জেনেনিন 'ভোগা নাগা' বা 'ক্ষেতি লক্ষ্মী' পূজার মূল তত্ত্ব
তপন বর্মন, সংবাদ একলব্য:
লৌকিক দেব দেবীর পূজার পীঠস্থান আমাদের বাংলা। সেই সাথে বিভিন্ন লৌকিক আচার আচরণেও মেতে ওঠে বাঙালি। উত্তরবঙ্গের লোকসমাজে বিশেষত রাজবংশী সমাজের মানুষের মধ্যে বিভিন্ন লৌকিক দেব দেবীর পূজার সাথে সাথে লৌকিক আচার আচরণও লক্ষ্য করা যায়। এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য আশ্বিন মাসের সংক্রান্তি তিথিতে "ভোগা নাগা" বা "ক্ষেতি লক্ষ্মী "পূজা।
"ভোগা নাগা" বা ক্ষেতি লক্ষ্মী পূজার মূল তত্ত্ব.....
মূলত আশ্বিন মাসের সংক্রান্তির দিন সন্ধ্যা লাগার মুহূর্তে এই পূজা হয়ে থাকে। বাড়ির পুরুষ তাদের নিজেদের ধানক্ষেতে " ভোগা" লাগায়। এটি পাটকাঠি কিংবা বাঁশের কাঠির মাথায় তুলার সলতে প্যাঁচিয়ে তাতে ঘি লাগিয়ে নিয়ে ভোগা তৈরি করে। এরপরে সন্ধ্যা হলে তাতে আগুন লাগিয়ে নিয়ে ধানক্ষেতে পুঁতে দিয়ে ক্ষেতি লক্ষ্মীর কাছে ভালো ধানের ফলনের জন্য প্রার্থনা করা হয়। এই সময় কিছু লৌকিক ছিলকা বা শ্লোক চিৎকার করে বলতে থাকে...
১) আশ্বিন কাত্তি ভোগার ডাঙ,
নারা ফাটিয়া বিড়াউক ধান।
২) সগারে ধান টোনা মোনা,
হামার ধান একাশি সোনা।।
৩) সগারে ধান আউল ঝাউল।
আমার ধান সিদায় চাউল।।
৪) সগারে গরু নড়ে চড়ে।
আমার গরু উটিয়া দৌড় মারে।।
৫) পোকা মাকর দূর পালা।
মা লক্ষ্মী খেল খেলা।।
৬) সগারে আন্দুনি নেতলি পেতলি
হামার আন্দুনি খলসার বেটি।।
৭) সগারে ধান হিত্তিহুত্তি
হামার ধান বাড়ির ফিত্তি''।
৮) কাতি গচা লোহার ডাঙ
ছোটো বড়োয় এক সমান।
প্রসঙ্গত, এ দিন এই ভোগা ধানক্ষেতের পাশাপাশি অন্যান্য স্হানেও লাগানো হয়। যেমন পুকুরে, গোয়াল ঘরে, ভীতর বাড়িতে, বাইর বাড়িতে, ঠাকুর পাটে, রান্না ঘরে। স্হান বিশেষে নানান ছিলকা বা শ্লোক চিৎকার করে বলার রীতি আছে। যেমন গোয়াল ঘরে ভোগা লাগিয়ে বলা হয়--
"সগারে গরু নড়ে চড়ে।
আমার গরু উটিয়া দৌড় মারে।।"
রান্না ঘরে ভোগা লাগানোর পর-----
"সগারে আন্দুনি নেতলি পেতলি
হামার আন্দুনি খলসার বেটি।। "
ইত্যাদি।
তবে এই ভোগা লাগানোর রীতি বিভিন্ন স্থানে বিভিন্ন রকমের।
ভোগা লাগানো রীতি কেবলমাত্র আশ্বিন সংক্রান্তিতে নয় কোনো কোনো অঞ্চলে কোজাগরী লক্ষ্মী পূজা ও অমাবস্যা তিথিতে শ্যামা কালী পূজার দিনেও লাগানোর রীতি আছে।
এই পূজা বিভিন্ন স্থানে বিভিন্ন নামে পরিচিত। কোথাও ডাক লক্ষ্মী কোথাও একে ক্ষেতের দেবী "ক্ষেতি লক্ষ্মী" রূপে পূজা করা হয়।
সাধারনত রাজবংশী সমাজের এই পূজা প্রচলিত। তবে বর্তমানে অন্যান্য সম্প্রদায়ের মানুষের মধ্যে এই পূজার প্রচলন লক্ষ্য করা যায়। কোনো কোনো অঞ্চলে এদিন সরিষার খোল ও দেশি লেবুগাছের পাতা ভেজে নিয়ে একসাথে গুড়া করে ধানক্ষেতে ছড়িয়ে দেওয়ারও রীতি আছে।
তবে সুপ্রাচীনকাল থেকে চলে আসা এই রীতির নানান বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা মেলে। অনেকের মতে আশ্বিন মাসের শেষের দিকে সাধারণত ধানের শিষ বের হতে থাকে। এই সময় ধানক্ষেতে এই ধরণের লোকাচার একদিকে যেমন ধানক্ষেতের উপর নজর বাড়ায় , সেই সাথে " ভোগার " আলো বা ধোঁয়া এবং ভোগায় আগুন লাগানোর জন্য খড়ের তৈরি ভোতার ধোঁয়া ধানক্ষেতে ছড়িয়ে থাকা পোকা মাকড় তাড়াতে সহায়তা করে।
কৃষিকাজকে কেন্দ্র করে এই পূজা যদিও আধুনিকতার ছোঁয়ায় লোপ পেয়ে যাচ্ছে , তবুও বলা চলে এর গুরুত্ব অপরিসীম। শারদীয়ার শেষে এই "ভোগা নাগা"র দিনেই যেন মা লক্ষ্মী শুভাগমন ঘটে। নবান্ন উৎসবের সূচনা এই ভোগা নাগা বা ক্ষেতি লক্ষ্মী পূজার হাত ধরেই শুরু হয়।
0 মন্তব্যসমূহ
thanks