বাংলার বাইরে বাংলাচর্চার বর্তমান অবস্থান ও ভবিষ্যত সম্ভাবনা
ড. সঞ্জীবন মণ্ডল
বাঙালি বলতে কী বোঝায়- এই প্রশ্নের উত্তর অনেকটাই জটিল। এখন প্রশ্ন আসতে পারে- বঙ্গভূমিতে যাঁরা বাস করে তাঁরা বাঙালি নাকি পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে যে সমস্ত মানুষ বাংলা ভাষায় কথা বলেন তাঁরা বাঙালি। সেই পরিপ্রেক্ষিতে একথা বলা যেতেই পারেই- জন্মসূত্রে যাঁদের মাতৃভাষা বাংলা অথবা যাঁরা বঙ্গভূমিতে বসবাস করে বাংলার আচার আচরণ রীতিনীতি ইত্যাদি রপ্ত করেছে তাঁরা বাঙালি।যেমন মাদার টেরেসা। জন্মসূত্রে তিনি ভিনদেশী হলেও ভারতীয় নাগরিকত্ব নিয়েছিলেন। একজন ভারতীয় হিসেবে তিনি কলকাতায় জীবনের বেশীরভাগ সময় অতিবাহিত করেছিলেন। তিনি বাংলা ভাষা জানতেন এবং ব্যবহার করতেন। বাংলা ও বাঙালি সংস্কৃতির সঙ্গে নিজেকে একাত্ম করেও নিয়েছিলেন। সেইদিক থেকে তাঁকে আমরা বাঙালি হিসেবে অভিহিত করতে পারি।
তবে বঙ্গভূমিতে বসবাস করলেই যে তিনি বাঙালি হবেন তার কোনো মানে নেই- যদি সেই ব্যক্তি বাঙালি সংস্কৃতির সঙ্গে নিজেকে মানিয়ে নিতে না পারেন বা বাংলা ভাষা লিখতে পড়তে বা বলতে অক্ষম হন; তাঁকে কখনই বাঙালির পর্যায়ে ফেলা যাবেনা। বর্তমানকালে সারা পৃথিবীতে বাঙালি জাতি ও বাংলা ভাষা ছড়িয়ে রয়েছে। ভারতবর্ষের সমস্ত রাজ্যে তো বটেই আফ্রিকা আমেরিকা অস্ট্রেলিয়া এবং এশিয়া মহাদেশের বিভিন্ন জায়গায়ও বাংলা ভাষার রমরমা। সম্প্রতি 'ইউনেস্কো' বাংলা ভাষাকে পৃথিবীর সবচেয়ে মিষ্টি ভাষা বলে চিহ্নিত করেছে। পৃথিবীতে এই ভাষা, কথা বলার নিরিখে পঞ্চম স্থানে রয়েছে।লণ্ডন শহরের দ্বিতীয় ভাষার মর্যাদা অর্জন করেছে বাংলাভাষা। সম্প্রতি অস্ট্রেলিয়ার সংসদেও বাংলাভাষা বিষয়ক বিল পাশ হয়েছে।এমনকি সম্মিলিত জাতিপুঞ্জেও বাংলাভাষা প্রস্তাবিত ভাষার মর্যাদা অর্জন করেছে।
অধ্যাপক আনিসুজ্জামান একটি প্রবন্ধে(২০১৫)বাঙালি বলতে বুঝিয়েছেন-
১. যিনি এই ভূখণ্ডে জন্মগ্রহণ করেছেন, যাঁর মাতৃভাষা বাংলা এবং সেই ভাষায় তিনি কথা বলেন।
২. যিনি বিদেশে জন্ম নিয়েছেন, কিন্তু মাতৃভাষা বাংলা এবং সেই ভাষায় কথা বলেন।
৩. যিনি এই ভূখণ্ডে জন্ম নিলেও যাঁর পূর্বপুরুষ অন্যদেশ থেকে একদা এসেছিল কিন্তু তাঁর মা এবং পরিবার বাংলা ভাষায় কথা বলেন, বাংলার সংস্কৃতিকে নিজের সংস্কৃতি বলে মনে করেন, তিনি বাঙালি।
৪. বিদেশে বাস করছে এমন বাঙালি পরিবারের সন্তান মাতৃভাষা বাংলা হওয়া সত্ত্বেও বিদেশি ভাষায় স্বচ্ছন্দ। বাংলা বলেন না, বাংলা সংস্কৃতির ছায়া মাড়ান না, তিনি কখনও বাঙালি নন।
৫. ক্রমশ পশ্চিমবাংলা বা বাংলাদেশে জন্মগ্রহণ করা সন্তানের একাংশ বাংলা বর্জন করে অন্য সংস্কৃতি এবং ভাষায় আসক্ত হয়ে উঠেছে তাদেরকেও বাঙালি বলা সঙ্গত নয়।
ঐতিহাসিক নীহাররঞ্জন রায় বঙ্গকে কোনো রাজ্য নয়, দেশ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন বলে আমরা তাঁর গ্রন্থ থেকেই জানতে পারি। তবে একথা সত্য যে, কৃষিকাজই ছিল বাঙালির প্রধান জীবিকা। যেহেতু এই বাংলা ছিল নদীমাতৃক তাই তাঁরা কৃষিকাজকেই জীবিকা হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন। কিন্তু বর্তমানে কৃষিকাজের পাশাপাশি পৃথিবীর সবপ্রান্তে এখন বাঙালিদের জয়জয়কার। সাহিত্য-সংস্কৃতি খেলাধূলা ব্যবসা-বাণিজ্য, বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, সব কিছুতেই বাঙালি চলে এসেছে প্রথম সারিতে। তাই আমরা গর্বের সাথে বলতে পারি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এশিয়া মহাদেশের প্রথম ব্যক্তি যিনি ১৯১৩ তে নোবেল প্রাইজ লাভ করে ছিলেন। শুধু তাই নয় নোবেল প্রাইজ বিজেতা অমর্ত্য সেন, মোহম্মদ ইউনুস,অভিজিত ব্যানার্জী প্রমুখ ব্যক্তিগণের মাতৃভাষাও বাংলা। এছাড়াও মাদার টেরেসা ভারতীয় হিসেবে নোবেল পেয়েছেন, তাঁর প্রধান কর্মস্থল ছিল তিলোত্তমা নগরি কলকাতা। এমনকি রোনাল্ড রস ও সিভি রমন কলকাতায় গবেষণা করেই নোবেল পেয়েছেন। যা সমস্ত স্তরের বাঙালির গর্বের বিষয়। ২০১৯ এ অভিজিত ব্যানার্জি নোবেল প্রাইজ লাভ করে বাঙালির মর্যাদাকে আরো উপরের সারিতে নিয়ে গেছেন।
ভারতের জাতীয় সঙ্গীত ‘জনগণমন অধিনায়ক’ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বাংলাভাষাতেই রচনা করেছিলেন। আবার ভারতের জাতীয় স্ত্রোত্র ‘বন্দেমাতরম’ বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় তাঁর আনন্দমঠ উপন্যাসে প্রথম সংযোজন করেছিলেন যা পৃথিবীর প্রত্যকটি বাঙালির গর্বের বিষয়। শুধু তাই নয় বর্তমান বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীত ‘আমার সোনার বাংলা’ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরেরই দান। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা বাংলা ভাষায় রচিত দুটি দেশের জাতীয় সঙ্গীত সকল বাঙালির কাছে অতি গর্বের বিষয়। বাংলা ভাষার জন্যই ইউনেস্কো কর্তৃক আন্তর্জাতিক বিশ্বমাতৃভাষা দিবস উপহার পেয়েছে সারা পৃথিবী যা বাঙালিকে বিশ্বদরবারে প্রতিষ্ঠা করার অন্য একটি ভিত্তি। যার পরিপ্রেক্ষিতে আমরা সংক্ষেপে বলতে পারি বাংলা ভাষার প্রতিষ্ঠার দাবিতে ভারত ও বাংলাদেশে দুটি রক্তক্ষয়ী সংগ্রাম হয়েছে। যার একটি হল ১৯৫২তে বাংলাদেশের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে উর্দুভাষাকে বাতিল করে বাংলাভাষার দাবিতে তৎকালীন পূর্বপাকিস্তানের ছাত্রছাত্রী ও সাধারণ জনগণ আন্দোলন করলে পুলিশের গুলিতে পাঁচজন তরুণ শহিদ হন। আবার আসামের বরাক উপত্যকায় ১৯৬১ সালে বাংলাভাষার দাবীতে জনগন জমায়েত হলে শিলচর রেলস্টেশনের সামনে পুলিশ গুলি চালালে ১১জন আন্দোলনকারী মৃত্যু বরণ করলে ভাষার দাবীতে আন্দোলন সারা পৃথিবীর চিন্তাশীল মানুষের সামনে বাংলা ভাষাকে পরিচয় করে দেয় এবং বলা যায় শুধুমাত্র ভাষার দাবীতে ১০ বছরের ব্যবধানে দুটি আন্দোলন বিশ্বের ভাষাপ্রেমীদের হৃদয়কে নাড়িয়ে দিয়েছিল।শুধু তাই নয়- মানভূম বাংলাভাষা আন্দোলনের কারণেই ১৯৫৬ সালে ভারত সরকার পুরুলিয়া জেলাকে বিহার থেকে আলাদা করে পশ্চিমবঙ্গের সাথে জুড়ে দেন।
বিজ্ঞানে বাঙালিকে সমগ্র বিশ্বে পরিচিত করে তুলেছেন মেঘনাথ সাহা, জগদীশ চন্দ্র বোস, সত্যেন্দ্রনাথ বোস, প্রফুল্ল চন্দ্র রায়, উপেন্দ্রনাথ ব্রহ্মচারী প্রমূখ বাঙালি বিজ্ঞানীগণ। বিজ্ঞানে বিশেষ অবদানের জন্য বিশ্ববিখ্যাত বিজ্ঞানী আইনস্টাইনের সাথে সত্যেন্দ্রনাথ বোসের নাম উচ্চারণ হয়। বাংলার ধনসম্পদে আকৃষ্ট হয়ে ব্রিটিশ ঈস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী যেমন বাংলাতেই তাদের ব্যবসা বাণিজ্য শুরু করেছিলেন তেমনি ভারতে আধুনিক শিক্ষা প্রসারের ক্ষেত্রেও তারা বাংলাকেই নির্বাচিত করেছিলেন। তাই ১৮৫৭ সালে প্রতিষ্ঠিত কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় ভারতের প্রথম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিরোপা অর্জন করেছে। ১৯১১ সালে ব্রিটিশ সরকার কলকাতা থেকে ভারতের রাজধানী দিল্লিতে স্থানান্তর করলেও স্বাধীনতা সময়কাল পর্যন্ত সমস্ত বিষয়ে বাংলা এবং বাঙালিরাই ছিল প্রথম সারিতে। তাই একসময় বিপ্লবী গোপাল কৃষ্ণ গোখলে বলেছিলেন যে- বাংলা আজ যা ভাবে ভারত কাল তা ভাবে। ১৯০৫ এ লর্ডকার্জনের বঙ্গভঙ্গ চক্রান্ত বাংলার আপামর জনসাধারণ রোধ করেছিল যে ঘটনা সমগ্র ভারতে বাঙালির পরিচয়কে তুলে ধরে আবার। ১৯০৬ এ অবিভক্ত বঙ্গভূমির দ্বিতীয় প্রধান শহর ঢাকাতেই মুসলিম লীগ তাদের প্রথম সমাবেশ করেছিলেন ফলে ভারতের সমস্ত প্রান্তের সমস্তস্তরের ইসলাম ধর্মাবলম্বীদের সামনে বঙ্গভূমি একটা আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু হয়েছিল।
বাংলাদেশ বাঙালি জাতি ও বঙ্গসংস্কৃতির উদ্ভবের ক্ষেত্রে ভূখণ্ড, জাতিসত্তা ও ভাষা মিলে নবম শতাব্দী বা তার পূর্বে জন্ম হয়েছে বঙ্গসংস্কৃতির। বাংলা একচ্ছত্র শাসনাধীনে এসেছে মোগল সম্রাট আকবরের সময়ে। তখন থেকেই সুবে বাংলা বা সুবা বাংলা নামে এই জনপদ পরিচিতি লাভ করে। এর আগে বাংলা বিভক্ত ছিল নানা জনপদে। গৌড় রাঢ় পুণ্ড্র বঙ্গ বঙ্গাল সমতট বরেন্দ্র হরিকেল কিংবা কামরূপ নামে পরিচিত ছিল বৃহৎবঙ্গের নানা অঞ্চল। আমরা এই জাতির রাজনৈতিক ইতিহাসের সূচনা লগ্নে পাল বংশ, সেন বংশের ভূমিকা লক্ষ্য করব। পাল রাজারা ছিলেন বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী। বাংলার সংস্কৃতিতে বুদ্ধ সংস্কৃতির সঙ্গে ব্রাহ্মণ্য সংস্কৃতির মিলন ঘটেছে সেন রাজাদের আমলে। আরও পরে মুসলিম শাসন প্রতিষ্ঠার পর ইসলামি সংস্কৃতির সঙ্গে মিশ্রণ হয়েছে। এইভাবে বুদ্ধ, ব্রাহ্মণ ও ইসলামি সংস্কৃতির মিলন ঘটেছে।
১৭৫৭ সালে পলাশীর প্রান্তরে ব্রিটিশ ঈস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর সাথে সিরাজ উদ্দদৌল্লাহ’র যুদ্ধের মাধ্যমে বাংলা তথা ভারতে ব্রিটিশ শক্তির উত্থান ঘটে। ধীরে ধীরে ব্রিটিশ শক্তি সারা ভারতে তাদের ব্যবসা ও শাসন কায়েম করলে ভারতের দেশীয় রাজাদের যেমন প্রভাব কমতে থাকে তেমনি একসময় ভারতের মানচিত্রও বদলে যেতে বাধ্য হয়। তাই আমরা দেখি ১৯৪৭ এর পর বাঙালি সত্তা যেমন বিস্তৃতি হয়েছে তেমনি বাঙালি জাতিরও ক্ষতি হয়েছে।
১৯৪৭ এর আগে অর্থাৎ ব্রিটিশ ভারতে বাঙালি জাতির বসবাস ছিল মূলত পূর্ববঙ্গ, পশ্চিমবঙ্গ এবং নিম্ন আসামের কামরূপ, কোকড়াঝাড়, গোয়ালপাড়া এবং বরাক উপত্যকার পাশাপাশি ত্রিপুরার বিস্তীর্ণ অঞ্চলে। এছাড়াও বিক্ষিপ্তাকারে ভারতের বিভিন্ন শহরে কিছু সংখ্যক বাঙালি বসবাস করতেন এবং বাংলা ভাষা ও সাহিত্য চর্চা করতেন। তাই দেখা যায় ‘নিখিল ভারত বঙ্গসাহিত্য সম্মেলন’ এর মতো প্রতিষ্ঠানের সৃষ্টি হয়েছিল। যে সংগঠনের প্রথম অধিবেশন বসেছিল ১৯২৩ খ্রিষ্টাব্দে বেনারসে এবং যেখানে সভাপতিত্ব করেছিলেন স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। এই সংগঠনের অধিবেশন বঙ্গভূমির বাইরে দিল্লি বোম্বাই মাদ্রাস লখনৌ হায়দ্রাবাদ শ্রীনগর গুয়াহাটিতে পর্যায়ক্রমে অনুষ্ঠিত হয়েছে। এ থেকেও বোঝা যায় বাংলার বাইরে বাঙালি ও বাংলা ভাষার চর্চা বেশ শক্তিশালি ছিল। সম্প্রতি পশ্চিমবঙ্গের বিদ্যাসাগর বিশ্ববিদ্যালয় স্নাতকোত্তর বিভাগে বহির্বঙ্গের বাংলা সাহিত্য বিষয়ক পাঠক্রম তাদের সিলেবাসে অন্তর্ভুক্ত করেছেন, যেখানে ভারতবর্ষের বিভিন্ন রাজ্যে রচিত বাংলা সাহিত্যের সমাবেশ ঘটেছে। স্বাধীনতার অনেক আগেই গবেষক জ্ঞানেন্দ্রমোহন দাশ বাংলার বাইরে বাঙালিদের নিয়ে চর্চা করেছেন যেখানে তিনি দেখিয়েছেন তৎকালীন ভারত জুড়ে বাঙালির বিস্তার ও প্রেক্ষাপট সংস্কৃতি ও সমাজকে। সম্প্রতি গবেষক অধ্যাপক তন্ময় বীর ‘বাংলার বাইরে বাংলাচর্চা’ সুবৃহৎ গবেষণা প্রকল্পে বর্তমান প্রেক্ষাপটে বাংলা ও বাঙালিদের সমস্ত দিক নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে তিনি ভবিষ্যৎ সম্ভাবনাকে খুঁজে পেয়েছেন। তাই তিনি বাংলার বাইরে থেকে প্রকাশিত প্রচুর পত্রপত্রিকাকে যেমন সামনে রেখে আলোচনায় অগ্রসর হয়েছেন তেমনি বাঙালি সংগঠনের কার্যবিবরণীকে লিপিবদ্ধ করেছেন। শুধু তাই নয় তিনি ‘ভারতের বাংলা ছোটগল্প’ সংকলনে সমগ্র ভারতের বাঙালি সাহিত্যিকদের একই গ্রন্থে তুলে ধরেছেন- যা খুবই প্রশংসনীয়। এছাড়াও জাপানের বিদেশচর্চা বিশ্ববিদ্যালয়সহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের কদর যে দিন বেড়েই চলছে সেই বিষয়ে একটি তথ্য তুলে ধরা যেতে পারে।
কিন্তু দেশভাগের ফলে বাঙালি ভারত ও ভারতের বাইরেও স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেছে। এবার আমরা দেশভাগের পরবর্তী সময়ে বাঙালির বিস্তৃতি নিয়ে আলোচনা করব-। এই আলোচনা করতে গেলে আমাদের সুবিধার্থে বঙ্গ, বহির্বঙ্গ, ভারত ও বাংলাদেশের বাইরের বঙ্গ ও বাঙালি নিয়ে আলোচনা করতে হবে। দেশভাগের ফলে পূর্ববঙ্গ ও পশ্চিমবঙ্গ সম্পূর্ণ ভাবে আলাদা হয়ে যায়। কলকাতাকে রাজধানী করে পশ্চিমবঙ্গ ভারত ভূ-ভাগের একটি অঙ্গরাজ্যের মর্যাদা পায়, যেখানকার অধিবাসীদের অধিকাংশই বাঙালি, তাঁদের মাতৃভাষা বাংলা। অপরদিকে ত্রিপুরা রাজন্যশাসন থেকে মুক্ত হয়ে ভারতের পূর্ণাঙ্গ রাজ্যের মর্যাদা লাভ করলে ত্রিপুরাও বাঙালি প্রধান এলাকা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়। ত্রিপুরার প্রধান দুটি ভাষা হল বাংলা ও কোকবরক। যদিও সরকারি কাজকর্মের অধিকাংশ বাংলা ও ইংরেজিতে হয়।
নদীর উপর নির্ভর করে আসাম প্রদেশকে দুটি ভাগে ভাগ করা হয়। যথা- বরাক উপত্যকা এবং ব্রহ্মপুত্র উপত্যকা। আসামের বরাক উপত্যকা অর্থাৎ হাইলাকান্দি করিমগঞ্জ কাছার জেলার প্রধান ভাষা বাংলা। এই অঞ্চলটি আসাম প্রদেশের গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চল হলেও ভাষার দিক থেকে এই অঞ্চলটিকে বর্তমানে বাঙালির ভূমি হিসেবেই ধরা যেতে পারে। আসামের ব্রহ্মপূত্র উপত্যকার অনেক অঞ্চলেই বাঙালি বসবাস করে, তাই সামগ্রিক ভাবে আসামের দ্বিতীয় প্রধান ভাষা বাংলা। বরাক উপত্যকা ও ব্রহ্মপুত্র উপত্যকার অধিকাংশ স্কুল কলেজে বাংলা পড়ানোর ব্যবস্থা রয়েছে। সেই দিক থেকে বাঙালির অপ্রধান বিস্তার হিসেবে আসামের ব্রহ্মপুত্র উপত্যকাকে ধরা যেতে পারে।
সম্প্রতি বাংলাভাষা সরকারি ভাবে ঝাড়খণ্ডের দ্বিতীয় প্রধান ভাষার মর্যাদা অর্জন করেছে । ঝাড়খণ্ডের স্কুল কলেজে বাংলা ভাষা ও সাহিত্য পড়ানোর ব্যবস্থা রয়েছে। সমগ্র ঝাড়খণ্ড জুড়েই বাংলা ভাষা ব্যবহার হয়। বিহারের কিশানগঞ্জ, ভাগলপুর, পূর্ণিয়া, কাটিহার প্রভৃতি অঞ্চল বাঙালি অধ্যুষিত অঞ্চল। এই অঞ্চল গুলির দ্বিতীয় প্রধান ভাষা বাংলা। ফলে উক্ত অঞ্চল গুলিতে বাঙালি সংস্কৃতির প্রাধান্য যেমন রয়েছে তেমনি স্কুল কলেজ বিশ্ববিদ্যালয় গুলিতেও বাংলা পঠন পাঠন চালু আছে। প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ করতেই হয় যে বহির্বঙ্গে বিহারেই প্রথম ‘বাঙালি সমিতি’ গড়ে উঠেছিল বলে জানা যায়। যে সমিতি সমগ্র বিহার জুড়েই প্রশংসার সঙ্গে সমাজ সেবা মূলক ও ভাষা সাহিত্য সংস্কৃতির উন্নতিতে কাজকর্ম করছে।
উত্তর প্রদেশের বেনারস ও এলাহাবাদে প্রচুর বাঙালি বসবাস করে আসছে ব্রিটিশ শাসনকাল থেকেই। মূলত ধর্মের কারণে বাঙালি উক্ত অঞ্চল গুলিতে প্রথম গেছে। তাই বাংলা সাহিত্যের প্রায় সমস্ত কবি সাহিত্যিকরাই বেনারস এলাহাবাদ নিয়ে কমবেশী লিখেছেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর,বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়, শরৎচন্দ্রের জীবনে উক্ত অঞ্চল দুটির প্রভাব আমরা পাই। শুধু তাই নয় বাংলা সাহিত্যের মাইলফলক ‘প্রবাসী’ পত্রিকা রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়ের সম্পাদনায় এলাহাবাদ থেকেই প্রকাশিত হত। বেনারস হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয়ে যেমন স্বতন্ত্রভাবে বঙ্গভাষা ও সাহিত্য বিভাগ রয়েছে তেমনি বাঙালিদের দ্বারা প্রতিষ্ঠিত স্কুল কলেজের সংখ্যাও একাধিক এবং একাধিক স্কুল কলেজে বাংলা পড়ানোর ব্যবস্থা রয়েছে।
দিল্লির সি আর পার্ক ১৯৪৭ সালের পর থেকেই বাঙালি এলাকায় রূপান্তরিত হতে থাকে। এই অঞ্চলটি মূলত ধনী বাঙালিদের বসবাস ক্ষেত্র। সি আর পার্কের বিভিন্ন সরকারি স্কুলে বাংলা পড়ানোর ব্যবস্থা রয়েছে। এমনকি দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের পাশাপাশি কয়েকটি কলেজে বাংলা পড়ানোর ব্যবস্থা রয়েছে। যদিও বর্তমানে বিশ্বায়নের যুগে সি আর পার্কের স্কুলগুলি থেকে বাংলা ভাষা ও সাহিত্য দিন দিন পাঠ উঠে যাচ্ছে।
ওডিশ্যা পশ্চিমবঙ্গের প্রতিবেশী রাজ্য। স্বাভাবিক কারণেই উভয় রাজ্যের মানুষ উভয় রাজ্যে কর্মসূত্রে বসবাস করছে। তা সত্ত্বেও পুরীর সাথে বাঙালির যোগাযোগ প্রায় চৈতন্য মহাপ্রভুর আমল থেকে। জগন্নাথ বৃহৎ বাঙালির আরাধ্য দেবতা। তাই বর্তমান সময়েও বাঙালি পুরীতে যাতায়াত করছে, আবার অনেকে স্থায়ীভাবে বসবাস করছে। তাই দেখা যায় বাঙালি সংস্কৃতির সঙ্গে মেলামেশার ফলে পুরীর অধিকাংশ স্থায়ী লোকজন বাংলাভাষা বলতে পারেন বা বুঝতে পারেন। তাছাড়াও মালকানগিড়ি, কালাহান্ডি, বস্তার প্রভৃতি অঞ্চলেও বড়সংখ্যক বাঙালি লোকজন বসবাস করছে। সেইসাথে পশ্চিমবঙ্গের সীমান্তবর্তী জেলাগুলির অধিকাংশ মানুষই বাংলা বলতে ও বুঝতে পারেন। শুধু তাই নয়, ভুবনেশ্বর নিবাসী, ২০১৯ সালে প্রয়াত অনুবাদক যুগোল কিশোর দত্ত বাংলা থেকে প্রায় ১৫০টি বই ওড়িয়া ভাষায় অনুবাদ করে দুইবার সাহিত্য একাদেমী পুরস্কার লাভ করেছেন। এছাড়াও উত্তরপূর্ব ভারতের নাগাল্যাণ্ডের ডিমাপুর, কোহিমা, অরুণাচল প্রদেশের ইটানগর, মেঘালয়ের শিলং, মণিপুরের জিরিবাম প্রভৃতি অঞ্চলে প্রচুর সংখ্যক বাঙালি বসবাস করে এবং সেখানকার একাধিক স্কুল কলেজে বাংলা পড়ানোর ব্যবস্থা রয়েছে।
কর্ণাটকের সঙ্গে বাঙালির যোগ সেন আমল থেকে। কথিত আছে বাংলায় দুর্গাপূজার প্রচলন করেছেলিন মাইশুরী কায়স্থ ও ব্রাহ্মণরা। তাই বর্তমানেও এই সংযোগ ছিন্ন হয়নি। ফলে কালের নিয়মে বাংলাভাষা কর্ণাটকের দ্বিতীয় ভাষার মর্যাদা অর্জন করেছে। এছাড়াও মুম্বাই, চেন্নাই ব্যাঙ্গালোরে চাকরি, ব্যবসা ও কর্মসূত্রে প্রচুর বাঙালি স্থায়ীভাবে বসবাস করে। ভারতের বড় শহর গুলিতে বাঙালির অবদান যে রয়েছে তার প্রমাণ পাওয়া যায় বিভিন্ন শহরে বাঙালি সংগঠনের দুর্গাপূজা গুলি থেকে। ভারতের অপর দুটি বাঙালি অধ্যুষিত এলাকা হল দণ্ড্যকারণ্য ও আন্দামান নিকোবর দ্বীপপুঞ্জ। ভৌগোলিক দিক থেকে দন্ডকারণ্য হল অন্ধ্রপ্রদেশ মধ্যপ্রদেশ ও ওড়িশ্যার সীমান্তবর্তী একটি অঞ্চল। এই দণ্ডকারণ্য মূলত দেশভাগের ফলে বাঙালিদের বস্তি গড়ে উঠে। ভারত সরকারের প্রচেষ্টায় দন্ডকারণ্য প্রোজেক্টি গড়ে উঠেছিল।পশ্চিমবঙ্গ দলিত সাহিত্য একাদেমীর সভাপতি,সাহিত্যিক ও বর্তমান বিধানসভার সদস্য মনোরঞ্জন ব্যাপারীর জীবনের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে রয়েছে দণ্ডকারণ্য। এমনকি প্রাক্তন সাংসদ মমতাবালা ঠাকুরের সাথেও দণ্ডকারণ্যের ভূমিজ যোগ রয়েছে বলে আমরা জানতে পারি।
আন্দামানের সঙ্গে বাঙালির পরিচয় বহু পুরানো। ব্রিটিশ ভারতের অনেক বাঙালি বিপ্লবীকে আন্দামানে নিক্ষেপ করা হয়েছিল। পরবর্তীতে দেশভাগের ফলে ভারত সরকারের কিছু প্রোজেক্ট বাস্তবায়িত করার জন্য প্রচুর সংখ্যক বাঙালি আন্দামানের দ্বীপ গুলিতে বসবাস করছে। বাংলা সংস্কৃতি, বাংলা ভাষা তাই আন্দামানের প্রায় সমস্ত দ্বীপের মানুষের পরিচিতি রয়েছে। তাই আন্দামানের অন্যতম প্রধান ভাষা বাংলা।
ভারতে বহির্বঙ্গে বাংলা ভাষীদের সংখ্যা হিসেবে আমরা ২০১১ সালের আদম শুমারিকে সামনে রেখে বাংলার বাইরে বাঙালিদের হিসেবকে সংক্ষেপে তুলে ধরতে পারি। যেখানে আমরা দেখব ভারতের প্রায় সমস্ত রাজ্যেই বাঙালিরা স্থায়ী ভাবে বসবাস করলেও মূলত প্রধান এলাকাগুলি হল- আসাম-২৮.৯২%, আন্দামান নিকোবর দ্বীপপুঞ্জ- ২৮.৪৯%, মিজোরাম-৯.৮৩%, ঝাড়খন্ড-৯.৭৩%, মেঘালয়-৭.৮৪%, অরুণাচল প্রদেশ-৭.২৭%, নাগাল্যান্ড-৩.৭৮%। আবার মোট জনসংখ্যার হিসেবে দিল্লি- ২১৫,৯৬০, ওড়িশ্যা-৫০৪,৫৭০, ছত্তিশগড়-২৪৩,৫৯৭, বিহার-৮১০,৭৭১, মহারাষ্ট্র-৪৪২,০৯০, মধ্যপ্রদেশ-১০৯,১৮৫, উত্তরপ্রদেশ-২৪১,০০৭ সংখ্যক বাঙালি আছেন।
কাশীর পণ্ডিত গোপীনাথ কবিরাজের নাম ভারত জুড়ে রয়েছে।তিনি পেশায় ছিলেন অধ্যাপক ও সামজকর্মী । সেই সূত্রেই তিনি কাশী থেকে অন্যান্য ভাষার পাশাপাশি বাংলা ভাষাতেও সাহিত্য চর্চা করতেন।সংস্কৃতজ্ঞ বিশ্বনাথ পণ্ডিত আজীবন রবী ঠাকুরকে গুরুদেবের আসনে বসিয়ে সংস্কৃত, হিন্দি ইংরেজির পাশাপাশি বাংলাভাষাতেও সাহিত্যচর্চা করতেন। মূলত বিশ্বনাথ পণ্ডিতের প্রচেষ্টায় বেনারসে গড়ে উঠেছে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের এক বৃহৎ ও প্রাচীন লাইব্রেরী। এছাড়াও অধ্যাপক প্রকাশ কুমার মাইতি, নমিতা ভট্টাচার্য, ব্রততী চক্রবর্তী, অলকা চ্যাটার্জী, সুকুমার চট্টোপাধ্যায় প্রমুখ বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ নিয়মিত বাংলাভাষাতে সাহিত্যচর্চা করছেন। অধ্যাপিকা সুমিতা চ্যাটার্জী সুদূর কাশী থেকে ফেসবুকে প্রায়ই বাংলাভাষায় কবিতা পোস্ট করে থাকেন। হাইলাকান্দির বিজিত কুমার ভট্টাচার্যের অসংখ্য বাংলা গ্রন্থ রয়েছে। এছাড়াও অমলেন্দু ভট্টাচার্যের বাংলা সাহিত্যের সাথে আপামর বাঙালি পরিচিত। অধ্যাপক তপোধীর ভট্টাচার্য্যের বই ছাড়াতো বাংলা সমালোচনা সাহিত্য অসম্পূর্ণ।তিনিও বাংলার বাইরের একজন অন্যতম প্রধান বাঙালি লেখক।বরাক ভ্যালি থেকেই 'উত্তরসূরী' ফেসবুক পেজটি সম্প্রসারিত হয়। এই পেজে ভারতের বিভিন্ন প্রান্তের বাঙালি কবি সাহিত্যিকরা নিয়মিত উপস্থিত থাকেন। এছাড়াও দিল্লি থেকে প্রকাশিত 'সোনার তরী' ফেসবুক পেজে রোজদিনই কিছুনা কিছু বাংলা ভাষায় সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান সম্প্রচারিত হয়। দিল্লীর ব্রজমাধব ভট্টাচার্্যের সাহিত্যের সঙ্গে কমবেশি প্রত্যেকটি বাংলাসাহিত্য প্রেমী পরিচিত। মালকানগিরি থেকে সুধীররঞ্জন হালদার নিয়মিত বাংলাভাষায় সাহিত্যচর্চা করছেন।সমরেন্দ্র বিশ্বাস সুদূর ভিলাই থেকে কবিতা ছোটগল্প রচনা করছেন।ডিমাপুরের শংকর দেব, দুলাল মজুমদার, অধ্যাপক দেবাশীস দত্ত মহাশয়ের একাধিক বাংলা গ্রন্থ পশ্চিমবঙ্গেও পাওয়া যায়। গৌহাটির বিদ্যুৎ চক্রবর্তী উত্তর পূর্ব ভারতে বাংলা ভাষার কবি হিসেবে সম্যক পরিচিত। সন্দীপন ধর কলকাতা নিবাসী হলেও বর্তমানে হাইলাকান্দি থেকে বাংলা ভাষার সাহিত্যচর্চায় একটি বিশিষ্ট নাম। ত্রিপুরার বাংলা ভাষা ও সাহিত্য নিয়ে আলোচনা করে শেষ করা মুস্কিল। তাই এই প্রসঙ্গে অধ্যাপক শিশির কুমার সিনহা রচিত 'ত্রিপুরার বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস' গ্রন্থের নাম শুধুমাত্র উল্লেখ করা যেতে পারে। উক্ত বৃহৎগ্রন্থে ত্রিপুরার বাংলা সাহিত্য ও সাহিত্যিক নিয়ে বিস্তৃত আলোচনা রয়েছে। বর্তমানে রাঁচী থেকে বাংলা ভাষায় সাহিত্য রচনা করছেন সুবল দত্ত মহাশয়।পাটনার বাঙালি লেখক বিদ্যুৎ পাল পরিচিত একজন নাম। ধানবাদের অধ্যাপক দীপক কুমার সেন ঝাড়খণ্ডের একজন বাঙালি লেখক হিসেবে সর্বজন শ্রদ্ধেয়। দিল্লি নিবাসী মণিরত্ন মুখোপাধ্যায় রেলবিভাগের উচ্চপদস্থ কর্মচারী হলেও তিনি দিল্লির বাঙালি সমাজে একজন বাংলা ভাষার সাহিত্যিক হিসেবে সুপ্রতিষ্ঠিত।
বাংলাদেশ পর্ব নিয়ে আমরা আলোচনা করবোনা।কারণ বাংলাদেশের মাতৃভাষা বাংলা। সেখানে বাংলা ভাষাতেই সাহিত্যচর্চা হবে- এটাই বাস্তব। এই প্রসঙ্গক্রমে শুধুমাত্র উল্লেখ করা যেতে পারে- বর্তমান বাংলাদেশের চট্টগ্রামের সঙ্গে মায়নামারের আরাকান প্রদেশের সংযোগ ছিল বিভিন্ন দিক দিয়ে। তাই আরাকান প্রদেশের পাশাপাশি রেঙ্গুনে একসময় অনেক বাংলাভাষী লোকজন বসবাস করতেন।শরৎচন্দ্র চট্টোপাধায়ের জীবনের একটা অংশ রেঙ্গুনেই কেটেছে বলে আমরা জানি।বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস পড়লেই জানা যায় আরাকানের রাজসভা থেকেই বাংলা মুসলমান সাহিত্যের সৃষ্টি।
১৯৭১ এ বাংলাদেশ স্বাধীন রাষ্ট্রের মর্যাদা লাভ করলে বর্তমান বাংলাদেশের প্রচুর সংখ্যক উর্দুভাষা ব্যবহারকারী ও উর্দুভাষা সমর্থনকারী মুসলমান বাঙালি পশ্চিম পাকিস্তান অর্থাৎ বর্তমান পাকিস্তান রাষ্ট্রে চলে যান। শেষ হিসেব পাওয়া পর্যন্ত দেখা যায় প্রায় ২০,০০০০০ মুসলমান বাঙালিকে সে দেশের সরকার করাচীতে রাখার ব্যবস্থা করে। ফলে পাকিস্তানেও বাংলাভাষা ও বাঙালির বাসস্থান দেখা যায়। করাচি বিশ্ববিদ্যালয়ে এখনো বাংলা সাহিত্য পাঠ ও বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে গবেষণা করার সুযোগ রয়েছে।
এছাড়াও আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের প্রায় প্রত্যেকটি শহরেই প্রচুর সংখ্যক বাঙালি বাস করেন। তাই পরিসংখ্যানে দেখা যায় আমেরিকায় শতাধিক বাঙালি পরিচালিত সামাজিক সংগঠন রয়েছে। যার কয়েকটি উল্লেখ করা যেতে পারে- Bengali Cultural Association of Arizona, Valley Bengali Community (California), Sanskriti (California), Dakshini (California), Bengali Association of Southern California, Bengali Association of North Florida, Bengali society of Florida, Bengali Association of Greater Atlanta, Atlanta Bengali Forum, Bengali Association of Greater Chicago, Bengali Association of Indiana, Kensas city Bengali Association ইত্যাদি। আমেরিকার মতোই ইংল্যান্ড, কানাডা, ইতালি, ফ্রান্স প্রভৃতি দেশেও স্থায়ীভাবে বাঙালিরা বসবাস করছে। তাই ভারত ও বাংলাদেশের বাইরে পৃথিবীর উন্নত দেশগুলির প্রায় ১০০টির মতো বিশ্ববিদ্যালয়,কলেজ ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বাংলা ভাষা ও সাহিত্য পড়ার সুযোগ রয়েছে। যার মধ্যে কয়েকটি হল-
1. University of Washington
2. University of Chicago
3. University of London
4. Cornel University
5. University of Virginia
6. Institute for South Asia Studies UC Berkeley
7. University of Oxford
8. King’s College London
9. The University of Texas at Austin
উপরিউক্ত তথ্যগুলি থেকেই অনুমান করা যায় বাংলাভাষার বিশ্বব্যাপী বিস্তৃতির কথা। বর্তমানে সারা বিশ্বে ভাষার দিক থেকে বাংলাভাষার স্থান পঞ্চম এবং বাংলা ভাষাভাষী জনগণের সংখ্যা প্রায় ২৮ কোটি। ইউনেস্কো বাংলাভাষাকে পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ সুসজ্জিত ও মিষ্টি ভাষার অভিধায় ভূষিত করলে পৃথিবীর অনেক দেশের নাগরিকরাই বাংলা ভাষা শেখার দিকে আগ্রহ দেখাচ্ছে। তাই আফ্রিকা মহাদেশের সিয়েরালিওন নামক দেশটির রাষ্ট্র প্রধান সম্প্রতি বাংলাকে সেই দেশের দ্বিতীয় প্রধান ভাষার মর্যাদা দিয়েছে। বাংলাভাষা শুধুমাত্র ভারতের নয় পৃথিবীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ একটি সাহিত্য ভাষা রূপে পরিগণিত হয়। এছাড়াও American Institute of Indian Language নামক ভাষা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের উপর জোর দেওয়ায় অনেক দেশেই বাংলা ভাষা ও সাহিত্য সম্বন্ধে জানার আগ্রহ দেখা দিয়েছে।মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলিতে বাংলাদেশ থেকে প্রচুর শ্রমিক কাজ করতে যান। ফলে সেই সমস্ত দেশগুলিতেও বাংলাভাষার বিস্তার লক্ষ্য করা যাচ্ছে বিভিন্ন সোসাল মিডিয়ার গ্রুপ গুলিতে। লণ্ডন থেকে সম্প্রচারিত ‘লণ্ডন বাংলা ভয়েস’ সারা পৃথিবীব্যাপী বাংলা ভাষায় বিভিন্ন অনুষ্ঠান সম্প্রচার করছে।‘রোর-বাংলা’ ফেসবুক পেজে তো পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্ত থেকে প্রাবন্ধিকরা অজানা বিষয় নিয়ে নিয়মিত বাংলাভাষায় প্রবন্ধ লিখে চলছেন। বিশ্বব্যাপী বাংলাভাষা ও সংস্কৃতি বিস্তারে ‘বঙ্গদর্শন’ ফেসবুক পেজটিও পিছিয়ে নেই।চীন থেকে বাংলাভাষা চর্চা হচ্ছে ‘সিআরআইবাংলা’ ফেসবুক পেজে। যেখানে চীনের বিভিন্ন সংস্কৃতি চীনদেশীয়রা বাংলাভাষায় তুলে ধরছেন।সেইদিক থেকে বিচার করলে আমরা দেখতে পাচ্ছি পৃথিবীর সমস্তপ্রান্তেই বাংলাভাষী লোকজন রয়েছে এবং তারা বাংলাভাষা ও সাহিত্যচর্চা করছেন।টেকনোলজির যুগে সেইসব খবর আমরা ঘরে বসেই পাচ্ছি এবং সমৃদ্ধ হচ্ছে বাংলা ভাষা।
কিন্তু আমাদের পশ্চিমবঙ্গ তথা ভারতে দিনদিন বাংলাভাষার সংকোচন লক্ষ্য করা যাচ্ছে। অনেক বাংলামাধ্যম স্কুল বন্ধ হয়ে যাচ্ছে প্রতিবেশী রাজ্যগুলি থেকে। বহির্বিশ্বে যেখানে বাংলা ভাষার বিস্তৃতি ঘটছে; সেইখানে দাঁড়িয়ে ভারত তথা পশ্চিমবঙ্গে বাংলাভাষার সংকোচন মোটেই কাম্য নয়। এই সংকোচনের অর্থনৈতিক বৈষম্যের বিরাট প্রভাব লক্ষ্য করা যাচ্ছে।তাই কলকাতার বুকে বন্ধ হচ্ছে বাংলা মাধ্যম স্কুল।বাংলা ভাষার শিক্ষক ও গবেষকরা যেমন প্রায়ই হেয় প্রতিপন্ন হচ্ছে তেমনি শহরের বাংলাভাষী শিশু শিক্ষার্থীদের মধ্যে ইংরেজি ও অন্যান্য মাধ্যম স্কুলে ভর্তি হওয়ার প্রবণতা দিন দিন বেড়েই চলছে। সেই তুলনায় মফঃস্বল শহরগুলিতে বাংলা মাধ্যম স্কুলগুলো বেশ ভালোই চলছে।তাই বিগত কিছু বছরের পরিসংখ্যান দেখলে দেখা যায় পশ্চিমবঙ্গ সরকার পরিচালিত মাধ্যমিক ও হায়ার সেকেণ্ডারীতে কলকাতার তুলনায় অন্যান্য জেলা শহর ও মফঃস্বল শহরগুলির শিক্ষার্থীরা এগিয়ে চলছে।প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে অর্থনৈতিক, শিক্ষা ও বহির্বিশ্বের সঙ্গে যোগাযোগের ক্ষেত্রে কলকাতা অনেকগুণ এগিয়ে। ফলে এখানকার শিক্ষার্থী ও তাদের অভিভাবকগণ সহজেই আন্তর্জাতিক ভাষায় শিক্ষালাভে উৎসাহিত হচ্ছে। এছাড়াও কর্মসূত্রে ভারতের বিভিন্ন প্রদেশের জনগণ কলকাতায় অবস্থান করায় যোগাযোগের মাধ্যম হিসেবে তাঁরা ভিন্ন ভাষার আশ্রয় নিচ্ছে এবং শিক্ষার্থীদের হিন্দি অথবা ইংরেজী মাধ্যম স্কুলে ভর্তি করার প্রবণতার দিকে ঝুঁকছে।
এইসব কারণেই পশ্চিমবঙ্গে যাতে বাংলা ভাষার সংকোচন না হয় সেইদিকে খেয়াল রেখে গর্গ চ্যাটার্জীর নেতৃত্বে গঠিত হয়েছে ‘বাংলাপক্ষ’। কিন্তু বাংলাপক্ষের কর্মকাণ্ড নিয়েও বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন প্রশ্ন দেখা দিয়েছে।তবে বাংলাপক্ষ অধিকাংশ সময়ই পশ্চিমবঙ্গে একটি বিশেষ ভাষা বিস্তারের বিরোধীতা করে থাকে এবং ভারতের জাতীয় ভাষাবিষয়ক মানুষের মধ্যে যে একটা ভুল ধারণা রয়েছে সেই বিষয়ে আলোকপাত করে থাকে। তন্বী দাসদের নেতৃত্বে অপর একটি সংগঠন ‘বাংলা জাতীয় সম্মেলন’ বাংলা ভাষার বিস্তারে নিরলস কাজ করছে। সর্বভারতীয় স্তরে বাংলাভাষার বিস্তারে নীতিশ বিশ্বাসের নেতৃত্বে ‘বাংলা ভাষা একতা মঞ্চ’ কাজ করার চেষ্টা করলেও সুদূরপ্রসারী ফলাফল তেমন পরিলক্ষিত হচ্ছেনা।এর পিছনেও বঙ্গভূমি ও বহির্বাংলার বাঙালি বিদ্বজনদের ভূমিকা তেমন স্পষ্ট নয়।সারাভারত ব্যাপী কিছু বিশিষ্টজন বাংলা ও বাঙালি নিয়ে কথা বললেও সমাজের অধিকাংশ সাধারণ ব্যক্তিবর্গ ‘বাংলা ভাষা একতা মঞ্চ’এর ব্যাপারে তেমন ওয়াকিবহাল নয়। তাই সর্বেশেষে বলা যায় ভারতে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যকে ব্যাপকভাবে টিকিয়ে রাখতে হলে সোসালমিডিয়ার বিভিন্ন পোর্টালগুলিতে সকলকে নিয়মিত লেখা উচিত এবং কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে বাংলা ভাষাকে ধ্রূপদী সাহিত্যের মর্যাদা দেওয়ার জন্য আবেদন জানানো উচিত। বিগত দিনে এই ধ্রূপদী বিষয়ে সংসদে দাবী উত্থাপন করেছিলেন সাংসদ ঋতব্রত ব্যানার্জী, অধীর রঞ্জন চৌধুরী এবং বিকাশ রঞ্জন ভট্টাচার্য মহাশয়। দলমত নির্বিশেষে সকল সাংসদকে এই দাবীকে সমর্থন জানিয়ে বাংলাভাষাকে ধ্রুপদী ভাষার মর্যাদায় রূপদান করতে পারলে বাংলাভাষার বিস্তার সম্ভব। এই প্রসঙ্গেই অধ্যাপক অচিন্ত্য বিশ্বাস, অধ্যাপক তপোধীর ভট্টাচার্য, নীতিশ বিশ্বাস মহাশয়দের একাধিক দীর্ঘ বক্তব্য রয়েছে ফেসবুক পেজে। যেখান থেকে সহজেই বোঝা যায় বাংলাভাষার ধ্রুপদী ভাষার মর্যাদা পাবার সমস্ত যোগ্যতা বর্তমান। সেই সাথে করোনা মহামারীর কবলে পরে হাজার হাজার পরিযায়ী শ্রমিক নিজ নিজ রাজ্য তথা ভাষীক এলাকায় প্রত্যাবর্তন করতে বাধ্য হয়েছেন। তাঁদের শিশুরা নিজ রাজ্যে প্রত্যাবর্তন করে যাতে সংবিধান স্বীকৃত ভাষাগুলিতে প্রাথমিক মাধ্যমিক শিক্ষা অর্জন করতে পারে সেই দিকে সরকারের খেয়াল রাখা উচিত।যদি নিজ নিজ ভাষায় শিক্ষা অর্জনে ব্যাঘাত না ঘটে তবে অর্থনৈতিকভাবে পিছিয়ে পড়া শ্রেণীর শিক্ষার্থীদের মাধ্যমেও বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের বিস্তার সম্ভব। কারণ দণ্ডকারণ্য বা বরাক ভ্যালির কোন বাঙালি শ্রমিক পরিবারের শিক্ষার্থী অন্য রাজ্যে অন্য ভাষায় তার প্রাথমিক শিক্ষা অর্জন শুরু করলেও সে বাংলাভাষা অভিভাবকদের মাধ্যমে শিখেছে। তারা কাজ হারিয়ে নিজ স্থানে প্রত্যাবর্তন করার ফলে অর্থনৈতিকভাবে আরও পিছিয়ে পড়বে। ফলে তাদের সরকারি বিদ্যালয় ছাড়া গতি নেই।যদি সেক্ষেত্রে সেই বাংলাভাষী শিক্ষার্থীকে বাংলা মাধ্যমের স্কুলেই ভর্তি করানো যায় তবে বাংলাভাষার বিস্তার যেমন ঘটবে তেমনি সাহিত্যও বিস্তারলাভ করবে।অর্থনৈতিকভাবে স্বচ্ছ্বল পরিবারের অধিকাংশ শিক্ষার্থীরা তো বেসরকারি স্কুলের দিকেই ঝুঁকছে। তাই বলা যায় করোনা মহামারীর ফলে অল্প হলেও বঙ্গভূমি তথা বহির্বঙ্গে বাংলাভাষা ও সাহিত্যের পাশাপাশি অন্যান্য অফিসিয়াল ভাষাগুলিরও বিস্তার ঘটবে বলে মনে হয়।
0 মন্তব্যসমূহ
thanks