বসন্ত উৎসবের তাৎপর্য ও শ্রীকৃষ্ণের দোলযাত্রা

বসন্ত উৎসবের তাৎপর্য ও শ্রীকৃষ্ণের দোলযাত্রা
photo source: internet


সন্তোষ কুমার দে সরকার: 

আজ বসন্ত পূর্ণিমা। গতকাল পর্যন্ত শীতকাল গণনা করা হ'ত, আজ থেকে বসন্ত কালের শুরু। গোটা ভারত ব্যাপী মানুষ আজ বসন্ত উৎসব উৎযাপনে মুখর হয়ে পড়েছে। বাংলার ক্ষেত্রে এই উৎসবটা একটা ভিন্ন নামের ভিন্ন ভাবনার উৎসব। যা বিহার বা উত্তর প্রদেশের সঙ্গে মেলে না। স্থান ভেদে এই উৎসবটাকে কোথাও হোলি, কোথাও ফগুয়া বলা হয়। বাংলায় কিন্তু একে হোলি বা ফগুয়া কোনটাই বলা হয় না। বাংলায় এই উৎসবটার নাম হলো ' শ্রীকৃষ্ণের দোলযাত্রা। ফগুয়া বা হোলির তুলনায় দোলযাত্রা উৎসবটা নবীন। এর উৎপত্তি পাঁচশো বছর আগে। ফগুয়া বা হোলির সৃষ্টি পৌরাণিক যুগে। আমরা জানি, আমরা পৃথিবীর উত্তর গোলার্ধে বাস করি। আমরা বলতে শুধু বাংলা নয়, গোটা ভারতটাই বিষুবরেখার উত্তরাংশে পড়ে। শুধু ভারত কেন চীন, রাসিয়া, উত্তর আমেরিকা, মধ্য আমেরিকা এবং ক্যারিবিয়ান দ্বীপপুঞ্জ উত্তর গোলার্ধে অবস্হিত। সমগ্র এশিয়া মহাদেশের প্রায় পুরোটাই উত্তর গোলার্ধে অবস্থিত। শুধু তাই নয় দক্ষিণ আমেরিকার এক দশমাংশও উত্তর গলার্ধের মধ্যে পড়ে।

উত্তর গোলার্ধে পূর্ব ফল্গনী নক্ষত্রের অবস্থান কালে পূর্ণিমা তিথি পড়লে মাসটার নাম হয় ফাল্গুন ( সেটা চান্দ্র মাসই হোক কিম্বা সৌর মাসই হোক )। এই পূর্ণিমার আগের রাত্রে বুড়ির ঘর পুড়ানোর রীতি চলে আসছে। বুড়ি হ'লো শীতের প্রতিক। তাই বুড়ির ঘর পোড়ান অর্থ হ'লো শীতকে পুড়িয়ে ছাই করে দেওয়া। এটা হচ্ছে জ্যোতির্বিদ্যাগত ব্যাখ্যা।

ভারতীয় পুরানে হিরণ্যকশিপু নামে এক রাজার নাম উল্লেখ আছে। তার বোনের নাম ছিল হোলিকা। মানুষ খেত এই রাক্ষসী। রাজ্যের মানুষ ক্ষিপ্ত হয়ে পূর্ণিমার আগের রাত্রে এই হোলিকা রাক্ষসীকে ধরে আগুনে পুড়ে মেরেছিল। এই উপলক্ষে রাজ্যের মানুষ আনন্দে যে উৎসবের আয়োজন করেছিল তার নাম ' হোলিকা দাহন উৎসব '। সেই থেকে উত্তর ভারতে পঞ্জাব ও উত্তর প্রদেশের পশ্চিমাঞ্চলে অর্থাৎ এলাহাবাদের পশ্চিমে একে হোলি উৎসব বলা হয়। এই উৎসবের সময় চাঁদ উত্তর ফল্গুনী নক্ষত্রে অবস্থান করে বলে বিহার ও উত্তর প্রদেশের পূর্বাঞ্চলের ( যেখান থেকে ভোজপুরি এলাকা শুরু সেখানকার ) লোকেরা ফগুয়া বলে। কিন্তু বাংলায় এই উৎসবটাকে হোলি বা ফগুয়া কোনটাই বলা হয় না।বাংলায় এই উৎসবকে বলা হয় শ্রীকৃষ্ণের দোলযাত্রা।উত্তর ভারতে হোলি হচ্ছে একটি জাতীয় উৎসব। আর বাংলার উৎসবটা হচ্ছে ধর্মীয় উৎসব। বাংলায় শীত প্রকট ভাবে পড়ে না আর বাংলায়

শীতকালটাও খুব দীর্ঘদিন ব্যাপী থাকেনা তাই বাংলায় বসন্ত উৎসবের মাধুর্য ততটা নেই। বাংলায় শীত চলে গেছে একমাস আগে। শ্রীপঞ্চমী ( সরস্বতী পূজার দিন ) তিথি থেকে বসন্ত কাল শুরু হয়।

আজ থেকে ৫০০ বছর আগে শ্রীচৈতন্যদেব বৃন্দাবনে গীয়ে হোলি উৎসব দেখে এসে ভাবলেন বাংলাদেশেও ( অবিভক্ত বাংলায় ) এইধরনের উৎসব হওয়া দরকার। তিনি বললেন, এই দিনে তোমরা কৃষ্ণ মন্দিরে গিয়ে কৃষ্ণকে রঙ- আবীর দেবে। তারপর সেই রঙ আবীর নিয়ে নিজেদের মধ্যে খেলবে।

দোলযাত্রা কথাটি খুব তাৎপর্যপূর্ণ। শীতকাল চলে যাবার সাথে সাথে মানুষের জড়তাও কেটে যায়। মানুষ কর্মচঞ্চল হয়ে ওঠে। সমাজকে গড়ে তোলার জন্য মনে নানা রকম কল্পনা করছে। আবার কৃষ্ণের কথা মনে হতেই মনে দোলা লাগছে । মন দুলছে। শুধু আমার মনই যে দুলছে তা তো নয়, আমার মনের দোলাতে আমি কৃষ্ণের মনকেও দুলিয়ে দিচ্ছি। অর্থাৎ আমার মনের দোলা কৃষ্ণের মনকেও দুদিয়ে দিচ্ছে। এটাই হলো শ্রীকৃষ্ণের দোলযাত্রা। দোলযাত্রার তাৎপর্য হ'ল, যে দোলায় পরমপুরুষ সমগ্র বিশ্বকে দোলাচ্ছেন, যে দোলায় সমগ্র বিশ্ব দুলছে আমিও আমার মনকে সেই দোলায় দুলিয়ে দিতে চাই। দোলযাত্রা শুধু বাংলার উৎসব নয়, দোলযাত্রা শব্দটা ওড়িষ্যা, অসম, মণিপুর, মিথিলা ও বাংলার পঞ্জিকায় স্বীকৃতি পেয়েছে।