আমিত্ববোধ ছেড়ে আমাদের শব্দটা বেশি জোরালো হয়ে ওঠে তবেই প্রকৃত স্বাধীনতার আস্বাদ পাবো
মুকুলিকা দাস
স্বাধীনতা একটি শর্ত, যেখানে একটি জাতি, দেশ বা রাষ্ট্র বা জায়গা যেখানে জনগণ থাকবে, নিজস্ব শাসনব্যবস্থা, এবং সাধারণত কোন অঞ্চলের সার্বভৌমত্ব থাকবে। স্বাধীনতার বিপরীত হচ্ছে পরাধীনতা. স্বাধীনতা মানে যা খুশি তা করা নয়। আরও পড়ুনঃ আগামী নভেম্বর ২০২০ পর্যন্ত বিদ্যালয়গুলিতে মিড ডে মিলে খাদ্য সামগ্রী বিতরণের নির্দেশিকা
এ তো খুব সংক্ষেপে স্বাধীনতাকে ছুঁয়ে যাওয়া মাত্র। ১৯৪৭ সালের ১৫ আগস্টের পর ৭৩ বছর পেরিয়ে এসে চিরকালীন একটা প্রশ্নই হয়তো সবার মনে মাথা চাড়া দেয়। আসলেই কি আমরা স্বাধীন?
স্বাধীনতার কয়েকটি দিক আলাদা করে বলা যাক। প্রথমেই বাকস্বাধীনতা। মানে আমি যেটা ভাবছি, উপলব্ধি করছি সেটা মন খুলে জানান দেওয়া। বর্তমানের ভার্চুয়াল জগতে নিজেকে প্রকাশ করার অঢেল সুযোগ আমাদের কাছে। তাই একটা বিষয় নিয়েই যখন তখন তরজা চলে, খাপ বসে, মিমের মাধ্যমে ইয়ার্কির মাত্রা ছাড়িয়ে স্বেচ্ছাচারিতা চলে। দুপক্ষের বাগবিতণ্ডা বাড়ে, বাড়তে থাকে লাইক, কমেন্ট, রিয়েকশন! আর মাঝখান দিয়ে চাপা পড়ে যায় আসল বক্তব্য! বাজার চলতি বিষয়ে বক্তব্যের ঝড় ওঠে, মানুষ জনপ্রিয়তা পায়, আর চিরকালীন যে ক্ষতের বোঝা, তাতে ঘা বাড়তে থাকে প্রতিনিয়ত। হ্যাঁ, এটাই সত্যি যে রাজনীতি, ধর্ম, কুশিক্ষা, সামাজিক বৈষম্য, নারীদের প্রতি অত্যাচার- এই চিরকালের সমস্যাগুলো কিন্তু সমাধান পায় না। কারণ প্রকৃত সমস্যা নিয়ে কথা বলতে আমরা ভয় পাই, বাকস্বাধীনতার দোহাই দিয়ে বাম-ডান, গেরুয়া-সবুজ, আযান-কীর্তন, নারীবাদ-পুরুষবাদ এসবই চলতে থাকে, সমাধান কোথায়?
এরপর আসি ব্যক্তিস্বাধীনতায়। সোজা বাংলা ভাষায় আমার ব্যক্তিগত জীবন-যাপনে বাঁধা আসবে না। সমাজ আমাকে আটকাতে পারে না। সে দিক দিয়ে কি আমরা স্বাধীন? আজো এখানে সাদা-কালো চামড়ার বিভেদ চলে, স্থূল মেয়েকে নিয়ে মিম বসে, মাতৃভাষায় কথা বললে তার শিক্ষাগত যোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে, ইঞ্জিনিয়ারিং পড়া ছেলেটা লেখক হতে চাইলেও দোষ আবার সাফল্য অর্জন করলে সেখানে তার চরিত্র নিয়ে প্রশ্ন। পোশাকের মাপকাঠিতে ধর্ষণ হবে কি না বিচার হয়। তৃতীয় লিঙ্গের মানুষের জীবন-যাপন দেখে একদলা থুতু উঠে আসে, আবার নাক শিঁটকানো হয় সমকামীদের দেখে। এখানে ধর্ম, গোত্র, অর্থ দেখে বিয়ে হয়, বিরোধিতা করলেই সমাজ বিচ্যুত কিংবা সম্মান রক্ষার্থে হত্যা। এখনো লিভ ইন নিয়ে যেমন প্রশ্ন ওঠে যেমন তেমনি সংসারে মন দেওয়া গৃহবধূর অস্তিত্ব নিয়েও প্রশ্ন করা হয়। প্রশ্ন করা হয় বেকার ছেলের বেঁচে থাকা নিয়ে, তার নামের পর টাইটেল নিয়ে, তার গায়ের গেঁয়ো গন্ধটা নিয়ে। প্রশ্ন তোলা হয় নর্থ-ইস্টের মানুষেরা ভারতীয় কি না তা নিয়ে! যে মেয়ে কেরিয়ারের সিঁড়িতে নিজেকে ব্যবহার করে তাকে নিয়ে প্রশ্ন ওঠে আবার প্রশ্ন ওঠে বেশ্যাদের নিয়েও। আরো হাজারি রকম প্রশ্ন এখানে। আবার ব্যক্তিস্বাধীনতার নামে চলে বেলেল্লাপনা, অর্থের জোরে তারা ছাড় পেয়ে যায়। মধ্যবিত্তের ছেলে-মেয়েদের স্বপ্ন চাপা পড়তে থাকে সংঘর্ষের জেরে আর গরীবেরা...তারা ধূসর জীবনেই খুশি থাকে, স্বপ্ন দেখা তাদের কাছে বিলাসিতা।
এরপর ও কি আমরা ব্যক্তিস্বাধীন বলতে পারি নিজেদের?
ভারতবর্ষ ধর্মনিরপেক্ষ। অথচ নামের আগে ও পরে শুনে মানুষটিকে বিচার করা হয়। ইসলাম ধর্মের বিরোধিতাকে প্রশ্রয় দেয় একদল মানুষ, নোংরা কদর্য আক্রমণ যেমন চলে, তেমনি অপর এক দল নিজের ধর্মের মহানতাকে পিষে, তাকে জনসম্মুখে নোংরা করতে পেরে স্বস্তিবোধ করে। তারা ভুলে যায় ধর্ম গায়ের কোন বস্ত্র নেয়। প্রত্যেক মানুষের জীবন দর্শন আলাদা, তাদের জীবন ধারণের পথ আলাদা, তাই প্রত্যেক মানুষের ব্যক্তিগত দিক থেকে ধর্ম আলাদা। এই যে জন্মের পরই হিন্দু, মুসলিমের একটা ট্যাগ লাগিয়ে দেয়া হয় পরিবার ও সমাজ থেকে, সেটা ছাপিয়েও প্রতিটা ধর্ম অনেক বেশি উচ্চদরের। সাধকের স্তরে না পৌঁছে, অল্প জেনেই হিন্দুধর্ম বা ইসলাম ধর্ম কোনটাকেই অপমান করার অধিকার নেই আমাদের। ধর্মগ্রন্থের মাহাত্ম্য জীবনের পথপ্রদর্শনের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য, তাকে কদর্য ভাষায় আক্রমণ করে কখনোই অপর ধর্মকে বড়ো প্রমাণিত করা যায় না।
ধর্মনিরপেক্ষ তকমা হারিয়ে যদি ফেলে ভারতবর্ষ, দোষ কাকে দেবো? পাশের বাড়ির রহিমকে নাকি পেছনের বাড়ির রামকে? আমাদের মধ্যেকার ধর্মের ফাঁকফোকর তাতে জল ঢুকছে ক্রমশ, আর উপরতলার লোকেরা ফায়দা লুটিয়ে ভোগলিপ্সায় মাতছে। রাজনৈতিক খেল নিয়ে বক্তব্য রাখতে পারছি না স্বল্পপরিসরে।
শুধু এটাই বলবো, আমরা ডুবে যাবো যদি রাম-রহিম একে অপরের হাত না ধরে। এই যে দাঙ্গা, এই যে রক্তলীলা, কখনো হাতে নিয়ে দেখুন, আলাদা করে রক্ত দিয়ে চেনা যায় কে হিন্দু মুসলিম? শুধু পৈতে আর লম্বা দাঁড়িটুকুই সব হয়ে গেলো? একই দেশের সন্তান সবাই, এই পরিচয়টা কি তার চেয়েও তুচ্ছ?
ধর্মনিরপেক্ষতার পরে জাতিগতভেদ নিয়ে অল্প বলা দরকার। দলিতশ্রেণীর মানুষ যারা তারা আজো বঞ্চিত, অপমানিত, শোষিত। কিন্তু কেন? সংবিধান কি তাই বলে? কে ঠিক করেছে উঁচুজাতের কাজ মন্দিরে পূজো করা আর নীচু জাত নর্দমা সাফ করবে? কেন বংশপরম্পরায় এই গন্ডিতে বাঁধা থাকবে মানুষ? বেড়িয়ে আসার স্পর্ধা করলেই চরম বিপদ আসন্ন। আর দলিত মেয়েরা আজো সস্তা। বাজারের বস্তুর মতোন তাদের সাথে যা ইচ্ছে তাই করা যায়। হায় রে বিধি বাম, জন্মই যদি পরিচয় হয় তবে কেমন মানবজনম?
আমার সীমিতজ্ঞানের মধ্যে যেটুকুন রয়েছে, নারী-স্বাধীনতার ওপর সামান্য বক্তব্য রাখাটা আবশ্যক। নারী স্বাধীনতা কোথায়? পুরুষের সমকক্ষ হবার সুযোগে নাকি সমকক্ষ হবার হিসেব না কষে সেই গন্ডি অতিক্রম করায়। নারীদের দুর্বলতা কোথায়? বোরখার আড়ালে নাকি শর্ট স্কার্ট প্রদর্শনেই তার স্বাধীনতার বহিঃপ্রকাশ। শাখা-সিঁদুরের নিজেকে সাজানোতেই তার বন্দিত্ব আর রাত জেগে পার্টি, ডিস্কো, পুরুষবিদ্বেষ, সিগারেট-এসবে স্বাধীনতা খুঁজে নেওয়া। এটুকুই বা কতটুকু সত্যি?
নারীর মাপকাঠি কেন পুরুষের সমকক্ষতার পাশে বসানো হবে? নারীর মাপকাঠি কেন সে নিজে নয়? পিরিয়ড নিয়ে তরজা করে নিজেকে সবল দেখানো, কিংবা মাতৃত্বের আস্বাদ দিতে পারে দেখে আস্ফালন করা কোনটিই কি শোভা পায়? স্বেচ্ছাচারীর মতোন নিরীহ পুরুষদের ব্যবহার করে মিথ্যে দোষারোপ করা সেটাও কি নারী-স্বাধীনতার অশুভ প্রয়োগ নয়?
একপেশে হয়ে নারী নারী করে চিৎকার করলেই নারীবাদী হওয়া যায় না। লড়তে হল ঘর থেকে লড়াই হোক যেখানে আজন্ম স্বার্থত্যাগ করা মা নিজের গান ছেড়েছে সংসারের জন্য, হোক এঁদো গলির সেই মেয়েটার জন্য যার টিউশনের টাকায় সংসার চলে কিন্তু ঘরে জোটে না সম্মান। হোক সেই শিক্ষিত মেয়েটির জন্য যার স্বাধীন
ও সুস্থভাবে বাঁচা নির্ভর করছে মোটা টাকার পণের ওপর। সেই মেয়েটির জন্য লড়াই হোক যার মুখ অ্যাসিডে ঝলসে গেলেও স্বপ্ন ঝলসে যায়নি, ধর্ষিতা হওয়া মেয়েটির বিরুদ্ধে পদে পদে ছুটে আসা নোংরা বাক্যর বিরুদ্ধে হোক গর্জন। স্বপ্ন দেখতে ভয় পাওয়া, গুটিয়ে যাওয়া মেয়েটির ছোটবেলা কেড়েছে যে নোংরা স্পর্শ তার বিরুদ্ধে গর্জে ওঠা হোক! এই সময় একপেশে হয়ে উঠুক প্রত্যেক নারী প্রত্যেকের জন্য। সস্তার জিনিসে রগরগে কমেন্ট আর বক্তব্য রাখলেই নারী স্বাধীনতা আসবে না।
সর্বোপরি বলবো, যে কোন স্বাধীনতাই তা ছোট হোক বা বড়ো, কেড়ে নিতে হয়। যদি একজন মানুষ ভাবে তার নিজের সিদ্ধান্ত, নিজের মত, নিজের যেকোনো পদক্ষেপ ছোট বিপ্লব আনবে, পরিবর্তন আনবে পচাগলা সমাজে তবে সে স্বাগত জানাক সমাজ। খাপ বসানো বন্ধ হোক। আবার যে পদক্ষেপে শুধুই বিতর্ক আর আত্মস্বার্থ চরিতার্থ হয়, তা যেন মেনে নেওয়া না হয়। কতজনের রক্তে ভিজে গৌরবান্বিত হয়েছে এদেশ, আর আমরা মিম শেয়ার করে, কাউকে ব্যক্তিগত আক্রমণ করে, নোংরা ভাষা প্রয়োগ করে চরম স্বাধীনতা উপভোগ করছি। স্বাধীনতা হাটে বাজারে বিক্রি হওয়া দশ টাকার তেরঙ্গায় নেই, আছে আমাদের ভেতরে খাঁচাবন্দি বিবেকে। ঘুমন্ত বিবেক যদি জাগ্রত হয়, একই সুরে সব ভারতবাসী যদি স্পন্দিত হয়, সম্প্রীতির আহবানে আমিত্ববোধ ছেড়ে আমাদের শব্দটা বেশি জোরালো হয়ে ওঠে তবেই প্রকৃত স্বাধীনতার আস্বাদ পাবো। জানি সে বহুদূরের স্বপ্ন, তবু ক্ষতি কি!
কোন একদিন..... "ভারত আবার জগতসভায় শ্রেষ্ঠ আসন লবে!"
0 মন্তব্যসমূহ
Thank you so much for your kindness and support. Your generosity means the world to me. 😊