ধ্বংসের পথে ভাওয়াইয়া সম্রাট আব্বাস উদ্দিনের বসত বাড়ি, সংরক্ষণের দাবি বিশিষ্ট মহলের

Abbas Uddin Home

বিশিষ্ট সংবাদ দাতা: তপন বর্মন

লোকসংগীতের পীঠস্থান এই বাংলা। আর লোকগান মানেই ভাওয়াইয়া গান , যা উত্তর বঙ্গের মানুষের প্রাণের গান। আর এই ভাওয়াইয়া গানের সম্রাট আমরা যাকে বলি তিনি হলেন আব্বাস উদ্দিন। যাকে কেন্দ্র করে বছরের বিভিন্ন সময় এপার বাংলা, ওপার বাংলায় চলে নানান অনুষ্ঠান। যার জন্ম দিন উত্তর বঙ্গের বিভিন্ন জেলায় হৈ হৈ করে পালন করা হয়, যাকে ছাড়া ভাওয়াইয়া গান অসম্পূর্ণ , তিনি হলেন আব্বাস উদ্দিন।অথচ সেই প্রবাদ প্রতিম ব্যক্তির স্মৃতি বিজড়িত বসত ভিটা আজ ধ্বংসের মুখে। নোংরা জঞ্জাল আবর্জনার স্তূপে ভড়ে গেছে আব্বাস উদ্দিনের সংগীত চর্চার ঘর। কোনোমতে মাথা উচুঁ করে দাড়িয়ে থেকে অতীত স্মৃতিকে আকড়ে ধরে আছে। যেকোনো মূহুর্তে ভেঙে গুড়িয়ে যেতে পারে এই শেষ স্মৃতি।



কোচবিহার জেলার তুফানগঞ্জ মহকুমার বলরামপুর গ্রামে ১৯০১ সালের ২৭ অক্টোবর আব্বাস উদ্দিনের জন্ম। পিতা জাফর আলী আহমেদ ছিলেন তুফানগঞ্জ মহকুমা আদালতের উকিল। মাতা হিরামন নেসা।



শৈশব কাল থেকেই মেধাবী ছাত্র ছিলেন আব্বাস উদ্দিন। বলরামপুর স্কুলে তার শিক্ষা জীবন শুরু হয়। এরপর তুফানগঞ্জ উচ্চ বিদ্যালয় থেকে ১৯১৯ সালে প্রবেশিকা এবং ১৯২১ সালে কোচবিহারের ভিক্টোরিয়া কলেজ থেকে আই এ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। এরপর সংগীত জগতে শুরু হয় তার অবাধ বিচরণ।


ভাওয়াইয়া, ভাটিয়ালী, মারফতি, কীর্তন, গজল, পল্লীগীতি, জারি, সারি, মুর্শিদি, বিচ্ছেদ, দেহতত্ত্ব, মর্সিয়া ও বহ পালাগানও গেয়েছেন তিনি। তিনি দরদভরা সুরেলা কন্ঠে যেভাবে পল্লী গানের সুর ফুটিয়ে তুলেছেন তা আজও অদ্বিতীয়।

তার লেখা অসংখ্য গান আজও এপার বাংলা ওপার বাংলায় বেশ জনপ্রিয়। বহু বিখ্যাত শিল্পী তার লেখা গান গেয়ে সুনাম অর্জন করছেন।

সেইসময় কাজী নজরুল ইসলামের সহায়তায় কোলকাতায় গ্রামোফোন রেকর্ডে আব্বাস উদ্দিনের গান রেকর্ড করা হয়। এরপর শহুরে জীবনেও লোকগীতি জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। যার কৃতিত্ব আব্বাস উদ্দিন আহমেদের। দেশের সীমানা পেরিয়ে লোকসংগীত বিশ্বের দরবারে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। এমনকি তারই পদাঙ্ক অনুসরণ করে ভাওয়াইয়া গান আজও ক্রমান্বয়ে বিকশিত।







শুধু গানের জগতে নয় শিক্ষা ও সমাজ সংস্কারক হিসেবেও আব্বাস উদ্দিনের যথেষ্ট অবদান ছিল। ছোটবেলা থেকেই সমাজ ও তার উন্নয়নের ব্যাপারে অত্যন্ত সজাগ দৃষ্টি ছিল আব্বাস উদ্দিনের। সেসময় বিভিন্ন মানুষের কাছে চাঁদা তুলে, নাটকের টিকিট বিক্রি করে টাকা সংগ্রহ বলরাম পুর গ্রামে একটা বালিকা বিদ্যালয় স্থাপন করা হয় ।তিনি গ্রামের নিরক্ষর মানুষদের শিক্ষিত করার উদ্দেশ্যে নিজের বাড়িতে নাইট স্কুল খুলেছিলেন। গ্রামের বৃদ্ধ, চাষি, সবাই এই স্কুলে ভর্তি হন।এভাবেই শিক্ষা সংস্কারের ক্ষেত্রে তিনি উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করেছিলেন।




পরবর্তীতে দেশভাগের পর সপরিবারে আব্বাস উদ্দিন ঢাকায় চলে যান। বর্তমানে তুফানগঞ্জ মহকুমার বলরামপুরে এক ব্যক্তি

মালিকানার হাতে পড়ে আছে তার মধুর স্মৃতি বিজড়িত বাসভবনটি।

তুফানগঞ্জ মহকুমার বলরামপুর বাজারের সাথে লাগোয়া আব্বাস উদ্দিনের এই বসত ভিটা অস্তিত্বের সাথে সংগ্রাম করছে। পাকারাস্তা থেকে বাড়ি ঢুকতেই বাম পাশে আব্বাস উদ্দিনের বাবা মায়ের কবর। আগাছা জঞ্জালে ঢেকে গেছে। সামনেই নজরে আসে শাল কাঠের খুঁটি দিয়ে তৈরি ডারিয়া ঘর। যেখানে দিনরাত চলত গানের জলসা। অথচ তার ভাঙা চোরা জীর্ণ রূপ দেখে মনে হয় যে কোনো মুহুর্তে ধ্বংস হয়ে যেতে পারে শেষ স্মৃতি। নোংরা জঞ্জালের স্তূপে ভরে আছে ঘরের মেঝে। ডারিয়া ঘরের এক দিকে পাশে বিরাট পুকুর আর একদিকে তার বসতবাড়ি। দেশভাগের পর জমি বিনিময়ের মাধ্যমে আসা বর্তমানে ব্যক্তি মালিকানাধীন এই বাড়িটির চেহারা কিছুটা বদলে গেলেও বাড়ির পুরানা সেই টিনের ঘর, ঘরের পাকা ভিটি, বাড়ির পাশে কুয়ো সব কিছুই এখনও জীর্ণ অবস্হায় পড়ে আছে। সব কিছুই নোংরা জঞ্জাল আর বিষাক্ত পোকা মাকড়ে ভর্তি। বাড়ির আসে পাসে চলে মদের আড্ডা। মদের বোতলের ভাঙা কাঁচ ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে আছে। স্হানীয় মানুষদের অভিযোগ " বহু মানুষ এই বসত ভিটা দেখতে আসে, অথচ এই বসত ভিটার বেহাল অবস্হার কোনো উন্নতি হয়না। এত বড় একজন শিল্পীর স্মৃতি রক্ষা করার জন্য কারো দায় দায়িত্ব নেই। আমরা ঐতিহ্যবাহী বাড়িটির সংস্কার সাধনের দাবী জানাই। "