গৌতম সাহা,কোলকাতাঃ 'সমাজ গড়ার কারিগর' বলেও বারবার স্কুলের চার দেওয়ালের মধ্যে তাদের কোনঠাসা করাটাই যখন সমাজের নৈমিত্তিক নিয়মে দাঁড়িয়ে গিয়েছিল, তখন 'সমাজ রক্ষার সৈনিক' রূপে সামনে এসেছে উস্থি ইউনাইটেড প্রাইমারি টিচার্স ওয়েলফেয়ার এসোসিয়েশানের বর্ধমান জেলা সংগঠন।শুধু সামাজিক মাধ্যমে নয়,বরং সমাজ কে মাধ্যম করে তারা বুঝিয়ে দিচ্ছেন কেন তাদের পেশাকে সর্বশ্রেষ্ঠ পেশার মর্যাদা দেওয়া হয়।
লকডাউন শুরুর পর থেকেই রাজ্যজুড়ে চলা ত্রাণ ও সহায়তা কার্যের নিরবচ্ছিন্ন কর্মী হয়ে উঠেছে পশ্চিমবঙগের বৃহত্তম প্রাথমিক শিক্ষক সংগঠন UUPTWA এর বর্ধমান জেলা শাখা। UUPTWA-র চক্র বা সাব-ডিভিসন ভিত্তিক সংগৃহীত অনুদান কখনো তারা তুলে দিচ্ছেন রাজ্য বা কেন্দ্রের ত্রাণ তহবিলে, আবার কখনো পূর্ব বা পশ্চিম বর্ধমানের যেকোনো প্রান্তে দুঃস্থ পরিবারের দরজায় ত্রাণ নিয়ে পৌঁছে যাচ্ছেন শিক্ষক শিক্ষিকারা।করোনা সংক্রমন হেতু সারা ভারত জুড়ে চলা লকডাউন পরবর্তী অভূতপূর্ব এই পরিস্থিতিতে সবচেয়ে বেশি করুণ অবস্থার শিকার ভিন্ রাজ্যের শ্রমিকেরা। তাই কাটোয়া হোক বা রায়না, ধাত্রীগ্রাম হোক বা বর্ধমান অনাবাসী শ্রমিকদের ভরাভয় হযে উঠেছে উস্থির শিক্ষকেরাই। কালনা মহকুমা হাসপাতালে চিকিৎসা করাতে এসে আটকে পড়া দুর্গাপুরের দম্পতি সাহায্যকারী হিসেবে খুঁজে পেয়েছেন এই সংগঠনের শিক্ষকদেরই। কোথাও আবার ইট ভাটার শিশুদের জন্য সাধ্যমত দুধের ব্যবস্থা করে শিরোনামে উঠে এসেছে শিক্ষকদের এই অরাজনৈতিক সংগঠন।
অনাহারে থাকা পরিবারের খবর পাওয়ার সাথে সাথেই অত্যাবশ্যক মুদি দ্রব্য ও সবজি নিয়ে মাস্ক পড়া শিক্ষকেরা পৌছে যাচ্ছেন অসহায় মানুষের বাড়ির উঠোনে। সামাজিক দুরত্ত্ব মেনে তাদের হাতে তুলে দিচ্ছেন গ্রাসাচ্ছাদনের অমূল্য উপকরণ।
কালনা মহকুমা সংগঠনের মতো কোথাও আবার মহকুমা তহবিল থেকে অনুদানের চেক সশ্রদ্ধ হাতে তুলে দেওয়া হচ্ছে সরকারি হাসপাতাল সহ ভারত সেবাশ্রম সংঘের মতো সংগঠনের হাতে। আসানসোল থেকে শুরু করে বর্ধমান সদর, সদর উত্তর, সদর দক্ষিন, দুর্গাপুর, জামুড়িয়া, মেমারি, খন্ডঘোষ, সাতগেছিয়া ইত্যাদি এলাকার UUPTWA সদস্যেরা নিজেদের অনুদানে গড়ে তোলা তহবিল থেকে নিয়মিত ত্রাণ বিতরণের মাধ্যমে হয়ে উঠেছেন এলাকার পরিচিত মুখ। কোথাও তারা পাশে দাঁড়াচ্ছে ওষুধ কেনার পয়সা নেই এমন পরিবারের পাশে। এই ব্যাপক ত্রাণকার্যের কারন জানতে চাওয়াতে এক শিক্ষকের স্পষ্ট জবাব, "আমাদের পেশা আমাদের দায়বদ্ধতার শিক্ষা দেয়। অন্য কোনো কারণে এই কাজ আমরা করছি না"।
দাঁইহাট, কালনা, কাটোয়া, সাতগাছিয়া, জামুরিয়া, আসানসোল, কাঁকসা, দুর্গাপুর পূর্বস্থলী, মন্তেশ্বর, জামালপুর, ভাতশালা ইত্যাদি এলাকার চিত্রনাট্য সব একই। সামাজিক দূরত্ব ও ব্যক্তিগত নিরাপত্তা যথাযথ ভাবে পালন করেও প্রতিদিন শত শত দুঃস্থ পরিবারের সহায় "টিম বর্ধমান" হিসেবে পরিচিত UUPTWA বর্ধমান জেলা শাখা। সংগঠনের কর্তৃপক্ষ সাফ জানিয়ে দেন প্রতিটি সাব ডিভিশন তথা চক্র সাংগঠনিক বা এলাকাগত ভাবে কিছু না কিছু করছে, তবে প্রতিটি কর্মসূচী যে প্রচারের আলোয় আসছে এমনটা নয়। বর্ধমান তিনকোনিয়া সংলগ্ন অঞ্চলে বসবাসকারী যৌনকর্মীদের হাতে সসম্মানে খাদ্য সামগ্রী তুলে দেওয়ার খবরটিও তাই অনেকেরই অজানা। তবে নিশ্চিত ভাবেই বলা যায় পূর্ব ও পশ্চিম বর্ধমানের মোট সাহায্যপ্রাপ্ত পরিবারের সংখ্যা আপনাকে অবাক করবে। যা দ্বিতীয় লক ডাউনের সময়েই কয়েক হাজার অতিক্রম করেছে।
শুধু ত্রাণের কাজেই নিজেদের সীমাবদ্ধ রাখেননি তারা, অগ্রণী ভূমিকা নিতে দেখা গেছে ক্যানসার আক্রান্ত একজন রোগীর জীবনদায়ী ওষুধ এনে দেওয়াতেও।একজন ক্যানসার আক্রান্ত রোগী ওষুধ না পেয়ে মৃত্যু পথযাত্রী হয়ে পড়ে আছেন তার ঘরে এরকম একটি খবর পেয়ে টিম বর্ধমান কলকাতা জেলার উস্থিয়ানদের সহযোগিতায় ক্যান্সার আক্রান্ত রোগীর জন্য সেই জীবনদায়ী ওষুধ পর্যন্ত নিয়ে এসেছেন কলকাতার রেডজোনে অন্তর্গত্ এলগিন রোড থেকে।
এক সময় শিক্ষক সম্মান আদায়ের দাবীতে পথে নামা শিক্ষকেরা আজ আবারও পথে নেমেছেন। তবে এবার আন্দোলন মানুষের অনাহার আর অসহায়তার বিরুদ্ধে। UUPTWAর বর্ধমান জেলা সংগঠন এই ব্যাপারেও ভগীরথের ভূমিকায়।
Social Plugin