ে যেসব অলংকার ধারণ করে আছেন, সেগুলি একেকটি সাপের আকৃতি।
অন্যদিকে, কেউ কেউ মনে করেন সর্পকে দেবতা হিসেবে পূজা করার রীতি প্রথম চালু হয়েছিল ইউফ্রেটিস নদী তীরবর্তী তুরানি জাতির মধ্যে। এরপর এই জাতির শাখা বিভিন্ন দেশে উপনিবিষ্ট হলে সেইসব অঞ্চলে সর্প পূজা বিস্তৃত হয়।
দেবী মনসার পরিচয় ও জন্ম বিতর্ক:
সর্পের অধিষ্ঠাত্রী দেবী মনসাকে ভারতীয়রা দীর্ঘদিন ধরে পূজা করে আসছেন। এই মনসার দুটি রূপ – লৌকিক এবং পৌরাণিক। কাব্যের প্রমাণে মনসা শিবকন্যা বলে গৃহীত হলেও, অনভিজাত হওয়ায় অভিজাত হিন্দুসমাজ তাঁর পুজো প্রথমে মেনে নেয়নি। একদা তিনি মূলত জেলে ও কৃষকদের মধ্যে পূজিত হতেন।
দেবী মনসার জন্ম সংক্রান্ত অনেক বিতর্ক রয়েছে। কোনো কোনো কবি বলেছেন মনসার জন্ম পদ্মবনে নয়, কেতকী অর্থাৎ কেয়াবনে, এজন্য তার নাম 'কেতুকা'। আবার কেউ বলেছেন মনসা অযোনিসম্ভবা, শিববীর্যে পাতালে তাঁর জন্ম। এই জন্য অনেকেই তাঁকে 'পাতাল-কুমারী' বলে উল্লেখ করেছেন। অর্থাৎ তাঁর এই জন্মের ঘটনাটি আকস্মিক। পিতা শিবের চিত্তচাঞ্চল্যই তার মূল কারণ। সৃষ্টিকালীন এই চাঞ্চল্য ও উদ্বেগ জাতকের জীবনে এনে দিয়েছে অস্থিরতা ও শঙ্কা। তিনি দেব সমাজে সেভাবে গৃহীত হননি। বিমাতা চণ্ডী তাঁর অলৌকিক জন্ম নিয়ে তীব্র বিদ্রুপ করেছেন, মেনে নেননি হরের সংসারে। সুতরাং প্রীতিশূন্য, স্নেহশূন্য একটা জীবন যাপন করতে বাধ্য হয়েছেন মনসা। এর ফলে তাঁর মন ক্রমশ কুটিল, কঠোর ও প্রতিহিংসাপরায়ণ হয়ে উঠেছে। অথচ মনসার মধ্যেও যে কোমল স্বভাব ছিল, স্বামী-সন্তান-সংসারের ভরপুর আকাঙ্ক্ষা ও স্নেহের বুভুক্ষা ছিল – তা বিভিন্ন কাহিনীতে তার যথেষ্ট প্রমাণ আছে।
মনসার সংগ্রাম ও আত্মপ্রতিষ্ঠা:
এই দেবী মনসার জীবনের দুটি দিক প্রবল হয়ে উঠেছে: একটি হলো আপন দুর্ভাগ্যের বিরুদ্ধে লড়াই এবং অপরটি হলো আত্মপ্রতিষ্ঠার উদগ্র বাসনা। এভাবে দেখতে গেলে এই দুটি বিষয়ই পরস্পর সংযুক্ত। তবে এর প্রথমটি ঘটে স্বর্গলোকে, দ্বিতীয়টি ঘটে মর্ত্যে।
একদিকে মনসা এবং চণ্ডী, আবার অন্যদিকে চাঁদ সদাগর এবং মনসার দ্বন্দ্বের কাহিনী লোকমুখে বহুকাল থেকে প্রচলিত। চণ্ডীর ভয়ে মনসাকে শিব ফুলের সাজিতে ভরে নিয়ে বাড়িতে আসেন। অলৌকিক উপায়ে মনসা বোধ হয় পত্রতুল্য হালকা হয়ে গিয়েছিলেন। শিব চণ্ডীকে সাজিতে হাত দিতে বারণ করে চলে গেলেন ইন্দ্র-সদন। চণ্ডী এসে ফুল সরিয়ে মনসাকে দেখে হতবাক হন। স্বামীর চরিত্র জানতেন, শিব ভোগের নিমিত্ত একে এনেছে তা বিবেচনা করে মনসাকে সম্ভাব্য সতীন ভেবে দ্বন্দ্ব শুরু করলেন। ফলস্বরূপ, চণ্ডীর হাত দিয়েই ঘটে – জ্বলন্ত অঙ্গারে মনসার বামচক্ষু কানা হয়ে যায়।
স্বর্গলোকে পাওয়া কষ্ট-যন্ত্রণা, অবজ্ঞা-অপমানের যেন তিনি উসুল করতে চেয়েছেন মর্ত্যলোকে। রাখালদের কাহিনী, হাসান-হোসেন পালা ও চাঁদ বণিকের উপাখ্যানে এই প্রতিশোধ স্পৃহায় উন্মত্ত দেবীকেই দেখি আমরা, যিনি ছলে-বলে-কৌশলে জয়ী হতে চেয়েছেন। নিজের পূজা প্রচারে যিনি একেবারেই নির্বিবেক। হিন্দু লোককথা অনুযায়ী, চাঁদ সদাগর ছিলেন শিবের ভক্ত। মনসা চাঁদের পূজা কামনা করলে শিবভক্ত চাঁদ তাকে প্রত্যাখ্যান করেন। কাহিনীর শেষে দেখা যায় চাঁদ সদাগর মনসার পূজা করতে বাধ্য হন।
শ্রাবণের শেষ দিনে মনসা পূজা:
সেই দিন থেকে আজ পর্যন্ত শ্রাবণ মাসের শেষ দিনে হিন্দুধর্মাবলম্বীদের প্রতিটি ঘরে ঘরে মনসা দেবীর পূজা অনুষ্ঠিত হয়। এই দিনটি মনসার আত্মপ্রতিষ্ঠার জয় এবং মানবজাতির সর্পভয় থেকে মুক্তির প্রতীক হিসেবে পালিত হয়। চাঁদ সদাগরের মাধ্যমে মর্ত্যে মনসার পূজা প্রচলনের এই কাহিনীই শ্রাবণের শেষ দিনে মনসা পূজার মূল কারণ হিসেবে বিবেচিত।
তবে সম্পূর্ণ শ্রাবণ মাস জুড়েই মা মনসার পূজা হয়ে থাকে। নাগপঞ্চমীতে সমগ্র দেশ জুড়েই মা মনসার পূজা অনুষ্ঠিত হয়।
আরও পড়ুন ঃ নাগ পঞ্চমী কবে, ২৭ না ২৮ জুলাই? জানুন সঠিক সময়
0 تعليقات
Thank you so much for your kindness and support. Your generosity means the world to me. 😊