নিসর্গের কবি জীবনানন্দ দাশ লিখেছেন- ‘মালঞ্চে পুষ্পিতা অবনতামুখী/ নিদাঘের রৌদ্রতাপে একা সে ডাহুকী/ বিজন তরুণ শাখে ডাকে ধীরে ধীরে/ বনচ্ছায়া- অন্তরালে তরল তিমিরে’। 

ডাহুক আসলে চিরবিরহী একটি পাখি। সঙ্গীহীন হলে এরা পাগল হয়ে যায়। ডাহুক হারিয়ে গেলে ডাহুকী দিনরাত পাগলের মতো ডাকাডাকি করতে থাকে। রাতে ডাহুকের ‘কোয়াক’ ‘কোয়াক’ ডাক শুনে সহজেই একে চিনতে পারা যায়। এই ডাক পুরুষ পাখির, যা বর্ষাকালে বেশি শোনা যায়। একটানা অনেকক্ষণ ডেকে শ্বাস নেয়।

ডাহুক (বৈজ্ঞানিক নাম: Amaurornis phoenicurus), ডাইক, পানপায়রা বা ধলাবুক ডাহুক Rallidae (রেলিডি) গোত্র বা পরিবারের অন্তর্ভুক্ত Amaurornis (আমুরর্নিস) গণের অন্তর্গত মাঝারি আকৃতির একটি পাখি। পাখিটি বাংলাদেশ, ভারত ছাড়াও দক্ষিণদক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বিভিন্ন দেশে দেখা যায়।

ডাহুক জলের পাখি। খুব ভীরু। পুকুর, খাল, জলাভূমি, বিল ও নদীর গোপন লুকানো জায়গা এদের খুব প্রিয়। এদের পায়ের নখ খুব বড় আর ধারালো। এ কারণেই ডাহুক খুব সহজেই শাপলা বা পদ্ম পাতায় দাঁড়িয়ে থাকতে পারে। এমনকি কচুরিপানার উপর দিয়ে হেঁটেও যেতে পারে। হঠাৎ দেখলে মনে হবে যেন জলের উপর দিয়েই হাঁটছে। আসলে কিন্তু তা নয়।

দিনহাটা মহকুমার একাধিক গ্রামীন বাজারে দেদারে বিক্রি হচ্ছে বিপন্ন এই ডাহুক পাখি। স্থানীয় প্রশাসনের অজ্ঞতা হোক, কিংবা অসাবধানতা- নজর দিচ্ছেন না কেউই। বুড়িরহাট, নাজিরহাট, বাসন্তীরহাট, খট্টিমারি  সহ একাধিক গ্রামীন বাজারে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে কোথাও ৮০ টাকা আবার কোথাও ১০০ টাকা করে বিক্রি হয় এই ডাহুক পাখি। 

এর উপর গ্রামেগঞ্জে রয়েছে সখের শিকারি। যারা নিজেদের রসনা মেটাতে ফাঁদ পাতেন ডাহুক ধরতে।

বিশ্বের সাতটি প্রাণীবৈচিত্র্যপূর্ণ দেশের মধ্যে ভারত একটি। পূর্ব হিমালয়, পশ্চিম ঘাট, ইন্দো-মিয়ানমার অঞ্চল এবং আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপপুঞ্জ ভারতের চারটি জীববৈচিত্র্যপূর্ণ এলাকা। এসব এলাকায় বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে থেকে প্রায় ৫০০ প্রজাতির অতিথি পাখি আসে। অথচ সামান্য লোভের শিকার হয়ে বিপন্ন থেকে বিলুপ্তির পথে অতি পরিচিত চির বিরহী ডাহুক। সমাজকর্মী রতন সাহা জানিয়েছেন-
"বর্তমানে চলতে থাকা লকডাউনের ফলে প্রকৃতি আবার নিজেকে গুছিয়ে নেওয়ার সুযোগ পাচ্ছে। দূষণের মাত্রা অনেক কমে যাওয়াতে ক্রমেই বিলুপ্ত হতে থাকা প্রাণী, পাখিরা আবার নিজেদের অস্তিত্বের জানান দিচ্ছে। ফিরে আসছে পুরোনো আস্তানায়। সমৃদ্ধ হচ্ছে পরিবেশ, বাস্তুতন্ত্রে ভারসাম্য তৈরি হচ্ছে প্রতিনিয়ত, প্রাণ ফিরে পাচ্ছে পরিবেশ-প্রকৃতি। কিন্তু একদল স্বার্থান্বেষী মানুষ এই সামান্য বাস্তব টাকে বুঝতে চাইছে না! নিজেদের ক্ষুদ্র স্বার্থ চরিতার্থ করতে গিয়ে নির্বিচারে শিকার করছে প্রকৃতির অমূল্য সব সম্পদগুলোকে। পরিযায়ী পাখি থেকে শুরু করে বিলুপ্ত হতে থাকা এরকম অসংখ্য প্রাণীকুলকে নিঃশেষ করে দিচ্ছে বিভিন্ন চোরা শিকারকারীর দল। প্রশাসনীক উদাসীনতা তাদেরকে উৎসাহিত করছে সে-কথা বলাইবাহুল্য।"


আর এক পরিবেশপ্রেমি বিরাজ মিত্র বলেছেন "একমাত্র সচেতন মানুষের সম্মিলিত প্রতিরোধই পারে বিপন্ন প্রজাতির এই ডাহুক পাখিকে রক্ষা করতে।"