যোগ কোনও ধর্ম নয়, আন্তর্জাতিক যোগ দিবসে জানুন অজানা যোগচর্চা




আধুনিক বিজ্ঞানের উন্নতির সাথে সাথে থেমে গেছে দৈহিক শ্রম, বেঁচে যাচ্ছে সময়, কমছে ঝুঁকি, কমছে শ্রমের যন্ত্রনা। দিন যতই গড়াচ্ছে ততই সেই পরিস্থিতি বেড়েই। সভ্যতার অগ্রগতিতে টেকনোলজি নির্ভর জীবনে পা দিয়েছে মানব জাতি, ব্যস্ত থাকছে ল্যাপটপ বা মোবাইলে বা ট্যাবে। মেশিনকে কাজে লাগিয়ে শরীরে ফিরছে আরাম আয়েস আর যার জেরেই সুস্থ থাকতে মানুষ ব্যর্থ হয়ে পড়ছে। সেই ব্যর্থতা থেকে রেহাই পেতে শরীরচর্চা বা ব্যায়াম খুবই প্রয়োজনীয়। তাছাড়াও, দৈহিক পরিশ্রম করলেও দেহের অভ্যন্তরীণ অঙ্গকে সুস্থ রাখতে শরীরচর্চা জরুরী নাহলে এক সময় পেশি বিপর্যস্ত হওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হতে পারে। সভ্যতার শুরু থেকেই দেহের শক্তির জন্য শরীরচর্চা এবং সুস্বাস্থ্যের অধিকারী করতে যোগ ব্যায়ামের সূত্রপাত ঘটে। আজ থেকে প্রায় পাচ হাজার বছর আগে দ্রাবিড় সাধকেরা যোগ ব্যায়াম উদ্ভাবন করেন। দ্রাবিড় সভ্যতা থেকে ব্যবিলনীয় সভ্যতাতেও যোগচর্চা ও শরীরচর্চা ছিল শিক্ষার প্রধান অঙ্গ। প্রাচীনকালে শরীরকে সুস্থ রাখতে মানুষ যোগ-কেই বেছে নিয়েছিল। এছাড়াও একাধিক রোগের সাথে লড়াই করতেও যোগ বিশেষ ভূমিকা নিয়ে থাকে। হাঁপানি, ডায়াবেটিসসহ একাধিক রোগকে নিরাময়ে যোগ ব্যায়ামের উপকারিতা ছড়িয়ে পড়ছে মানুষও ধীরে ধীরে যোগ ব্যায়ামের প্রতি আগ্রহী হয়ে উঠছে।




অস্তিত্বের একক অনুভব করাকে যোগ বলে। যোগী তাঁদের বলা হয় যারা স্বাধীন অবস্থায় মুক্তি, নির্বাণ বা মোক্ষ হিসেবে সাধিত হয়। যোগ একটি আধাত্মিক সুক্ষ্ম বিজ্ঞান, যা মন ও শরীরের সাদৃশ্য স্থাপনে গুরুত্ব দেয়। দক্ষতা এবং স্বাস্থ্যকর জীবন যাত্রার বিজ্ঞান।


যোগ শব্দটি এসেছে সংস্কৃত শব্দ যুজ থেকে যার অর্থ সংযোগ। যোগ ব্যায়াম একটি শারীরিক, মানসিক, আধাত্মিক অনুশীলন। জীবন, স্বাস্থ্য ও সম্প্রীতির সর্বস্তরে স্বাধীনতার সঙ্গে বসবাসই হল যোগচর্চার মূল উদ্দেশ্য। যোগের লক্ষ্য হল আত্মপোলব্ধি যার মাধ্যমে সব ধরনের কষ্টভোগকে পরাস্ত করা যায়। যোগ হল অদম্য ইচ্ছার চাষ। যোগচর্চা আত্মনিয়ন্ত্রন, আত্মবিশ্বাস এবং স্বপ্রভুত্ব বাড়ায়। স্বাধীন বিচার ক্ষমতা বাড়ায়। বিতর্ক এড়াতেও সাহায্য করে যোগ।




যোগ ব্যায়ামের উদ্ভব প্রাক বৈদিক যুগে যা ভারতীয় ঐতিহ্যের ইতিহাস থেকে অনুমান করা হয়। কিন্তু সম্ভবত খ্রিস্টপূর্ব পঞ্চম ও ষষ্ট শতাব্দীর আশেপাশে ভারতের তপস্বী এবং শ্রমণ আন্দোলনের সময় উদ্ভব হয়। ভারতবর্ষে যোগের প্রসারতা লাভ করে প্রথম সহস্রাব্দের প্রথম দিকে ঋষি পতঞ্জলির হাত ধরে।




যোগের সুযোগ বা বৃস্তৃতি ভগবতগীতা ও উপনিষদে ব্যাপকভাবে বিস্তারিত বর্ণনা রয়েছে। ভারতবর্ষে যোগ গুরু স্বামী বিবেকানন্দের সাফল্যে পশ্চিমের দেশ গুলিতে আটের উনবিংশ শতাব্দীর শেষের দিকে এবং বিংশ শতাব্দীর শুরুর দিকে সূত্রপাত ঘটে। যোগ ব্যায়াম আটের দশকে পশ্চিমের দেশ গুলোতে শারীরিক ব্যায়াম হিসেবে প্রাধান্য পেয়েছিল।


স্বামী বিবেকানন্দ বলেছিলেন, "এটি একটি একক জীবন বা কয়েক মাস বা এমনকি কয়েক ঘণ্টার শারীরিক অস্তিত্ব যা একজনের বিবর্তন সংকোচনশীল একটি মাধ্যম।"



"It is a means o compressing one's evolution into a single life or a few months or even a few hours of one's bodily existence"
- Swami Vivekananda



যোগ একটি ব্যবহারিক দিক, কোনও ধর্ম নয়। যোগ শরীর, মন ও আত্মার বিকাশের একটা সমন্বয়পূর্ণ পদ্ধতি, একটি প্রাচীন কলা বা দক্ষতা। যোগ ব্যায়াম মনে শান্তি প্রদান করে এবং পরিবেশে নিজেকে মঙ্গলময় রাখতে সাহায্য করে। এছাড়াও যোগের বিভিন্ন ঐতিহ্যগত সংজ্ঞা রয়েছে। যেমন- যোগ হল মানসিক অবস্থার নিয়ন্ত্রন, যোগ হল চিরবৃত্তি নিরোধের উপায়, যোগ হল সমাধি, যোগ হল পরম আত্মার সাথে জীবাত্মার মিলন। দেহ, মন ও আত্মার সুসংহত ও সামগ্রিক উন্নতি সাধনের প্রক্রিয়া হল যোগ।




যোগ-কে অনেকে ধর্ম বলে মনে করলেও তা একটি ভুল ধারনা। যোগ আসলে কোনও ধর্ম নয় বা ধর্ম প্রচারের গোপন পথও নয়। যদিও যোগ প্রাচীন ভারতবর্ষ থেকে উদ্ভব হয়েছিল তবে এটি হিন্দুধর্মের স্বরূপ বা ফর্ম নয়। হিন্দু, মুসলমান, খ্রিস্টান, বৌদ্ধ, ইহুদি, নাস্তিক আনন্দের সাথে চর্চা করে থাকে। যোগের একটা আধাত্মিক দিক ঠিকই রয়েছে কিন্তু কারও কোনও বিশ্বাসের স্বাক্ষর বহন করে না। যদি কেউ কোনও শব্দ উচ্চারন করে যোগ করে তবে মনে করার কিছুই নেই কারণ যোগ একটি মানসিক বিষয়।


ভারতবর্ষের বেশির ভাগ মানুষ সিদ্ধি, জাদু, মন্ত্রতন্ত্র ইত্যাদিকে যোগ বলে মনে করে কিন্তু এগুলো যোগ নয়। যোগ একটি সম্পূর্ণ প্রক্রিয়া বা উন্নত বিজ্ঞান বা জীবনের একটি উপায় যা লিঙ্গ, পেশা, রাষ্ট্র, শর্ত, সমস্যা, দুর্ভোগের ওপর প্রয়োগ করা যেতে পারে। এমনকি যোগ ব্যক্তিত্ব, পেশাদারি, সামাজিক ক্ষেত্রেও প্রয়োগ করা যেতে পারে।


যোগের ভিত্তি হল সুখের জন্য অনুসন্ধান করা। সুখ আমাদের মধ্যে অবস্থিত। এটি মনকে নীরব করে। এটি চিন্তা ভাবনা বর্জিত অবস্থা। এটি স্বর্গবাস, স্বাধীনতা, জ্ঞান ও সৃজনশীলতা মূলক একটি অবস্থা।


কিছু মানসিক কারণে যোগের উৎপত্তি। কারণ গুলি হল- সুখ প্রবৃত্তি দুঃখ নিবৃত্তি, জীবনের বাস্তবতা ও নিজের সম্বন্ধে জানার কৌতূহল।


যোগ ব্যায়াম ব্যক্তিত্বের পূর্ণাঙ্গ বিকাশের একটি প্রক্রিয়া। যোগ ব্যায়ামের উপকারিতা অবিরম ও অসীম।


২১ জুন আন্তর্জাতিক যোগ দিবস। ২০১৪ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর রাষ্ট্রসংঘে ভাষণ দেওয়ার সময় ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী ২১ জুন তারিখটিকে আন্তর্জাতিক যোগ দিবস বলে ঘোষণা করার প্রস্তাব দেন। সেই বছরই প্রধানমন্ত্রী মোদীর সেই প্রস্তাবকে সায় দিয়ে ১১ ডিসেম্বর রাষ্ট্রসংঘ সাধারণ পরিষদ ২১ জুন তারিখটিকে আন্তর্জাতিক যোগ দিবস বলে ঘোষণা করেন।


বিশ্বব্যাপী স্বাস্থ্য, সাদৃশ্য এবং শান্তির জন্য জাতিসংঘ-এর সরকারি প্রচার এই দিনটির তাৎপর্য। যোগ, ধ্যান, সম্মেলন, আলোচনা, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে এই দিনটি পালিত হয়। বিশ্বব্যাপী মানুষ এই দিনটিকে পালন করছে শরীর ও মনকে সুস্থ রাখার প্রচেষ্টায়। করোনার ভয়াল থাবাতেও গত বছর মানুষ যোগ দিবস বাড়ি বসেই পালন করেছে আর এবছরেও ঠিক তাই। অতিমারি কালে জমায়েত এড়িয়েই পালিত হবে আন্তর্জাতিক যোগ দিবস।



Yoga is an invaluable gift of India's ancient tradition. It embodies unity of mind and body; thought and action; restraint and fulfillment; harmony between man and nature; a holistic approach to health and well-being. It is not about exercise but to discover the sense of oneness with yourself, the world and the nature. By changing our lifestyle and creating consciousness, it can help in well being. Let us work towards adopting an International Yoga Day.
— Narendra Modi, UN General Assembly