সিনেমা তৈরিতে মনের ভিতরের ক্ষিদেটা মেটে - মুখোমুখি আড্ডাতে প্রযোজক শুভাশিষ দত্ত

চারিদিকে লকডাউন। বলতে পারেন সবাই এখন গৃহবন্দী। টালিগঞ্জ পাড়াটা শুনশান। অভিনেতা, পরিচালকরা সবাই শুধু দিন গুনছে। এই লকডাউনে আমাদের সাথে মন খুলে আড্ডা দিলেন ফোনের ওপারে এসডিপি ভেঞ্চার এর কর্নধার প্রযোজক শুভাশিষ দত্ত। হালকা মৃদু হাসিতে শেয়ার করে নিলেন নানা অজানা কথা। তার কিছু অংশ আপনাদের জন্য।

প্রশ্ন - বর্তমানে আপনার প্রযোজনাতে অনেক গুলো প্রজেক্ট এসডিপি ভেঞ্চারের ব্যানারে মুক্তি পাচ্ছে। কিন্তু আপনার পথ চলাটা ঠিক কেমন ছিল? আপনার প্রথম ছবি কি ছিল?

শুভাশিস দত্ত - (মৃদু হেসে) আমাদের প্রোডাকশন হাউস তৈরি হয় ২০১৫ সালে। তখন আমাদের কোম্পানির নাম ছবি এসডি প্রোডাকশন। তখন একটা ছোটো টিম ছিল। সেই সময় "ঋতুরঙ্গ" নামের একটি ডকুমেন্টারি তৈরি করা হয়েছিল। বহু প্রশংসা পেয়েছিল সেটি। অনেকগুলো পুরস্কার পেয়েছিল। ২০১৫ তে আমাদের প্রথম শর্ট ফিল্ম মুক্তি পায়, সেটি হল "একটি প্রেমের গল্প"। ২০১৬ সালে দুটো শর্ট ফিল্ম করেছিলাম। সেগুলো হল স্টেটাস আপডেট, নীরবে৷ ২০১৭ সালে একটি ছবি মুক্তি পায় "বাঁশিওয়ালা"। যে ছবিটা প্রচন্ড প্রশংসা পেয়েছিল। বহু ভালোবাসা পায়৷ অনেক পুরস্কার পেয়েছিল ছবিটা। এরপর আস্তে আস্তে নানা ছবি তৈরি করা হয়৷ সেগুলোর মধ্যে পপকর্ন, যেতে যেতে পথে, খেলা ভাঁঙার খেলা, হ্যাপি ভ্যালেন্টাইন্স ডে প্রমুখ। তবে এসডিপি ভেঞ্চার এর ব্যানারে বাইরের নতুন পরিচালকরাও কাজ করছে। এরপর "ব্ল্যাক" ছবিটি মুক্তি পেল। আমাদের যাত্রাটা অনেকটাই স্মরণীয়। টিমে কিছু সক্রিয় মেম্বার আছে। অভিজিৎ রায়, নন্দিনী দাস, সুশোভন চক্রবর্তী, নম্রতা ভট্টাচার্য, ইন্দ্রনীল দাসগুপ্ত এরা হল আমাদের টিমের এক একটা স্তম্ভ। এছাড়া শুভম হল এসডিপি ভেঞ্চারের ভরসা। একাধারে পরিচালক, অভিনেতা, এডিটর, অন্যদিকে ডিজাইনার। আমি শুধুমাত্র শুভমের মাথার উপরে একটা ছাতার মতো।

প্রশ্ন - আপনি এসডিপি ভেঞ্চার এর কর্নধর। আপনার প্রযোজনাতে পরপর মুক্তি পেয়েছে অনেকগুলো ছবি। কিন্তু সহজে এই প্রফেশনে কেউ অর্থ লগ্নি করতে রাজি হয় না। আপনি কি ভেবে প্রযোজনাতে আসলেন?

শুভাশিস দত্ত - (শান্ত ভাবে মৃদু হেসে) আমরা না ২০১৬ সালের দিকে খুব কষ্ট করেছিলাম। বিশ্বাস করুন খুব কষ্ট করে এক একটা শর্ট ফিল্ম তৈরি করেছিলাম। অনেক কষ্ট করে অল্প অল্প টাকা জমিয়ে এই শর্ট ফিল্ম গুলো করতাম। তার পর ২০১৭ সালের দিকে দেখলাম আস্তে আস্তে দর্শকদের থেকে ভালো রেসপন্স পাচ্ছিলাম। একটু সাহস পেলাম এগিয়ে চলার। তবে কি বলুন তো প্রতিটি বানিজ্যতে তো লাভ লসের প্রশ্ন থেকে যায়। তাই ওতটা ভাবনা চিন্তা করিনি। কিন্তু এই ছবি তৈরি করার ক্ষেত্রে খুব সুখ পাই। মনের ভিতরের খিদে টা মেটে। মনে হয় সারাজীবন এইভাবে জীবন টা কাটিয়ে দিই।

প্রশ্ন - আপনি এর আগে সিনেমা নিয়ে ভাবতেন। গান নিয়ে তেমন একটা ভাবেন নি। কিন্তু এখন আপনার কোম্পানি থেকে অনেক গান মুক্তি পাচ্ছে। হঠাৎ এই গানের প্রতি ভালোবাসার কারন টা কি?

শুভাশিস দত্ত - কি বলুন তো, জীবনে মানুষকে প্রতিটি সময় কিছু না কিছুর স্মৃতি দিয়ে যায়। ২০১৯ সালে আমার ও শুভমের জীবনে একটা কঠিন সময় আসে। আমি হারায় আমার স্ত্রী কে আর শুভম তার মা কে। আমাদের সংসার থেকে চিরবিদায় নেয় আমার স্ত্রী। ওই সময়ে আমার বেঁচে থাকার একমাত্র সম্বল ছিল শুভম আর গান। প্রতিটা মূহুর্তে আমি শুভম কে নিয়ে বাঁচতাম আর গান শুনতাম। আমার স্ত্রী গানের জগতের মানুষ ছিল। গান খুব পছন্দ করতো। তার পর থেকে আমরা প্ল্যান করি গানের কিছু প্রজেক্ট করবো। ২০১৯ সাল থেকে শুরু হয় আমাদের ব্যানারে গান নিয়ে কিছু প্রজেক্ট। ২০২০ তেও অনেক গুলো প্রজেক্ট হয়। কিছু ভালো ভালো শিল্পী কে পাশে পাই। যেমন জয়তী চক্রবর্তী, পায়েল কর, বৃষ্টিলেখা নন্দিনী, মনিষা সারখেল প্রমুখ।

প্রশ্ন - এসডিপি ভেঞ্চারের ব্যানারে মুক্তি পেল "চিরসখা ছেড়ো না"। দর্শকের থেকে কতটা ভালোবাসা পেলেন? রেসপন্স কেমন?

শুভাশিস দত্ত - দেখুন এখন আপনি রেসপন্স বলতে ভিউস এর কথা বলতে পারেন। তবে কি বলুন তো, এই গান টা মুক্তি পাওয়ার পর আমাদের এক্সপেকটেশন ছাপিয়ে গিয়েছিল। আমরা প্রচুর ভালোবাসা পেয়েছি। মানুষ গানটাকে খুব ভালোভাবে গ্রহন করেছেন। আর এই গানটি যিনি গেয়েছিলেন তিনি খুব প্রপুলার গায়িকা। তবে এই প্রসঙ্গে বলে রাখি, আমার মিসেস ও আমার একটা স্বপ্ন ছিল এবং আছে। সেটা হল নতুন ট্যালেন্ট কে সুযোগ দেওয়া। যারা সুযোগের জন্য ঘুরছে। খুব ভালো গান করে, অভিনয় করে, তাদের কে একটু সুযোগ করে দেওয়া। এবং সেটা শুভমের ও খুব বড়ো ইচ্ছা।

প্রশ্ন -মুক্তি পেল ব্ল্যাক ছবির অফিসিয়াল ট্রেলার। যে ছবিটি আপনি প্রযোজনা করেছেন।মুুক্তিতে ট্রেলারের উত্তর কেমন পেয়েছেন?

শুভাশিস দত্ত - ট্রেলারে আমরা খুব প্রশংসা পেয়েছি। আর এই ছবিতে অভিনয় করেছেন অভিনেতা অনিন্দ্য পুলক ব্যানার্জি ও রায়তি ভট্টাচার্য। দুজনে খুব প্রফেশনাল অভিনেতা। কিন্তু বিশ্বাস করুন অনিন্দ্য পুলক ব্যানার্জি আমাদের সাথে মাটির মানুষের মতো পাশে থেকেছেন। খুব হেল্পফুল৷ শুধু অনিন্দ্য পুলক ব্যানার্জি নয়, রায়তি ও আমাদের খুব পাশে ছিল। অনিন্দ্য পুলক ব্যানার্জির সাথে আমার সম্পর্ক টা খুব সুন্দর।

প্রশ্ন - ব্ল্যাক ছবিটা নিয়ে আপনি কতটা আশাবাদী? 

শুভাশিস দত্ত - এর আগে শুভম যা ছবি করেছে, সেগুলো অন্য ধরনের। ও প্রেমের গল্প করেছে, দুঃখের গল্প করেছে, রোমান্টিক গল্প করেছে। কিন্তু ব্ল্যাক ছবিটা পুরোপুরি আলাদা৷ থ্রিলার একটি ছবি। তবে কি বলুন তো, দর্শক শেষ কথা৷ মুক্তির পর দর্শক ভালো মন্দ বলবে৷ আশা করছি মানুষের ভালো লাগবে।

প্রশ্ন - আপনার ছেলে নিজেই পরিচালক। আপনার অনুভূতি কেমন?
শুভাশিস দত্ত - দেখুন আমাদের দুজনার সম্পর্ক প্রফেশানালি তো নয়। আমার জীবনে ও একমাত্র সবকিছু। তবে কি বলুন তো একজন বাবা হিসাবে তো ছেলের সাফল্যে সবচেয়ে মন ভরে৷ বাবা হিসাবে আনন্দ পাই। তবে বাবা হিসাবে সবসময় বলি সবসময় মাটিতে পা টা রাখবি। সবার সাথে ভালো ভাবে চলবি।

প্রশ্ন - পরিচালক হিসাবে আপনার ছেলে কে নিয়ে কি বলতে চান?
শুভাশিস দত্ত - শুভম ছবি তৈরি করে। কিন্তু ও খুব ভালো ডিজাইনার। আমি ওর ডিজাইন খুব পছন্দ করি৷ (হেসে বল্লেন) আমি ওর ডিজাইনে ৬০ নম্বর দেবো৷ খুব সুন্দর ডিজাইন করে৷ আর তাছাড়া ও প্রচুর সিনেমা দেখে।

প্রশ্ন - এই মূহুর্তে আপনি শর্ট ফিল্ম তৈরি করছেন অনেক। বড়ো ছবি তৈরি করার প্ল্যান কবে রয়েছে?
শুভাশিস দত্ত - সবার তো বড়ো ছবি করার স্বপ্ন থাকে। আমার ও আছে৷ তবে কি বলুন তো, সম্প্রতি আমি বাইরে ঘুরতে গিয়েছিলাম। দেখলাম বাইরে ও শর্ট ফিল্মের খুব চাহিদা রয়েছে। কারন কেনো বলুন তো। এখন সবার হাতে মোবাইল, ল্যাপটপ, ট্যাব রয়েছে। যে কেউ যে কোনো মূহুর্তে ছোটো ছবি দেখে নিতে পারে। সিনেমা হলে গিয়ে দীর্ঘ সময় ধরে ছবি দেখার ধৈর্য এখন মানুষের খুব কম। তবে তাই বলে কি বড়ো ছবি বানাবো না? অবশ্যই বানাবো। কিন্তু তার আগে আরো কিছু ছোটো ছবি বানাবো। বড়ো ছবির প্ল্যান চলছে নিজের মধ্যে (জোরে হেসে বল্লেন)। তবে কি বলুন তো আমি হয়তো খুব বড়ো বাজেটের ছবি এই মূহুর্তে বানাতে পারবো না৷ তবে সামর্থ্য অনুযায়ী ছবি বানাবো। যাতে সবার টাকা পয়সা দিয়ে দিতে পারি। যাদের কে নিয়ে সিনেমা বানাবো, তাদের কে নিয়ে যেন সারাজীবন চলতে পারি।

প্রশ্ন - বাংলা ছবির জন্য আপনার ভাবনা কি?
শুভাশিস দত্ত - দেখুন বাংলা ছবি কিন্তু আগের থেকে অনেক উন্নত হয়েছে৷ এখন প্রচুর ভালো ভালো ছবি তৈরি হচ্ছে৷ কোনো ছবি সিনেমা হলে বেশি দিন চলেনি বলে সেটা ভালো ছবি নয়, এটা খুব ভুল ধারনা। বর্তমানে কৌশিক গাঙ্গুলি, শিবপ্রসাদ, নন্দিতা, গৌতম ঘোষ, সৃজিত মুখার্জি এনারা খুব ভালো ছবি করছেন। তবে আমি বাংলা সিনেমা কে খুব ভালোবাসি৷ তাই আমার ছবির ভিউয়ার বেশি পাওয়ার জন্য আমি খারাপ দৃশ্য কিংবা অন্য কিছু পছন্দ করি না৷ ছবির স্বার্থে যেটুকু প্রয়োজন সেটুকুই। আমাদের বাংলা ছবি অনেক এগিয়ে গিয়েছে। আমরা আশাকরি আরো এগিয়ে যাবে।