প্রতিটি দেশে স্বাধীনতা পেতে যত রক্ত ঝড়েছে তা মাপার কোন যন্ত্র পৃথিবীতে এখন হয়নি



ঝুটন বর্মণ 

(ভুমিকা, বিশ্বের ইতিহাসে স্বাধীনাতা লড়াই, ভারতের ইতিহাসে স্বাধীনাতা লড়াইয়ের কারন, বিজ্ঞান ও নতুন প্রজন্মের ভুমিকা, স্বাধীনাতার আগে ও পরে, উপসংহার)


“স্বাধীনতার হীনতায় কে বাঁচিতে চায় হে, কে বাঁচিতে চায়।“

** উন্মুক্ত এই বিশাল আকাশে সুখ পাখির মত ডানা মেলে উড়তে কে না চাইবে? দিগন্তে বিস্তিত দিগন্ত রেখা যেন পৃথিবীর ধরাতলে মিলে যাচ্ছে। ছোট ছোট দুই চার পায়ী প্রাণীরা চলাফেরা করছে কখনবা আঁকাবাঁকা পথে, কখনবা মাঠে, কখনবা ইমারতে ঢাকা শহরে। সেই খোলা আকাশ, সেই খোলা বাতাস যদি কাছে থেকেও থাকে দূরে, যদি নিজের হয়েও কৈফত দিতে হয় পরের কাছে। তবে সেই শাসন-শোষণ কে ভোগ করবে? তবে সেই পরাধীনতা কে মাথা পেতে নেবে। “স্বাধীনাতার হীনতায় …।” 

সেই উন্মুক্ত আকাশে সুখ পাখির মত ডানা মেলে, সেই বসন্তের ককিলের মত মিষ্টি শুরে গান গাওয়া কত যে কঠিন, কত যে ভয়ানক তা মানুষ্য সমাজের ইতিহাস পরলে জানা যায়। কক্ষন তা কবি সাহিত্যিক দ্বারা ভাব ঘুরে প্রকাশ পেয়েছে, কক্ষন বা নিষ্ঠুর নির্মম সত্য ফুটে উঠেছে আবার কক্ষন বা ইতিহাসবিদ, রাজনীতিবিদের লেখা বই এর মধ্যেও প্রকাশ পেয়েছে। 

** সপ্তদশ, অষ্টদশ, এবং উনবিংশ শতকে দক্ষিণ এশিয়া, দক্ষিণ আফ্রিকা, এবং দক্ষিণ আমেরিকার প্রায় সমস্ত দেশ ইউরোপের কোন না কোন দেশ দ্বারা শাসিত হত, যদিওবা বেশির ভাগেই উপনিবেশিক শাসন ছিল। আবার কক্ষন কক্ষন বা রাজা রানীর দ্বারাও শাসিত ছিল। কিন্তু সেই শাসন কেমন ছিল সেটাই লক্ষ করার বিষয়। যদি সেই শাসন ব্যবস্থা ভালো হত তবে কি উক্ত শোষিত দেশের মানুষগুলি কক্ষন বিদ্রহ করত? শত প্রশ্ন জাগে, বিদ্রহ কেমন ছিল? কেনই বা বিদ্রহ? বিদ্রহের নমুনা কি? ইত্যাদি ইত্যাদি। চিনে লং মার্চ, ভারতের ভারত ছাড়, দক্ষিণ আফ্রিকার বর্ণ বিদ্বেষী লড়াই, এছাড়াও দুর্ভিক্ষ মহামারী তো লেগেই আছে। তাছাড়াও কক্ষন বা খাদ্যের অভাব, কক্ষন বা অপ্রতিরোধ্য রোগ অপর দিকে রক্ত চোষা শাসকদের অত্যাচার ইত্যাদি ইত্যাদি ঘটনা ঘটলে মানুষ বাধ্য হয়েছিল বিদ্রহ করতে। বিশেষ করে উনবিংশ শতকে এবং বিংশ শতকের গোঁড়ার দিকে তা চরম আকার ধারন করে নেয় এবং এই সময় যখন বিদেশ ফেরত অনেক বুদ্ধিজীবী মানুষের আবির্ভাব ঘটতে থাকে। যাইহোক স্বাধীনাতা পেয়েছি আমরা কিন্তু অনেক রক্ত ক্ষরণ ও অনেক ত্যাগ স্বিকারের পর। 

** অন্য অনেক দেশের মত আমাদের এই মহান দেশ যেখানে প্রতিটি জীব ও প্রাণীকে দেবতা হিসাবে ধরা হয় “অথিতি দেবঃ ভবঃ” হিসাবে মানা হয়, যে দেশে যখন বিদ্যাচর্চা হত, গুরুকুল ছিল যে দেশে রামায়ন, মহাভারত, বেদ, এর মত মহাকাব্য ও ধর্মীয় বই লিখিত হয়েছিল তখন বিশ্বের অন্য সকল দেশের মানুষ নিজের পশুত্য ছাড়তে পারেনি বন জঙ্গলে ঘুরে বেড়াত। যে দেশে অর্থ ও সম্পত্তি এত বেশি ছিল যে উক্ত দেশকে “সোনার চিড়িয়া” বলা হত। সেই দেশ পরাধীন ছিল ইংরেজ সরকার দ্বারা। 

অন্য অনেক দেশের অনেক কারনের মত ভারতের স্বাধীনাতা লড়াইয়ের অনেক কারন ছিল। যেগুলি বাধ্য করেছিল প্রতিটি মানুষকে স্বাধীনাতা পাওয়ার জন্যে বিদ্রহ করতে। কারণগুলি বললে শেষ হবে না তার পরেও অনেক কারন ছিল যেগুলি শুনলে আজেও ভারতীয়দের গায়ের রক্ত গরম হয়ে উঠে। সেগুলি হল- 

ইংরেজদের এক নাইট ক্লাবের বাইরে লেখা ছিল ‘কুকুর ও ভারতীয়দের প্রবেশ নিষেধ’। এই কথাটির মানে কি? যদি কোন ভারতীয়দের কানে এই কথাটি যায় তবে তার ফল কি হতে পারে? 

যেখানে মানুষের খাদ্যের অভাব কিন্তু দু-টুকুর রুটি ও এক মুট ভাতের সঙ্গে কোন সব্জি মেলা ভার সেখানে লবনেই এক মাত্র সম্বল। সেখানে লবনের মত অতি নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিষ এবং সহজলভ্য জিনিষের কর যদি তিনগুনের চেয়েও বেশি করা হয় তবে তার ফল কি হবে? 

কোন মিছিলে যদি কোন দেশের প্রশাসন নির্বিচারে গুলি চালায় তবে তার ফল কি হবে? যেমনটি জালিয়ানওয়ালা বাগ হত্যাকাণ্ডে হয়েছিল। 

কি হবে যদি কোন কৃষককে এমন কিছু করতে বাধ্য করা হয় যেখানে চাষাবাদ করতে কোন লাভ হয় না অপরপক্ষে ক্ষতিই হয়। আবার সেটা এমন কিছু ফসল যা খাওয়া যাবে না আবার নিজের প্রয়জনেও লাগবে না। যেখানে খাওয়ার অভাব, দু বেলা খাওয়ার জোটে না সেখানে খাবার ফসল ছাড়া অন্য অখাদ্য ফসলের চাষাবাদ করার কথা ভাবাই যায়না। এখানে নীল চাষের কথা বলা হচ্ছে। ভারতের ইতিহাসে এই নীল চাষ খুবেই গুরুত্ব পূর্ণ ভুমিকা পালন করে। দ্বীনবন্ধু মিত্রের ‘নীল দর্পণ’ পরলে তা জানা যায়। 

কেমন হয় যদি আপনার দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে কেউ আপনাকে ঠকাতে থাকে। ছোট ছোট পাথরের টুকরো যেগুলির ওজন একশো গ্রামের মত হবে সেগুলিকে সিদুর, চন্দন লাগিয়ে এক কেজির মত করা হলে এবং নিয়মিত ওজনে কম দিলে। 

কি হবে যদি নিজের মা বোন কে ধর্ষণ হতে দেখতে হয়। 

বললে শেষ হবে না শত কারন এক এক করে জমা হতে থাকে। ছোট ছোট পাথরের টুকরো জমা হতে হতে যেমন পাহারে পরিনত হয় তেমনি একটি একটি সমস্যা জমা হতে হতে অনেক বড় সমস্যায় পরিনত হতে থাকে যার ফলস্বরূপ বিদ্রহ শুরু হয়। 

** বিজ্ঞান যখন জৈবনপ্রাপ্ত, বিজ্ঞান ক্লাসিক মেকানিস্ক থেকে কোয়ান্টাম মেকানিস্ক এর দিকে ঝুকছে সমাজের বিভিন্ন ধারণের সমস্যা থেকে সমাধানের জন্যে বিজ্ঞান নতুন নতুন আবষ্কার করতে শুরু করেছে। ঠিক তখনি অনেক ভালো ভালো আবিষ্কারের মধ্যে ধ্বংসাত্মক আবিষ্কার শুরু হয়ে যায়। ধর্মীয় কুসংস্কার থেকে মানুষ মুক্তির সাধ খুজতে শুরু করে বিজ্ঞান ও নতুন নতুন পথের সন্ধানের দিকে মনোনিবেশ করে। এই সময় বিদেশি শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে বহু ভারতীয় দেশে ফিড়তে থাকে। দেশের সমাজ ও রাজনীতিতে এক নতুন রাস্তা দেখাচ্ছিল। ধর্মের সেই “অথিতি দেবঃ ভবঃ” এবং “ভিক্ষাং দেহি” ছেড়ে বহু ধর্মীয় গুরু বেদ, উপনিষদ, গীতা পাঠ করে সমাজকে এবং নতুন প্রজন্মকে উদ্ভুদ করতে থাকে। দেশে এক নতুন হাওয়া উঠে তা হল স্বাধীনাতার হাওয়া। “করেঙ্গে ইয়ে মরেঙ্গে”। 

** গৌতম বুদ্ধ-এর মতে ‘পৃথিবীতে আজ পর্যন্ত যত অশ্রু ঝড়েছে তা সমুদ্রের জল অপেক্ষা অনেক বেশি।’ ঠিক তেমনি প্রতিটি দেশ স্বাধীনতা পেতে যত রক্ত ঝড়েছে তা মাপার কোন যন্ত্র পৃথিবীতে এখন হয়নি। 

“নদীর এপার কহে ছাড়িয়ে নিঃশ্বাস, 

ও পারেতে সর্ব সুখ আমার বিশ্বাস; 

নদীর ওপার বসি দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে, 

কহে, যাহা কিছু সুখ সকলি ওপারে।” 


পূর্ব পুরুষদের ত্যগস্বিকার স্বাধীনাতা দিয়েছে আমাদের, স্বাধীন হয়েছি আমরা। অনেক সুখে আছি। রাজনৈতিক প্রতিদিনের পালাবদল সমাজে অশিক্ষিত মানুষদের ভুল জ্ঞান সমাজকে যেন কোণঠাসা করে রেখেছে। স্বার্থের জন্যে সমাজ যেন একমুখী করন হয়ে যাচ্ছে। অপরদিকে পিছিয়ে পড়া মানুষরা সমাজের কাছে বেঁচে থাকাই যেন কষ্টকর হয়ে যাচ্ছে। আমাদের দেশ তথা ভরত বর্ষের অনেক বড় আয়তন এবং প্রচুর লোকসংখ্যা তাছাড়া অসংখ্য ভাষাভাষী এবং অসংখ্য সংস্কৃতির মানুষের বাস তাই সবাইকে সন্তুষ্ট রাখা খুবেই কঠিন। এমত অবস্থায় প্রকৃত সুখ খুব কম মানুষে পেয়ে থাকে। তাই আত্মহত্যার ঘটনা দিন দিন বেড়েই যাচ্ছে আমাদের দেশে। ভারত “সার্বভৌম সমাজতান্ত্রিক ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক সাধারনতন্ত্র” রুপে পরিনতি হয়েছি। না জানি কতটা সার্থক, কতটা স্বাধীন হয়েছি। 

** পরিশেষে জাতি ধর্ম বর্ণ লিঙ্গ নির্বিশেষে সবাই আমরা মানুষ এবং ভারতীয়। সবাই সবার মত জীবন কাটাতে চাই। এই স্বাধীন দেশে সবারি যেন স্বাধীনাতা মেলে। শুধু মানুষ নয় অন্য জীব প্রাণীদেরও যেন স্বাধীনাতা মেলে এটাই কাম্য। 

“চিত্ত যেথা ভয়শুন্য উচ্চ যেথা শির”