উত্তরবঙ্গের রাজবংশী জনসমাজে প্রচলিত মদন কামের পূজা বা বাশঁ পূজা
তপন বর্মন, সংবাদ একলব্য:
উত্তরবঙ্গের রাজবংশী জনসমাজে প্রচলিত বহু পূজা পার্বনের মধ্যে উল্লেখযোগ্য মদন কামের পূজা বা বাশঁ পূজা। গত রবিবার থেকে কোচবিহার জেলার বিভিন্ন স্থানে বিশেষত রাজবংশী মানুষের বাড়িতে বাড়িতে এই বাঁশ পূজা চলছে। এই পূজা রাজবংশী সমাজের এক ঐতিহ্যবাহী পূজা।
এই মদনকাম সম্পর্কে রাজবংশী সমাজে বহু প্রচলিত কাহিনী রয়েছে । এরমধ্যে উল্লেখযোগ্য কাহিনী অনুসারে সতীর দেহ ত্যাগের পর শোকাতুর শিব অসমের নীলাচল পাহাড়ে ধ্যানে মগ্ন হন, তখন কামদেব মহাদেবের হৃদয়ে কামের উদ্রেক করতে গেলে শিবের ত্রিনয়ন থেকে অগ্নি নির্গত হয়ে কামদেব ভস্মীভূত হয়। এরপর স্বামীর জীবন ফিরে পেতে কামদেব পত্নী রতি শিবের কাছে প্রার্থনা করেন এবং কামদেবের পুনর্জন্ম হয়। আর এর ফলে সে স্হানের নাম হয় কামরূপ। পরবর্তী কাল থেকে এই কামরূপ এবং তৎসংলগ্ন অঞ্চলে কামদেব এবং শিবের আরাধনা প্রাধান্য পেয়ে আসছে। যদিও কামদেব বা মদন কামের পূজা কে কেন্দ্র করে আরও নানান কাহিনী প্রচলিত আছে।
মদন কামের পূজা হয় বাশেঁর প্রতিকে। তাই এই পূজা বাঁশ পূজা। সাধারণত চৈত্র বা বৈশাখ মাসের মদন চতুর্দশী তিথিতে মদনদেবের বা বাঁশদেবের পূজা শুরু হয়। এক্ষেত্রে একটি গান রয়েছে...
"ত্রয়োদশীতে বাশত কাপড় চতুর্দশীতূ হোম।
পূর্ণিমাতে বাড়ি বাড়ি বেড়ায় মদনকাম। "
এক্ষেত্রে ত্রয়োদশী থেকেই ভক্তরা বাঁশ কেটে তাকে মাপ মতন কেটে নিয়ে,আগুনে সেঁকে সোজা করে নেয় । এরপর বাঁশ গুলিকে লাল শালুক কাপড়ে জড়িয়ে মাথায় চঙর (চঙর) বেঁধে তুলশী তলায় প্রথিত করা হয় এবং পরের দিন অর্থাৎ চতুর্দশীতে ব্রাহ্মণ এসে হোম যজ্ঞ করে মদন দেবের পূজা পাঠ করে থাকে। কোনও কোনও অঞ্চলে একটা বাঁশ ,আবার কোথাও দুইটা বাঁশ আবার কোথাও কোথাও তিনটি বাঁশ মাটিতে প্রথিত করে পূজা করার প্রচলন রয়েছে। এই দিন থেকে গ্রামে গ্রামে মদনদেবের ভক্তরা "মাগন" গান করে দক্ষিণা তোলেন। বাদ্যযন্ত্র সহযোগে নাচ গানে মদনদেবের মাহাত্ম্য প্রচারিত হয়। মদনদেবের আরাধনা বিষয়ক বহুগান রয়েছে যেগুলো আধ্যাত্মিক এবং চটুল রসাত্মক,যা আজও রাজবংশী জনসমাজে প্রচলিত আছে।
সাধারণত আতপচাল, দুধ, চিনি, আটা দিয়ে তৈরি" বাঁশের নাড়ু" এই পূজার প্রধান প্রসাদ।
এই পূজাকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন স্থানে প্রতিযোগিতা আসর জমে। যেমন বাঁশর দৈর্ঘ্য, বাঁশের দৌড় প্রভৃতির উপর খেলা খুবই জনপ্রিয়।
বাঁশ পূজা বা মদনকাম পূজার সঙ্গে মানুষের সন্তান কামনা তথা বংশবিস্তারের উদ্দেশ্য জড়িত আছে। তার বহু প্রমাণ মেলে বাঁশ পূজার গানে...
" এই বাঁশ পূজিলে কি বা ফল হয়?
এ বাঁশ পূজিলে ধনে পুত্র হয়। "
সর্বোপরি উত্তরবঙ্গ, আসামের মতো বিস্তির্ণ ভৌগোলিক এলাকা জুড়ে অতি প্রাচীন কাল থেকেই বাঁশ গাছ বিস্তার লাভ করে আসছে। প্রাচীন কাল থেকেই বাঁশ মানুষের অতি প্রয়োজনীয় গাছ ,যা মানুষের গৃহ নির্মাণ থেকে গৃহস্থালী জিনিস পত্র সমস্ত কিছুতে ব্যবহৃত হত । সেক্ষেত্রে এই বাঁশের পূজা , বাঁশ সংরক্ষণ, বাঁশ গাছের তথা বাঁশ ঝাড়ের প্রতি যত্নবান হতে কৃষকদের উৎসাহিত করারও একটা পন্থা হতে পারে বলে বিশিষ্ট মহলের ধারনা।
এভাবেই বিশ্বাস ও নিজের সংস্কৃতির প্রতি গভীর ভালোবাসায় রাজবংশী জনসমাজে এই বাঁশ পূজা সুপ্রাচীন কাল থেকে আজও সমাদৃত হয়ে আসছে।
ব্যক্তি ঋণ:
১)কমলেশ সরকার (বঙ্গরত্ন) ।
২) জগদীশ দাস ( শিক্ষক) ।
প্রবন্ধ ঋন: লোক- উৎস (ড. পরিমল বর্মন)
0 মন্তব্যসমূহ
Thank you so much for your kindness and support. Your generosity means the world to me. 😊