কোচবিহারের  প্রাচীন এক মদন মোহন মন্দিরের কথা- আজও কয়েক শতাব্দীর স্মৃতি আঁকড়ে দাঁড়িয়ে আছে  




কোচবিহারের দেব-দেউলের অধিকাংশেরই প্রতিষ্ঠা রাজবধূদের হাতেই — যা আজও অসংখ্য ভক্ত সমাগমে মুখরিত থাকে । তবে রাজপরিবারের পাশাপাশি ব্যক্তিগত উদ্যোগেও বেশ কিছু মন্দির গড়ে ওঠে কোচ রাজ আমলে- যা আজও বর্তমান। তেমনি ব্যক্তিগত উদ্যোগে গড়ে ওঠা ফলনাপুরের মদনমোহন মন্দির-যা আজ সম্পূর্ণ ধ্বংশের মুখে দাঁড়িয়ে। 




ইতিহাস বলে কোচবিহারে মহারাজা নরনারায়ণের আমল থেকেই কোচবিহারে মদন মোহন এর পূজারম্ভ হয়। তাই স্বাভাবিক ভাবেই ফলনাপুর গ্রামের মদনমোহন মন্দির মহারাজা নরনারায়ণের সময়কালীন বা তার পরে প্রতিষ্ঠিত । সঠিক কোন তথ্যের সন্ধান পাওয়া যায়না- যার ফলে এই মন্দিরের প্রতিষ্ঠার সঠিক সময় জানা যায়নি। 



ফলনাপুর একসময় কোচবিহার রাজ্যের অধীনে থাকলেও পরবর্তিতে দেশভাগের সময় থেকে ছিট মহলের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যায়। ২০১৫-তে ভারত-বাংলাদেশ ছিটমহল বিনিময় চুক্তি অনুযায়ী ফলনাপুর ভারতের অন্তর্ভুক্ত হয়। এই ফলনাপুরে যেতে প্রথমে মাথাভাঙ্গা থেকে জটামারী যেতে হবে, সেখান থেকে খলিসামারি, তারপর সাঙ্গারবাড়ি বাজার- এখান থেকে ২ কি.মি. দূরত্বে অবস্থিত ফলনাপুরের ভগ্নপ্রায় মদনমোহন মন্দির। 



তবে ফলনাপুরে দুজন জোতদারের কথা জানা যায়। একজন সুরবালা দেবী অপরজন প্যারিমোহন রায় চৌধুরী। প্যারিমোহন রায় চৌধুরীর স্ত্রী মনোরমা দেবী চৌধুরানী কোচ রাজপরিবারের সাথে সম্পর্কিত ছিলেন বলে জানা গেছে। 



ফলনাপুরের এই ভগ্ন মন্দির সুরবালা দেবীর আওতাধীন। সুরবালা দেবীর বিয়ে হয় বর্তমান বাংলাদেশের গোতামারীর উপেন্দ্রনাথ রায়ের সাথে । বিয়ের পর তিনি ঘরজামাই হিসাবে ফলনাপুরে থেকে যান। বর্তমানে তাঁদের বংশধর কোচবিহার শহর এবং মাথাভাঙ্গায় রয়েছেন। 


দ্বিতল বিশিষ্ট এই মন্দির বেশ কয়েকটি দিক থেকে তাৎপর্যপূর্ণ ।


প্রথমত যে সময় সমগ্র কোচবিহার জুড়ে রাজ পরিবার কতৃক দেব দেউল প্রতিষ্ঠার কথা শোনা যায় সে সময়কালে ব্যক্তিগত উদ্যোগে এতো বড় আকৃতির মন্দিরের সন্ধান কোচবিহারে দ্বিতিয়টি নেই। 



দ্বিতিয়ত কোচবিহারে দ্বিতল বিশিষ্ট মন্দির আর কোথায় দেখা যায় না। 




প্রসঙ্গত গোবরাছড়ায় মোস্তাফিদের ছিটে বানিয়াদহ নদীর কিনারে একটি শিবমন্দির দেখা যায় যেখানে সমগ্র মন্দির জুড়ে রয়েছে টেরাকোটার কাজ। আর ফলনাপুরে বুড়ি ধরলার পাশে অবস্থিত এই মন্দিরে বালুমাটির কারুকার্য লক্ষ্য করা যায়। মন্দিরের গায়ে বিভিন্ন নক্সার কাজ দেখা যায়, সাথে কিছু দেওয়াল চিত্র। কয়েকবছর আগেও মন্দিরের গর্ভগৃহে ধনু হাতে রামের বালুমাটিতে তৈরি দেওয়ালচিত্র ছিল যা বর্তমানে ধ্বসে পড়েছে। 


হাতে তৈরি ইট আর চুন দ্বারা সমগ্র মন্দিরটি নির্মিত। মন্দিরের গর্ভগৃহ রয়েছে। সেখানে দক্ষিণমুখি একটি দরজা আর একটি পূর্বমুখি দরজা রয়েছে। পূর্বমুখি দরজাটির সামনের দিকেই বুড়ি ধরলা। সম্ভবত এই গর্ভগৃহে শিবপূজা হতো (স্থানীয় সূত্রে জানাগেছে) । এই গর্ভগৃহের উপরেই রয়েছে মদন মোহন মন্দিরটি। 



সিড়ি বেয়ে উঠতে হতো এখানে। বর্তমানে সিড়িটি নেই। তবে বাঁশ আর কাঠ দিয়ে একটি অস্থায়ী সিড়ি বানানো হয়েছে নিত্যপূজার জন্য। 


মূল মন্দিরটির দক্ষিণ বারান্দা রয়েছে। জানাযায় এখানে কীর্তন হতো। এই মন্দিরের ৩০-৪০ ফুট দূরত্বে একটি ইন্দিরা বা কুয়ো পরিত্যাক্ত অবস্থায় রয়েছে। 




বর্তমানে মানবী বর্মন এই মন্দিরে নিত্য পূজা করেন। মানবী বর্মন জানান জন্মাষ্টমী, রাধাষ্টমী পালনের সাথে সাথে এখন মনসাপূজাও করা হয় এই মন্দিরে। 


লোকমুখে প্রচলিত একসময় মাথাভাঙ্গা শহর থেকে এই মন্দিরের চূড়া দেখা যেতো। কিন্তু ৪০ থেকে ৫০ ফুট উচ্চতার এই মন্দির আজ কালগর্ভে হারিয়ে যেতে বসেছে লোকচক্ষুর আড়ালেই। 


লেখকঃ সম্রাট দাস
ছবিঃ তপন বর্মণ 

তথ্যসূত্রঃ
সাক্ষাৎকার- ১। গৌতম রায় চৌধুরী (৫৫), সাঙ্গারবাড়ি, মহিষমুড়ি  ২। মানবী বর্মন (৩০)- ফলনাপুর  ৩। নারায়ণ বর্মন- (৩৭)-ফলনাপুর