গ্রামীণ অর্থনীতিকে তুলে ধরতে অর্থনৈতিক ম্যাগাজিন ! বিদ্যালয় শিক্ষায় নজির
কোচবিহার জেলার একটি প্রান্তিক বিদ্যালয় তুফানগঞ্জ মহকুমার ধলপল উচ্চ বিদ্যালয়। এই বিদ্যালয়ের উচ্চ মাধ্যমিক স্তরে একটি অন্যতম বিষয় অর্থনীতি। জেলা বা জেলার বাইরে অন্যান্য বিদ্যালয়ে যখন অর্থনীতি বিষয়ের ছাত্র সংখ্যা কমছে বা কিছু বিদ্যালয়ে শূন্যতে নেমে এসেছে। সেখানে ব্যতিক্রম এই বিদ্যালয়।
অন্যান্য অনেক বিষয়ের মাঝেও ছাত্রছাত্রীদের কাছে একটি জনপ্রিয় বিষয় অর্থনীতি। অর্থনীতি বিষয়ে ছাত্রছাত্রী সংখ্যা অন্যান্য অনেক বিদ্যালয়ের চেয়ে অনেক বেশি। সৌজন্যে বিদ্যালয়ের অর্থনীতির শিক্ষক সঞ্জয় মল্লিক। তিনি ছাত্রছাত্রীদের নিয়ে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন রকম অভিনব উদ্যোগ নিয়ে থাকেন। কৃষি, শিল্প, চা বাগান, বাজার, ব্যাংক ইত্যাদির অর্থনৈতিক কার্যকলাপ তিনি সরাসরি হাতে কলমে পরিচয় করিয়ে দেখান। অর্থনৈতিক সমীক্ষা ও ভ্রমণের মাধ্যমে পারিপার্শ্বিক অর্থনীতির সাথে ছাত্রছাত্রীদের সম্পর্ক বোঝান। অর্থনৈতিক জ্ঞান, সঞ্চয়, বিনিয়োগ ও ব্যাংকিং হ্যাবিট এর গুরুত্ব বোঝাতে ছাত্রছাত্রীদের বাড়ি বাড়ি তৈরি করছেন শিশু ব্যাংক। এই বিদ্যালয়ের অর্থনীতির ছাত্রছাত্রীদেরকে কোন টিউশন পড়তে হয় না। সঞ্জয় মল্লিক পনেরো বছর ধরে দুটি বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেছেন। মুর্শিদাবাদ জেলার বহরমপুরের সাটুই আর. এন. হাই স্কুলে ও ২০১৭ সালে আপস বদলির মাধ্যমে যোগদানের পর থেকে ধলপল উচ্চ বিদ্যালয়ে। এই পনেরো বছরে তিনি অর্থনীতির অসংখ্য ছাত্রছাত্রী পড়িয়েছেন কিন্তু কোন ছাত্রছাত্রীকে একদিনের জন্যও অর্থনীতি বিষয় টিউশন পড়তে হয়নি। এটি সাম্প্রতিক বিদ্যালয় শিক্ষা ব্যবস্থায় এক নজির বলা যায়। যেখানে টিউশনি ছাড়া শিক্ষা অচল বলা হয়। সেখানে ব্যতিক্রমি উদাহরণ সঞ্জয় মল্লিক।
তার ছাত্রছাত্রীরা আজ বিভিন্ন জায়গায় অর্থনীতি নিয়ে পড়ছে ও কাজ করছে। স্কুলের পড়ানোর সঙ্গে টিউশনের পড়ানো সবটা তিনি স্কুলেই যত্ন সহকারে করান। নির্ধারিত ক্লাসের বাইরে অতিরিক্ত ক্লাস নেওয়া থেকে শুরু করে বিভিন্ন ভ্যাকেশান গুলোতে নিয়মিত অনলাইন ক্লাস নিয়ে থাকেন। 'Ecoheart' নামে অর্থনীতির ছাত্রছাত্রীদের নিয়ে প্রতিবছর একটি সেমিনার করেন। এই সেমিনারে প্রত্যেকটি ছাত্রছাত্রী তাদের গবেষণার বিষয় উপস্থাপন করে ও শিক্ষক-শিক্ষিকার করা প্রশ্নোত্তর পর্বে অংশগ্রহণ করে, যা অনেকটা কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়ের সেমিনারের মতই।
এছাড়াও অনেক মৌলিক ভাবনার মাধ্যমে তিনি অর্থনীতি শিক্ষাকে ছাত্রছাত্রীদের কাছে জনপ্রিয় করে তুলেছেন। এবার সেরকমই একটি কাজ তিনি করেছেন যা রাজ্য বা দেশের কোন বিদ্যালয়ে অর্থনীতি নিয়ে এখনও অব্দি হয়তো করা হয়নি। হয়তো বিদ্যালয় স্তরে অর্থনীতি নিয়ে এরকম কাজ এটাই প্রথম। তিনি ২০২৪ শিক্ষাবর্ষের মাঝামাঝি সময় থেকে একাদশ ও দ্বাদশ শ্রেণির অর্থনীতির ছাত্রছাত্রীদের নিয়ে গ্রামীণ অর্থনীতি সংক্রান্ত একটি গবেষণামূলক অনুসন্ধান করেছিলেন। প্রায় ৩-৪ মাস অনুসন্ধান ও তথ্য সংগ্রহের মাধ্যমে অর্থনীতির ছাত্রছাত্রীরা অর্থনীতির বিভিন্ন বিষয় নিয়ে লিখিত আকারে রিপোর্ট তৈরি করেছে। গ্রামীণ অর্থনীতির বিভিন্ন বিষয় যেমন- মাছ বাজার, সবজি বাজার, ধান বাজার, এঁচোড় বাজার, মানুষের পেশা, কৃষিতে ও জীবিকায় মা ও বোনেদের অংশগ্রহণ, হস্ত ও কুটির শিল্প, পরিবহন ও যোগাযোগ, কৃষি, শিল্প, অর্থনৈতিক উদ্যোগ ও অর্থনৈতিক সম্ভাবনা ইত্যাদি থেকে কেন্দ্র ও রাজ্য বাজেট সম্পর্কে ধারণা, আর্থিক প্রতারণা ও মুক্তির উপায়, বিভিন্ন ব্যাংক তাদের কাজ ও ব্যাংক ঋণ, অমর্ত্য সেন, অভিজিৎ বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায়, ড. মনমোহন সিং, টাটা গোষ্ঠীর রতন টাটা, গুগলের সিইও পিচাই সুন্দররাজন, ফেসবুকের প্রতিষ্ঠাতা মার্ক জুকারবার্গ প্রমুখ অর্থনীতিবিদ ও উদ্যোগী সফল মানুষদের জীবন ও জয়ী হওয়ার গল্প ইত্যাদি উঠে এসেছে। উদ্দেশ্য গ্রামীণ অর্থনীতির সাথে পরিবর্তনশীল বিশ্ব অর্থনীতির সম্পর্ক স্থাপন নিয়ে ছাত্রছাত্রীদের ধারণা দেওয়া ও অর্থনীতি শিক্ষাকে আরও জনপ্রিয়, সহজ ও বাস্তবমুখী করা এবং অর্থনীতির বিভিন্ন বিষয় সম্পর্কে সমাজের সকলকে সচেতন করা। সর্বোপরি গ্রামীণ অর্থনীতিকে তুলে ধরা।
এই পুরো বিষয়টি "THE ECONOMIC QUEST" নামে একটি অর্থনৈতিক ম্যাগাজিন আকারে প্রকাশিত হয়েছে। আজ ২৯ এপ্রিল, মঙ্গলবার ধলপল উচ্চ বিদ্যালয়ে অর্থনীতির ছাত্রছাত্রী ও সকল শিক্ষকশিক্ষিকা, শিক্ষাকর্মী, পরিচালনা সমিতি ও গ্রাম পঞ্চায়েত প্রধানের উপস্থিতিতে এই ম্যাগাজিনের প্রচ্ছদ ও সূচিপত্র প্রকাশিত হলো। এই অর্থনৈতিক ম্যাগাজিন সম্পাদনা করেছেন অর্থনীতির শিক্ষক সঞ্জয় মল্লিক।
ছাত্রছাত্রীদের নিয়ে এরকম একটি গ্রামীণ অর্থনৈতিক কাজ ও ম্যাগাজিন দেখে প্রশংসা করেছেন পার্শ্ববর্তী আলিপুরদুয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের বিভাগীয় প্রধান ড. রঞ্জিত ঘোষ ও কোচবিহার পঞ্চানন বর্মা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের বিভাগীয় প্রধান ড. রামকৃষ্ণ মন্ডল। ভূয়সী প্রশংসা করেছেন কোচবিহার জেলা বিদ্যালয় পরিদর্শক (মাধ্যমিক শিক্ষা) সমর চন্দ্র মন্ডল। এরকম একটি অর্থনৈতিক উদ্যোগকে সাধুবাদ জানিয়েছেন ধলপল ১ নং গ্রাম পঞ্চায়েত প্রধান সবিতা সরকার। এমন একটি কাজ সকলের কাজে লাগবে বলে জানিয়েছেন পার্শ্ববর্তী ভুরকুশ উচ্চ বিদ্যালয়ের পরিচালন সমিতির সভাপতি মনীন্দ্র সরকার ও প্রাক্তন শিক্ষক ননী গোপাল দাস।
এরকম একটি কাজের গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা অপরিসীম হবে বলে জানিয়েছেন গ্রামীণ ব্যাংকের আধিকারিকরা। অভিনন্দিত করেছেন বিদ্যালয় পরিচালনা সমিতির সভাপতি ফজল করিম মিঞা, বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মোঃ সাজমল হক ও সহকারি প্রধান শিক্ষক ফয়েজ উদ্দিন মিঞা, অন্যান্য শিক্ষক-শিক্ষিকা ও প্রাক্তন ছাত্রছাত্রীবৃন্দ।
অর্থনীতির শিক্ষক ও ম্যাগাজিনের সম্পাদক সঞ্জয় মল্লিক চান, সঠিক অর্থনৈতিক ভাবনা ছড়িয়ে পড়ুক চারপাশে। তবেই বৃদ্ধি পাবে অর্থনৈতিক সচেতনতা, পাওয়া যাবে নতুন নতুন অর্থনৈতিক উদ্যোগের খোঁজ এবং আয়-ব্যয়ের ভারসাম্য রেখে সহজ ও সুন্দর হবে দৈনন্দিন জীবন, উন্নত হবে গ্রামীণ অর্থনীতি।
0 মন্তব্যসমূহ
Thank you so much for your kindness and support. Your generosity means the world to me. 😊