শ্রী গণেশের আট অবতার-জেনে নিন 

গণেশ



শুক্রবার গণেশ চতুর্থী। সিদ্ধি, বুদ্ধি, সম্পদ, সম্বৃদ্ধির এই দেবতা সমস্ত দেব-দেবীর মধ্যে সর্বপ্রথম পূজিত হন। মহাদেব ও পার্বতীর আদরের সন্তানকে বলা হয় শুভারম্ভের দেবতা। তাঁর অনেক নাম। তাঁর মূর্তি নির্মাণও বিভিন্নভাবে হয়। সবক্ষেত্রেই তাঁর হস্তিমুখ বর্তমান তবে, শুঁড়ের অবস্থান পালটায়—কোথাও তা সোজা, কোথাও বাঁদিকে বাঁকানো, কোথাও ডানদিকে। প্রত্যেকটির অর্থ আলাদা। যেমন---

গণেশ



বাঁদিকে শুঁড়

গণেশের হস্তিমুখের শুঁড় যদি বাঁ দিকে থাকে, তবে তা শান্তি ও আনন্দ নিয়ে আসে। একই সঙ্গে সম্পদ ও সমৃদ্ধির প্রতীক এই বামামুখী শুঁড়। এই গণেশের পুজোয় গৃহের শুদ্ধতা ও বাস্তুজনিত দোষের স্খালন ঘটে, পরিবারের বন্ধন শক্তিশালী হয়, মানুষ সুখী হয়। তাই গৃহস্থ তাদের পুজোয় বামামুখী গণেশেকে প্রাধান্য দেয়।

ডানদিকে শুঁড়

এই ভঙ্গীতে গণেশ খুব কম দেখা যায়। বিখ্যাত সিদ্ধি বিনায়ক মন্দিরে গণেশের শুঁড় ডানদিকে অবস্থান করে। শুঁড়ের এই ভঙ্গী মানে জাগতিক চাওয়া-পাওয়া থেকে মুক্তি বা মোক্ষ। তাই এই মুর্তির পুজো মন্দিরে হয়, বাড়িতে নয় কারণ জাগতিক আনন্দ থেকে পারিবারিক মানুষ সরতে পারে না। ডান দিকে শুঁড় থাকা গণেশকে বৈদিক মন্ত্র ও পদ্ধতি মেনে পুজো করতে হয়।

সোজা শুঁড়

এই ভঙ্গীর গণেশ নেই বললেই চলে তবে এর তাৎপর্য গভীর। এই ভঙ্গীর অর্থ, মানুষ তার সব ঐহিক বোধকে ফেলে রেখে এগিয়ে গেছে, আর কোনও বন্ধন নেই। এই গণেশের পুজো সাধারণ নিয়মেই হয়।


গণেশের আট অবতার

মহদেব এবং শ্রী বিষ্ণুর মতোই শ্রী গণেশও বিভিন্ন অবতার-রূপ ধারণ করেছিলেন জগতকে দুষ্টশক্তির হাত থেকে মুক্ত করে শান্তি স্থাপন করতে। বিভিন্ন অবতারের মধ্যে আটটি অবতার সবথেকে বেশি জনপ্রিয়। এ প্রসঙ্গে বিশেষভাবে জানা যায়, মুদগল পুরাণ ও উপপূরাণ থেকে। কোনও অবতারে তাঁর বাহন মযুর, কখনও ইঁদুর। মানুষকে তার আটটি প্রধান দোষ যেমন কাম, ক্রোধ, লোভ, মোহ, মদ, মাৎসর্য, অহঙ্কার, অজ্ঞানতা থেকে সুরক্ষিত রাখার জন্যই তাঁর এই অবতার রূপে আবির্ভাব।

বক্রতুণ্ড, একদন্ত, মহোদরা, গজানন, লম্বোদর, বিকট, বিঘ্নহর্তা বা বিঘ্নরাজা, ধূম্রবর্ণ।

১. বক্রতুণ্ড

এর আক্ষরিক অর্থ বাঁকা শুঁড়। এটি তাঁর প্রথম অবতার-জন্ম। এখানে তাঁর বাহন সিংহ। এই জন্মে তিনি মৎসরাসুরকে দমন করেন। মৎসরাসুর মহাদেবের ভক্ত এবং দেবগুরু শুক্রাচার্যের অননুমতি নিয়ে দেবতাদের ওপর অত্যাচার করছিলেন। প্রতীক অর্থে বলা হয়, বক্রতুণ্ড হয়ে তিনি মানুষের ঈর্ষা বা মাৎসর্যকে দমন করেছিলেন।

২. একদন্ত

এই অবতারে তাঁর চার হাত, একটি দাঁত, হাতির মাথা, বৃহৎ উদর। মাইথোলজি বলে, পরশুরামকে শিব-সাক্ষাতে যেতে দেননি গণেশ। দুজনের মধ্যে যুদ্ধ হলে পরশুরাম তাঁর পরশু গণেশকে ছুঁড়ে মারেন। গণেশ নিজেকে রক্ষা করতে পারতেন কিন্তু তিনি জানতেন এই পরশু স্বয়ং মহাদেবের উপহার। তাই একে সম্মান জানাতেই পরশুর আক্রমণ তিনি গ্রহণ করেন এবং তাঁর একটি দাঁত হারান। এই অবতারে তিনি মদাসুরকে পরাস্ত করেন। এই অসুর নিজের শক্তি প্রয়োগ করে দেবতাদের ওপর অত্যাচার করছিলেন।

৩. মহোদর

এই পর্বে তিনি মহাসুরকে ধ্বংস করেন। তাঁর বৃহৎ উদর, বাহন ছোটো ইঁদুর। এখানে তিনি বক্রতুণ্ড ও একদন্তর মিলিত রূপ। মিথ বলে, ভগবান কার্তিকেয় তারকাসুরকে বধ করলে শুক্রাচার্য মোহাসুরকে সৃ্ষ্টি করেন দেবলোক ধ্বংস করতে। তখন দেবতারা গণেশের আরাধনা করেন। তিনি এই অবতার রূপে মোহাসুরকে দমন করেন।

৪. গজানন

হস্তিমুখ এবং মানব-শরীর—এই অবতার-জন্মে এই রূপেই তাঁকে পাওয়া যায়। এই পর্বে তিনি লোভাসুরকে দমন করেন। তাঁর বাহন ইঁদুর। লোভাসুরের অত্যাচারে জর্জরিত দেবতারা গণেশ বন্দনা করেন। শ্রী বিষ্ণু দেবতাদের দূত হয়ে অসুরের সঙ্গে দেখা করেন, তাকে যুদ্ধের পথ থেকে সরে আসতে বলেন। অসুর আত্মসমর্পণ করে।

৫. লম্বোদর

মহাদেবের ক্রোধ থেকে জন্ম নেয় ক্রোধাসুর। সে সূর্যের উপাসক এবং বিশ্বের অধিপতি হবার বর পায়। তার অত্যাচার মাত্রা ছাড়ালে গণেশ এই অবতার-রূপ ধারণ করেন এবং অসুরকে দমন করেন। অন্যভাবে বলা যায়, ক্রোধের বশে মানুষ অনেক ভুল করে, তার থেকেই বাঁচিয়েছিলেন গণেশ এই অবতারে। গণেশের বৃহদাকার মান্যতা পায় এই রূপে।

৬. বিকট

এই অবতার রূপে তিনি কামাসুরকে বধ করেন। এই অসুরও এক সময় ত্রিলোকের সর্বাধিপতি হয়ে গেলে সকলেই প্রাণসংকটে পড়েন। ঋষি মুদগল দেবতাদের গণেশ পুজা করতে বলেন। সন্তুষ্ট হয়ে তাঁদের উদ্ধার করতেই বিকট অবতারে জন্ম নেন। এখানে তাঁর বাহন ময়ুর।

৭. বিঘ্নহর্তা বা বিঘ্নরাজা

এই অবতারে শ্রী গণেশের বাহন শেষনাগ। একবার মাতা পার্বতী সখীদের সঙ্গে আলাপচারিতার সময় কোনও একটি কথায় হেসে ওঠেন। সেই হাসি থেকে এক সুদর্শন পুরুষের আবির্ভাব হয়। পার্বতী তার নাম দেন মম এবং তাকে গণেশের পূজা করতে বলেন। মম বনে গিয়ে গণেশের আরাধনা শুরু করল। এমন সময়ে তার সঙ্গে সম্বর অসুরের সাক্ষাৎ হয়। তার কথায় মম পথভ্রষ্ট হয় ও ভয়ঙ্কর শক্তিশালী হয়ে তিনলোক জয় করে। তাঁর নাম হয় মমতাসুর। তখন শ্রী গণেশের আবির্ভাব হয় এবং বিঘ্নহর্তা রূপে তিনি মমতাসুরকে দমন করে ন্যায় ও শান্তি স্থাপন করেন।

৮. ধূম্রবর্ণ

এই অবতার রূপে তিনি অহংকারাসুরকে দমন করেন। সূর্যের বরদানে এই অসুর ভয়ঙ্কর শক্তিশালী হয়। অহংকার মানুষের ভেতরের এমন এক শক্তি যা সত্যের পথ থেকে তাকে সরিয়ে দেয়, চরম ক্ষতির মুখোমুখি হবার আগে পর্যন্ত সে এই অন্ধকার থেকে মুক্তি পায় না। অসুর দমনের মাধ্যমে গণেশ মানুষের ভেতরের অহঙ্কারকে নির্মূল করছিলেন এই অবতারে।

গণেশ চতুর্থী

ভাদ্র মাসের শুক্লপক্ষের চতুর্থী তিথিতে এই উৎসব শুরু হয়। ১০ দিন ধরে চলে। শেষ দিনকে বলে অনন্ত চতুর্দশী।

স্কন্দপূরাণ অনুযায়ী, দেবাদিদেব মহাদেব ও দেবী পার্বতীর পুত্র গণেশের জন্ম এই তিথিতেই হয়। তাঁর হস্তিমুখ নিয়ে একটি গল্প, গণেশের জন্মের সময়ে শনিদেব আশীর্বাদ করতে এলেও শিশুর মুখ দেখতে চাননি কিন্তু পার্বতী জোর করায় দেখেন এবং শিশুর মাথা ভস্মীভূত হয়। ক্রদ্ধ পার্বতীকে শান্ত করতে বিষ্ণু হাতির মাথা দিয়ে পার্বতীর পুত্রের প্রাণ ফেরালেও তাঁর দেব-সম্মান নিয়ে চিন্তিত ছিলেন পার্বতী। দেবতাদের সকলের সম্মতিতে এরপর গণেশ সিদ্ধির দেবতা হিসেবে স্বীকৃতি পান। সমস্ত শুভকাজে, এমনকী সবার আগে তাঁর পুজো হয়।

আর একটি গল্প—

পার্বতী স্নানের সময় গাত্রমল দিয়ে এক মূর্তি বানান ও তাতে প্রাণ প্রতিষ্ঠা করেন, নাম দেন গণেশ। তাঁকে দ্বার পাহারার কাজে নিযুক্ত করে তিনি নিজের কাজে মন দেন। এরপর শিব সেখানে আসেন কিন্তু গণেশ তাঁকে ঢুকতে না দিলে শিব গণেশের মাথা কেটে ফেলেন। পার্বতী জানতে পেরে ক্রুদ্ধ হন, এরপর শিব তাঁর অনুচরদের বলেন উত্তর দিকে মাথা করে শুয়ে থাকা প্রাণীর মাথা কেটে আনতে। একটি ছোটো হাতি সেখানে ছিল, তার মাথাই কাটা হয়। তা গণেশের মাথায় বসিয়ে প্রাণ সঞ্চার করা হয় গণেশের।

মহারাষ্ট্রসহ ভারতের বিভিন্ন রাজ্য জাঁকজমকের সঙ্গে গণেশ উৎসব পালিত হয়। করোনার কারণে নিয়মের কড়াকড়ি এবারেও আছে তবে পুজোর নিষ্ঠা ও আনন্দ তাতে কমবে না।

আর--গণেশ আসছেন, মানে মা-ও আসছেন।

সবাইকে গণেশ চতুর্থীর শুভেচ্ছা।