১১ ফ্রেব্রুয়ারি শুরু হচ্ছে পলিকা শ্রী শ্রী মনস্কামনা কালী পূজা ও পলিকা মাঘী পূর্নিমা স্নান মেলা।
কী রয়েছে এই মেলার ইতিহাস ? কীভাবে সূত্রপাত এই মেলার ? জানুন বিস্তারিত।
নিজস্ব সংবাদদাতা: তপন বর্মন
কোচবিহার জেলার তুফানগঞ্জ মহকুমার বক্সিরহাট থানার অন্তর্গত সুজলা সুফলা গ্রাম পলিকা। ধর্ম ও সংস্কৃতির অপূর্ব মেলবন্ধনে আজ এই গ্রাম সকলের কাছে অত্যন্ত সুপরিচিত। কৃষিনির্ভর এই পলিকাবাসির মধ্যে যেমন একদিকে রয়েছে ঈশ্বরের প্রতি বিশ্বাস অপরদিকে তেমনি রয়েছে নিজের সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের প্রতি সুগভীর ভালোবাসা । যার অন্যতম নিদর্শন শ্রী শ্রী মনস্কামনা কালী মায়ের পূজা ও স্নান মেলা। সমস্যা জর্জরিত জীবনে উৎসব মুখর এই পলিকা গ্রামের ঐতিহ্যবাহী এই মেলা যেন একমুঠো মুক্তির বাতাস।
এই উৎসবের মহাযজ্ঞ অবিশ্বাস্য হলেও চির সত্য । এই মেলায় দুর দুরান্ত থেকে ছুটে আসা লক্ষ লক্ষ পূর্ণার্থীদের উপচে পড়া ভীড় দেখে মনে হয় এক জন সমুদ্রের মিলন ক্ষেত্র। এই পলিকা মেলাকে কেন্দ্র করে জাতি ধর্ম নির্বিশেষে এক সৌভ্রাতৃত্বের মিলন ক্ষেত্র তৈরি হয় ।
বলতে গেলে উত্তরবঙ্গের জন জীবনে এই মেলার প্রভাব অপরিসীম। শুধু উত্তরবঙ্গ নয় পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের বিভিন্ন জেলা সহ অন্যান্য প্রতিবেশী রাজ্যতেও এই মেলার জাগ্রত মনস্কামনা কালী মায়ের অলৌকিক কাহিনী প্রচলিত। যার দরুন করুণাময়ী মায়ের কাছে লক্ষ লক্ষ মানুষ প্রতি বছর আকুল হৃদয়ে ছুটে আসেন , তাকে দর্শনের আশায়।
প্রতিবছর মাঘী পূর্নিমা তিথি উপলক্ষে পলিকা বিলের ধারে মনস্কামনা মন্দিরে শ্রী শ্রী শক্তি রূপিনী কালী মায়ের পূজা হয়। পূজা শেষে ভোর ৫ টা থেকে শুরু হয় পূণ্যস্নান। লক্ষ লক্ষ পূণ্যার্থী স্নান শেষে মায়ের মন্দিরে পূজা দেন। কেউ মানত করেন, কেউ মানত দিতে আসেন। স্নান ঘাট আর মন্দিরের সম্মুখে জমে যায় ভক্ত বৃন্দের অসম্ভব ভীড় ।
মানুষের মুখে মুখে প্রচলিত মায়ের কাছে প্রার্থনা করলে মা অপুত্রক কে পুত্র দেন, নিঃসন্তান দের সন্তান দেন, দুরারোগ্য ব্যধির থেকে মুক্ত করেন। তাই তো মায়ের কাছ ছুটে আসে অগুণতি ভক্তবৃন্দ।
এবারের পলিকা মেলা শুরু হচ্ছে আগামী ১১ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ ( ২৮ মাঘ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ) মঙ্গলবার মাঘী পূর্ণিমা তিথিতে। ঐদিন পলিকা মাঘীপূর্ণিমা স্নান মেলা প্রাঙ্গণে জাগ্রত মনস্কামনাময়ী শ্রী শ্রী কালী মাতার পূজা অর্চনা , ১২ ফ্রেব্রুয়ারি ২০২৫ ( ২৯ মাঘ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ) বুধবার পূণ্য স্নান মেলা এবং ১৩ ফ্রেব্রুয়ারি ২০২৫ ( ৩০ মাঘ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ) বৃহস্পতিবার এক বিশাল মনোজ্ঞ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান অনুষ্ঠিত হবে।
এখন প্রশ্ন হল কবে এবং কীভাবে হল এই মেলার সূত্রপাত?
এ প্রশ্নের উত্তরে জানা যায়, কোচবিহার জেলার তুফানগঞ্জ মহকুমার ২ নং ব্লকের অন্তর্গত বক্সিরহাট থানার মহিষকুচি ১ নং অঞ্চলে অবস্থিত এই পলিকা শ্রী শ্রী মনস্কামনা কালী মন্দির। আজ থেকে ৭১ বছর পূর্বে ১৯৫৪ সালে তথা১৩৬০ বঙ্গাব্দে এই মন্দির স্হাপিত হয়। জানা যায় দেশ ভাগের পর ওপার বাংলা থেকে চলে আসা কিছু মানুষ সেই সময় এই পলিকা গ্রামে আশ্রয় নেয়, তাদের মধ্যে ছিল দেবনাথ পরিবার। সেই দেবনাথ পরিবারের প্রধান ছিলেন স্বর্গীয় যতীন্দ্রমোহন নাথ । তিনি ছিলেন মা কালীর একনিষ্ঠ ভক্ত। তিনি একদিন রাতে ঘুমের ঘোরে স্বপ্নে কেঁদে ওঠেন। তার কান্না শুনে পরিবারের সকলে তার কাছে ছুটে গেলে তিনি জানান ওপার বাংলায় যে মা কালী কে তারা পূজা করতেন সেই মা তাকে স্বপ্নে দেখা দিয়েছেন এবং এখানে তাকে পূজা করার নির্দেশ দিয়েছেন। এরপর অক্ষয়কুমার নাথ পিতার স্বপ্নাদেশ মাথায় রেখে স্হানীয় লোকজন যেমন পূর্ণচন্দ্র দেবনাথ, মেঘলাল দেবনাথ , গৌরহরি দেবনাথ, যামিনী প্রধান, অর্বেশ্বর বর্মন সহ আরও অনেকে গ্রামবাসী মিলে মায়ের পূজার উদ্যোগ নেন।
সেই সময় সেখানকার অবস্থাপন্ন ব্যক্তি স্বর্গীয়া শ্রীমতী শনি বর্মনের কাছে মায়ের মন্দির স্থাপনের জন্য জমি কেনার প্রস্তাব নিয়ে যান। কিন্তু তিনি এই মহৎ কাজে মন্দির স্হাপনের জমি বিক্রি না করে বরং খুশি হয়ে মন্দির স্হাপনের জন্য ৫ কাঠা জমি এবং ৫ টাকা দান করেন।
জনশ্রুতি আছে বর্তমানে মায়ের মন্দিরের সামনে একটা বহু প্রাচীন পাকুর গাছ আছে। তার পাশেই পলিকা বিল। মা স্বপ্নাদেশ দেন এই স্হানে যাতে তাকে থান দেওয়া হয়। যদিও অনেকের মতে এ স্হানে অনেক আগে মাশান ঠাকুরের ও পাট ছিল।
এরপরে এই জমির উপর নির্মিত হয় মায়ের প্রথম মন্দির। প্রথম দিকে পাটকাঠির বেড়া দিয়ে ঘেরা খড়ের ঘরে মায়ের পূজা হত। পরবর্তীতে চাঁদা তুলে টিনের মন্দির বানানো হয়। তারপর সেটাকে ভেঙে একটা ছাদ পেটানো মন্দির বানানো হয় এবং পরে সেটাকেও ভেঙে ফেলে উঁচু গম্বুজ বিশিষ্ট বর্তমানের মায়ের মন্দিরটি নির্মাণ করা হয়।
প্রথম দিকে এই মেলাকে "পোয়াতির" মেলা বলা হত। যদিও পরবর্তীকালে নাম পরিবর্তিত হয়ে বর্তমানে গ্রামের নাম অনুসারে পলিকা বিলের মেলা নামে খ্যাতি লাভ করেছে।
এ প্রসঙ্গে ওপার বাংলার পোয়াতির মেলার যোগ সূত্র খোঁজার চেষ্টা করলে জানা যায় বাংলাদেশের টাঙ্গাইল জেলায় আজ থেকে ১৫০ বছর আগে থেকেই হয়ে আসছে পোয়াতির মেলা। সেখানেও মাঘীপূর্ণিমা তিথিতে মায়ের পূজা ও পূণ্য স্নানের মেলা বসে। যা মানুষের মুখে মুখে 'ডুবের মেলা' নামে পরিচিত। টাঙ্গাইলের কালিহাতী উপজেলার আউলিয়াবাদ বাজারের পশ্চিম পাশে পোয়াতি বিলে এই মেলা অনুষ্ঠিত হয়।
ডুবের মেলায় হাজারো পুণ্যার্থী ভোর ৫টা থেকে বিকাল ৫টা পর্যন্ত নানা মনোবাসনা পূরণ ও পূণ্যের আশায় এক কাপড়ে স্নান করেছেন।
জানা গেছে, প্রতিবছর কালিহাতী উপজেলার আউলিয়াবাদের পোয়াতি বিলের একটি নির্দিষ্ট স্থানে মাঘী পূর্ণিমায় 'স্নান' অনুষ্ঠিত হয়।
দূরদূরান্ত থেকে পুণ্যার্থীরা পোয়াতি বিলে মানত করে পাপ মোচনের জন্য আসেন। মানত পূরণের জন্য তারা পোয়াতি বিলে স্নান করেন, সাধ্যানুযায়ী মানত (টাকা-পয়সা) বিলের পানিতে ছুড়ে ফেলেন ও স্থানীয় মন্দিরে দান করেন। ওই অনুষ্ঠান উপলক্ষে নানা পসরা সাজিয়ে দোকানপাট ও মেলা বসে। ডুবের মেলায় বসে গ্রামীণ ঐতিহ্যের বাঁশ-বেত, কাঠ-মাটির তৈজস ও আসবাবপত্রের দোকান। এছাড়া বিভিন্ন প্রকার খাবার এবং ছোটদের আকর্ষণীয় খেলনা ও ব্যবহার্য জিনিসপত্রের দোকান।
প্রায় দেড়শ বছর ধরে পোয়াতি বিলে নিঃসন্তান দম্পতিরা সন্তানের আশায় মাঘী পূর্ণিমায় স্নান করে থাকেন। একসময়ের সাধারণ স্নান এখন ব্যাপক জনসমাগমে পরিণত হয়েছে।
দেবনাথ পরিবারের সদস্য টাঙ্গাইল জেলার কস্তুরী পারা থেকে এদেশে দেশ ভাগের সময় চলে আসেন। ভক্ত মাকে ছেড়ে চলে এলেও মা ভক্তকে ছাড়েননি। তাই পলিকা বিলের ধারে মা আবার অধিষ্ঠিত হয়েছেন। বাংলাদেশের ১৫০ বছরের প্রাচীন মেলা পলিকা গ্রামে ৭২ বছর ধরে বিপুল সমারোহে অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে।
বর্তমানে পলিকা গ্রামের এই ঐতিহাসিক মন্দিরটি চারপাশে সবুজ সতেজ কৃষি জমির মাঝখানে মাথা উঁচু করে প্রাচীন ঐতিহ্য বহন করে আসছে। মন্দিরের সামনে রয়েছে একটি বিরাট পুকুর।তার পূর্বে বিশাল আকৃতির পলিকা বিল। মন্দিরের একপাশে রয়েছে শিশু উদ্যান। মন্দিরের পশ্চিম দিকে রয়েছে জমি দাতা শ্রীমতী শনি বর্মন মহাশয়ার মূর্তি। মন্দিরের সামনেই বিরাট পাকুর গাছ। তার নীচে শিব লিঙ্গের অধিষ্ঠান। এছাড়াও রয়েছে একটি শিব মন্দির। মন্দিরের ভেতরে শিবের বিগ্রহ পূজিত হয়।
মূল মন্দিরের রয়েছেন শ্রী শ্রী মনস্কামনা কালী মা। মায়ের মূর্তির পাশে আছেন মা শীতলা, ভগীরথ ও রামপ্রসাদের বিগ্রহ । প্রতি বছর মাঘী পূর্ণিমা তিথিতে এখানে বিরাট স্নানের মেলা বসে । চতুর্দশ তিথিতে পূজা শুরু হয় , আর পূর্ণিমা তিথিতে স্নান। মন্দিরের সামনের বিলে লক্ষ লক্ষ পূণ্যার্থী স্নান করে মায়ের পূজা দেন। পূজার শুরুতেই শিব পূজা করা হয়। এরপর শিতলা মায়ের পূজা হয়। ভোররাতে শ্রী মনস্কামনা কালী মায়ের পূজা। সব শেষে গঙ্গা পূজা। মানুষের বিশ্বাস মায়ের কাছে মানত করতে মা ভক্তের মনস্কামনা পূরন করেন। তাই মায়ের মন্দিরের নাম মনস্কামনা মা কালি মন্দির।
প্রতিবছর পশ্চিমবঙ্গ, আসাম রাজ্যের লক্ষ লক্ষ মানুষ এই মেলায় আসেন। ভক্তরা তাদের মনস্কামনা পূরন হলে সোনা, রূপার অলঙ্কার, পাঠা, কবুতর মাকে উৎসর্গ করেন।
মেলাকে কেন্দ্র করে নানান দোকান যেমন গৃহস্থালী জিনিস পত্র, খেলনা, মিষ্টি, জিলিপি, ফার্স্ট ফুড, রকমারি জিনিস নাগরদোলা প্রভৃতি দোকান বসে। মন্দিরের চারপাশের জমি গুলোতে দোকানপাটে ও মানুষের ভীরে জমজমাট হয়ে থাকে। স্হানীয় পুলিশ প্রশাসন, এন সি সি, পূজা কমিটির স্বেচ্ছাসেবকে কড়া নিরাপত্তায় মোড়া থাকে এই মেলা। জাতি ধর্ম নির্বিশেষে সকল মানুষের মিলন ক্ষেত্রে পরিণত হয় মেলা।
স্নান মেলা ছাড়াও সারাবছর এখানে নিয়মিত পূজা হয়ে থাকে। ভক্তরা সারাবছর পূজা দিতে আসেন। নতুন গাড়ি উদ্বোধন, বিয়ে, ও নানান সামাজিক অনুষ্ঠানে মায়ের পূজা করে ভক্তরা মায়ের কাছে আশীর্বাদ নিতে আসেন।
সর্বোপরি এভাবেই পশ্চিমবঙ্গের প্রান্তিক গ্রাম হিসেবে এই পলিকা গ্রামে অনুষ্ঠিত পলিকা মেলা উত্তর বঙ্গের অন্যতম বৃহত্তম মেলা হিসেবে দীর্ঘ দিন ধরে মানুষের আবেগ, বিশ্বাস আর ঐতিহ্যের প্রতীক হয়ে মানুষের হৃদয়ে স্হান করে নিয়েছে।
0 মন্তব্যসমূহ
Thank you so much for your kindness and support. Your generosity means the world to me. 😊