Swami Vivekananda : কর্মযোগী মহান বীর স্বামী বিবেকানন্দ -অন্ধকার থেকে আলোয় ফেরা রাস্তা তিনি দেখিয়ে গেছেন

Swami Vivekananda
Swami Vivekananda



বটু কৃষ্ণ হালদার: 

কর্মযোগী মহান বীর স্বামী বিবেকানন্দের মৃত্যুর পর বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নোবেল পুরস্কার বিজয়ী ফরাসি সাহিত্যিক রোম্যাঁ রোলাঁকে চিঠি লিখেছিলেন_"ভারতকে জানতে চাইলে বিবেকানন্দের লেখা পড়ো। তার মধ্যে সবকিছু ইতিবাচক,নেতিবাচক কিছুই নেই"। জবাবে রোম্যাঁ রোলাঁ লিখেছেন তার লেখাগুলি _"মহান সঙ্গীত এর মতো। পংক্তিগুলি বেটোফেন শৈলির মত। চিত্তাকর্ষক শব্দগুলি হ্যান্ডেল কোরাসের কুচকাওয়াজের মত। আজও ত্রিশ বছর পরেও তার বাণীগুলোকে স্পর্শ করলে আমার শরীরে বৈদ্যুতিক আঘাতের মতো শিহরণ জাগে। এই মহা নায়কের মুখ থেকে যখন এই জ্বলন্ত শব্দগুলি উচ্চারিত হয়েছিল তখন নিশ্চয়ই অনেকে এই শিহরন অনুভব করেছিলেন"।




উনবিংশ শতকে বাংলায় বাঙালি মনীষীদের নবজাগরণ ঘটেছিল। যাঁরা নিজেদের জীবনের বিনিময়ে বন্ধা সমাজকে দিয়েছিল উর্বরতার ঠিকানা। তাদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন কর্মযোগী মহান বীর স্বামী বিবেকানন্দ। ভারতের অন্যতম উজ্জ্বল জ্যোতিষ্ক ছিলেন তিনি। ১৮৬৩সালে ১২ জানুয়ারি কলকাতার সিমলা অঞ্চলে বিখ্যাত দত্ত পরিবারে তার জন্ম হয়। পিতা বিশ্বনাথ দত্ত কলকাতা হাইকোর্টের এটর্নি ছিলেন।মায়ের নাম ভুবনেশ্বরী দেবী। এই মহান কর্মজীবীদের স্মৃতির উদ্দেশ্যে ১২ ই জানুয়ারি ভারতবর্ষে "যুব দিবস" হিসেবে পালিত হয়। তিনি খুব ছোটবেলা থেকে শরীর চর্চা করতেন এবং প্রথম সকালে নিয়মিত যোগ ব্যায়াম করতেন। নিয়মিত ক্রিকেট খেলতেন।প্রচণ্ড সাহসী ও তীক্ষ্ণ বুদ্ধিমত্তা এবং পরিশ্রমী ছিলেন।"উঠে দাঁড়াও,শক্ত হও,যাবতীয় দায়িত্ব নিজের কাঁধে নাও,আর এটা সবসময় মাথায় রেখো তুমি নিয়তির স্রষ্টা,তোমার যে পরিমাণ শক্তি প্রয়োজন সবটা তোমার মধ্যে রয়েছে সুতরাং নিজের ভবিস্যত নিজে তৈরী করে নাও"। তাঁর উদ্দীপ্ত বাণীর মধ্যে দিয়ে তিনি বুঝিয়ে দিয়েছেন ভাগ্যের দোহাই দিয়ে বেঁচে থাকার কোন মানে নেই। প্রতিটি মানুষ অন্তর্নিহিত গুণের অধিকারী। সচিন তেন্ডুলকর তিনি নিজেও জানতেন না সারাবিশ্ব তাকে এভাবে চিনতে বা জানতে পারবে। সৎ ও নিরলস পরিশ্রম তাকে পৌঁছে দিয়েছে জীবনের উর্ধ্বসীমায়। তিনি বুঝিয়েছেন মানুষের জীবনের উন্নতির একমাত্র উপায় হল সৎ ও নিরলস পরিশ্রম। তিনি বরাবর ভারতের যুবসমাজকে উদ্দীপ্ত করার চেষ্টা করেছেন। কারণ যুবসমাজ হল ভারতের মেরুদন্ড, ও ভবিষ্যৎ। মানুষের মেরুদণ্ড যদি শক্ত না হয় তাহলে,সে মানুষ কখনোই সমাজে মাথা উঁচু করে বাঁচতে পারে না। মাথা উঁচু করে বাঁচার মতো তিনি শিখিয়ে গেছেন।তিনি কুসংস্কারের ঘোর বিরোধী ছিলেন।নগরে নগরে ঘুরে তিনি ধর্মের সঙ্গে সঙ্গে কিভাবে সমাজকে ঐক্যবদ্ধ করা যায় এবং বিশ্বের দরবারে নিজের দেশের কথা তুলে ধরা যায় তা নিয়ে সর্বক্ষণ পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতেন।




উনবিংশ শতকের শেষার্ধে বিভিন্ন ধর্ম মতের মধ্যে পারস্পরিক সুসম্পর্ক স্থাপন এবং হিন্দু ধর্মকে বিশ্বের অন্যতম প্রধান ধর্ম হিসেবে প্রচার করে গেছেন স্বামী বিবেকানন্দ। হিন্দু পূর্ণ জাগরণের তিনি ছিলেন অন্যতম পুরোধা। সেই সঙ্গে ব্রিটিশ ভারতে তিনি জাতীয়তাবাদী ধারণা প্রবর্তন করেন। তিনি শুধু কর্মযোগী মহান সন্ন্যাসী ছিলেন না, ছিলেন একজন সঙ্গীতজ্ঞ ও গায়ক। তাঁর রচিত দুটি গান হল"খণ্ডন-ভব-বন্ধন"(শ্রীরামকৃষ্ণ আরাত্রিক ভজন), ও "নাহি সূর্য নাহি জ্যোতি","নাচুক তাহাতে শ্যামা"।




কর্মজীবী মহান বীর শিখিয়েছিলেন মানুষকে ভালবাসতে। ভালোবাসার মধ্যে দিয়ে সবকিছু জয় করা যায় তা তিনি প্রমাণ করেন।"বহুরূপে সম্মুখে তোমার ছাড়ি যেথা খুঁজেছি ঈশ্বর /জীবে প্রেম করে যেইজন,সেইজন সেবিছে ঈশ্বর"। জীব সেবা মানেই শিব সেবা। তিনি কাম ক্রোধ লোভ হিংসা কে ঘৃণা করতেন। কারণ একটি মানুষের জীবন পর্যায়ে উন্নতির পথে অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায়। পৃথি বীর শ্রেষ্ঠ সভ্যতা হল মানব সভ্যতা। সেই সভ্যতার মানুষ জন কখনও কখনও লোভ হিংসার বশবর্তি হয়ে ভুল পথে চালিত হন। সেটা তিনি কখনো মেনে নিতে পারেননি। তিনি সর্বপ্রথম ১৮৯৩ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগো ধর্ম সম্মেলনে যোগ দেন। বিশ্বের মহা সম্মেলনে তার বাণী আজও অক্ষত হয়ে আছে বিশ্বের দরবারে। বিশ্ববাসীর কাছে তিনি আমেরিকার উদ্দেশ্যে বলেন_"my dear sisters and brothers in America",এই সম্বোধনে ধর্মসভার সমস্ত ব্যক্তি আপ্লুত ও উচ্ছ্বাসিত হয়ে পড়েন। চারিদিকে করতালিতে ভরে যায়। মাত্র ৫ মিনিট বক্তৃতা দিয়ে সমগ্র আমেরিকা তথা বিশ্ববাসীর মন জয় করেন। ভারতীয় দর্শন,ধর্ম সংস্কৃতি ও বাঙালি সমাজ কে নিয়েছিলেন বিশ্বকে। তিনি ভারতীয় ধর্ম তথা হিন্দু ধর্মকে শ্রেষ্ঠত্বের প্রমাণ দিয়েছিলেন। দেশ-বিদেশে ঘুরে বহু অর্থ ও সম্মান উপার্জন করেছিলেন।




অহেগা নন্দ ভারতী বলেছেন"আধুনিক যুগের হিন্দুরা হিন্দু ধর্ম সম্পর্কে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ জ্ঞান বিবেকানন্দের রচনা থেকে আহরণ করেন"। ব্রিটিশ শাসিত ভারতে জাতীয়তাবাদী ধারণার অভ্যুত্থানে প্রেক্ষাপটে স্বামী বিবেকানন্দ জাতীয়তাবাদী আদর্শের টিকে নির্দিষ্ট করে দিয়েছিলেন। স্বামী বিবেকানন্দ ভারতের মূল সমস্যার উপর আলোকপাত করেছিলেন, তিনি বলেছিলেন "দারিদ্র্য দূরীকরণের জন্য ভারতের জাতীয় নবজাগরণের প্রয়োজন আছে"। তাঁর জাতীয়তাবাদী ধারণা ভারতীয় দার্শনিক ও রাজনৈতিক নেতাদের প্রভাবিত করেছিলেন। স্বামী বিবেকানন্দের কথায় অনুপ্রাণিত হয়ে জামসেদজী টাটা"Indian institute of science"নামে একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান স্থাপন করেছিলেন যা ভারতের প্রথম সারির গবেষণা মূলক বিশ্ববিদ্যালয়। তিনি বিদেশে প্রাচ্য বৃদ্ধ ম্যাক্স মুলার ও বিজ্ঞানী নিকোলা টেসলারের এর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছিলেন। সমাজ সংস্কারক চার্লস ফ্রিয়ার অ্যান্ড্রুজ এর ভাষায়_"স্বামী বিবেকানন্দের নির্ভীক দেশাত্মবোধ সারা ভারতের জাতীয় বাদী আন্দোলনকে নতুন মাত্রায় যোগদান করেছিল"। ভারতের নবজাগরণে স্বামী বিবেকানন্দের যতটা অবদান ছিল নিঃস্বার্থভাবে ততটা অন্যকেও তেমনভাবে স্বাক্ষর রেখে যেতে পারেনি।




জন্মিলে মরিতে হবে /অমর কে কোথা কবে, এটাই তো বিধির বিধান। সৃষ্টি কর্তার শ্রেষ্ঠ বরদান হল জীবন সৃষ্টি। তবে তা ক্ষণস্থায়ী। মানব জীবন আটকে আছে সুনির্দিষ্ট কিছু নিয়মে। অনন্ত কাল নয়। জীবনের শুরু হয় জন্ম দিয়ে আর পরিসমাপ্তি ঘটে মৃত্যু দিয়ে। ঠিক এই নিয়ম অনুসারে কর্মযোগী মহান বীর স্বামী বিবেকানন্দ ১৯০২ সালের ২ রা জুলাই মাত্র ৩৯ বছর বয়সে আমাদের ছেড়ে চলে যান না ফেরার দেশে। তিনি আজ নেই আমাদের মধ্যে,তবুও এ সমাজের অন্ধকার থেকে আলোয় ফেরা রাস্তা তিনি দেখিয়ে গেছেন। যতদিন তাঁর বাণী স্মরণ করবে নতুন প্রজন্ম, নতুন করে সংগ্রাম করার শক্তি ফিরে পাবে।




লেখক:

বটু কৃষ্ণ হালদার,৩২৭/৩ এম জি রোড, রোজি অ্যাপার্টমেন্ট, পোস্টআর সি ঠাকু রানী, হরিদেবপুর,কবরডাঙ্গা, কল-১০৪,




এই প্রবন্ধটি সংবাদ একলব্য সম্পাদনা করেনি, এই লেখার সম্পূর্ন দ্বায়ভার লেখকের ।