ভারত বাংলাদেশ সীমান্তে কাঁটাতারের সীমানা পেড়িয়ে আজও মহাধূমধামে পূজিত হন মা ছিন্নমস্তা
প্রতিবেদক: তপন বর্মন
কোচবিহার জেলার দিনহাটা মহকুমার সীমান্তবর্তী গ্রাম সাহেবগঞ্জ । সুজলা সুফলা এ গ্রামের মানুষের ধর্মীয় বিশ্বাস আর ধর্মের প্রতি আনুগত্য সুপ্রাচীন কাল থেকেই। এরকমই ধর্মীয় বিশ্বাসের এক নিদর্শন সাহেবগঞ্জ মহাশ্মশানের ছিন্নমস্তা কালী পূজা।
কী রয়েছে এই ছিন্নমস্তা দেবীপরিচয় ?
ছিন্নমস্তা হলেন হিন্দু ধর্মাবলম্বী মানুষের এক আরাধ্যা দেবী। তিনি ছিন্নমস্তিকা বা প্রচন্ড চন্ডীকা নামেও পরিচিত। দশমহাবিদ্যার ষষ্ঠ দেবীকে ছিন্নমস্তা বলা হয়। হিন্দু ধর্মাবলম্বী মানুষের কাছে এই দেবী মহাশক্তি রূপে পূজিতা হন। এই দেবীর মূর্তির ভীন্নতা দর্শনার্থীদের বিস্মিত করে। তার ডান হাতে থাকে তরবারি এবং বাম হাতে সেই তরবারি দিয়ে কাটা নিজের ছিন্ন মস্তক। এর জন্য তিনি দেবী ছিন্নমস্তা। মৈথুনরত যুগলের উপর তিনি দন্ডায়মান। তার কর্তিত কন্ঠনালী থেকে বইছে তিনটি রক্তের ধারা, যা একটা তার নিজের মুখে এবং বাকি দুটি ডাকিনী এবং বর্নিণী নামে দুই সহচরী পান করছেন। দেবীর মূর্তির পাশে মহাকাল বা ভৈরব বাবা মূর্তি রয়েছে।
শাক্ত মহাভাগবত পুরাণ গ্রন্থে ছিন্নমস্তা সহ দশমহাবিদ্যার উৎপত্তি-সংক্রান্ত একটি সুন্দর উপাখ্যান রয়েছে। দক্ষ রাজার কন্যা দাক্ষায়ণী ছিলেন শিবের প্রথম স্ত্রী। দেবী সতী ছিলেন একমাত্র শক্তি যিনি আদ্যাশক্তি মহামায়া। দক্ষ রাজা তাঁর যজ্ঞানুষ্ঠানে শিবকে নিমন্ত্রণ করেননি আর এতে দক্ষ কণ্যা অপমানিত বোধ করেন। এরপর যজ্ঞানুষ্ঠানের দিনে দাক্ষায়ণী বিনা আমন্ত্রণেই যজ্ঞে যাওয়ার অনুমতি চেয়ে শিবকে পীড়াপীড়ি করতে থাকেন। কিন্তু শিব অনুমতি দিতে নারাজ। তখন দাক্ষায়ণী ভীষণা দশ মূর্তি ধারণ করেন। তিনি শিবের দশ দিকে ঘিরে ধরেন। এই দশ মূর্তির দশমহাবিদ্যার মধ্যে অন্যতমা হলেন ছিন্নমস্তা।
এছাড়াও প্রাণতোষিণী তন্ত্র গ্রন্থে ছিন্নমস্তা রূপের প্রাদুর্ভাবের কাহিনি বিবৃত হয়েছে। একদিন মন্দাকিনী নদীতে স্নান করতে যান। সেখানে তার দুই সহচরী ডাকিনী ও বর্ণিনী (এঁরা জয়া ও বিজয়া নামেও পরিচিত) ক্ষুধার্ত হয়ে দেবীর কাছে খাদ্য প্রার্থনা করতে থাকেন। পার্বতী গৃহে ফিরে তাঁদের খেতে দেবেন বলে আশ্বস্ত করেন। কিন্তু সহচরীরা এতটাই ক্ষুধার্ত যে তাদের অবস্থা দেখে কাতর হয়ে ওঠেন দেবী। তারপর দেবী নিজ নখরাঘাতে স্বমস্তক ছিন্ন করে নিজ রক্ত দিয়ে তাঁদের ক্ষুধা মেটান এবং তারপরে গৃহে ফিরে আসেন।তখন থেকেই দেবী ছিন্নমস্তা রূপে পূজিতা হন। ছিন্নমস্তা দেবীকে নিয়েএই ধরনের নানান উপাখ্যান প্রচলিত আছে।
এখন প্রশ্ন হল দেবী ছিন্নমস্তার মন্দির সাহেবগঞ্জ মহাশ্মশানে কীভাবে প্রতিষ্ঠিত হল? এ প্রশ্নের উত্তরে সাহেবগঞ্জ সৎকার সমিতির সদস্যদের থেকে জানা যায় ১৯৭৮ সালে প্রচন্ড খরা হয়েছিল। ফসল খতির আশঙ্কায় কৃষকের মাথায় হাত পড়ে যায়। বিভিন্ন স্থানে বটবৃক্ষের পাতা "রাম " নাম লিখে নদীর জলে ভাসিয়ে দিয়ে বৃষ্টির জন্য প্রার্থনা করা হয়।
এই সময় সাহেবগঞ্জের কয়েকজন ব্যক্তি বীরেন্দ্র কুমার সাহা, মহাদেব সোম, বিমল সাহা প্রমুখ দিনহাটায় আসা জীতেন্দ্র নাথ ভট্টাচার্য নামে এক তান্ত্রিকের সাথে দেখা করেন এবং এই প্রাকৃতিক বিপর্যয় থেকে মুক্তি পাওয়ায় উপায় প্রার্থনা করেন। সেই তান্ত্রিকের নির্দেশে ভাদ্র মাসের কৌশিকী অমাবস্যা তিথিতে খরা থেকে মুক্তির জন্য ছিন্নমস্তা মায়ের পূজা করা হয়। ধর্মীয় বিশ্বাস অনুযায়ী পূজার রাতেই মুষলধারে বৃষ্টি হয়। আর তখন থেকেই ৪৫ বছর ধরে এখানে পূজা হয়ে আসছে।
এই পূজা সম্পূর্ণ তান্ত্রিক মতে হয়ে থাকে। জেলার বাইরে কিংবা ভীন রাজ্যের তান্ত্রিক আনা হয় পূজার জন্য। দীর্ঘ দিন ধরে যে তান্ত্রিক গন পূজা করে আসছেন তারা হলেন পূজারী জীতেন্দ্র নারায়ণ ভট্টাচার্য( শিলিগুড়ি) , সুনীল চক্রবর্তী। (ফালাকাটা) ,শিবু চক্রবর্তী (মাথাভাঙ্গা) এবং বর্তমানে অজয় চক্রবর্তী (খারুকাজ) ও অভীক চক্রবর্তী (শিলচর)।
সারারাত ধরে পূজা হয়।প্রচুর ভক্তবৃন্দের সমাগম ঘটে। পূজাকে কেন্দ্র করে শ্মশান বন্দনা, নরমেধ যঞ্জ ও বলি দেওয়া হয়। এ স্হানে ভেরা, পাঠা, কবিতর , মানকচু ,পুর ও আখ বলির প্রচলন আছে।
পূজারীকে অনেক নিয়ম নিষ্ঠা নিয়ে পূজা করতে হয়ে। বেলকাটা ফুঁড়ে রক্ত দিয়ে মায়ের পূজা শুরু হয়।
দেবীকে এখানে পঞ্চ মুন্ডির আসনের উপর অধিষ্ঠিত করা হয়েছে। এই পাচঁটা মুন্ড যথাক্রমে চন্ডাল, শেয়াল, সাপ, বেজি, নীল বানরের মুন্ড। অধ্যকালীন বংশের পুরোহিত দ্বারা এটি প্রতিষ্ঠিত।
পূজা উপকরণ হিসেবে মাছ মাংস চালভাজা ফলমূল সব কিছু দিয়ে পূজা করতে হয়। এই পূজায় সুরা তৈরি করে মাকে নিবেদন করা হয় এবং সুরা পান করে পূজারী মায়ের পূজা শুরু করেন।
এখানকার মায়ের রূপ বিস্ময়কর। তার শরীর জবাফুলের মতো লাল অথবা কোটিসূর্যের মতো উজ্জ্বল। তিনি নগ্না এবং আলুলায়িত কুন্তলা। ছিন্নমস্তা ষোড়শী এবং পীনোন্নত পয়োধরা, তাঁর হৃদয়ের কাছে একটি নীলপদ্ম রয়েছে। তাঁর গলায় নানান অলংকারের সাথে নরমুণ্ডের মালা দোদুল্যমান। দেবী ডান হাতে একটি তরবারি থাকে, যার মাধ্যমে তিনি তাঁর মস্তক ছিন্ন করেন। ছিন্নমস্তকে মুকুট ও অন্যান্য অলংকার দেখা যায়। তাঁর কবন্ধ থেকে তিনটি রক্তধারা বেরিয়ে আসতেও দেখা যায় যার একটি রক্তধারা তাঁর এবং অপর দুটি তাঁর দুই যোগিনী সহচরীর মুখে প্রবেশ করে। তাঁর দুই সহচরী – বামে ডাকিনী ও ডানে বর্ণিনী – এদের তমোগুণ ও রজোগুণের প্রতিক বলা হয়। দেবী ছিন্নমস্তা মৈথুনরত কাম ও রতির দেহের উপর দাঁড়িয়ে আছেন। কাম ও রতি উভয়েই প্রেমের দেবতা। কাম-রতি শায়িত রয়েছেন পদ্মের উপর এবং দেবীর পশ্চাদ্পটে রয়েছে শ্মশানঘাট। এই অপরূপে দেবী এ স্হানে পূজিতা হয়ে আসছেন
ভারত বাংলাদেশ সীমান্তে কাঁটাতারের সীমানা পেড়িয়ে মহাশ্মশান সংলগ্ন স্থানে প্রায় অর্ধ শতাব্দী ধরে এই দেবী পূজিতা হয়ে আসছেন। মন্দিরের পূর্বে বাংলাদেশের কুরিগ্রাম জেলার ভুরুঙ্গামারী থানা, পশ্চিমে অর্ধ চন্দ্রাকার সাহেবগঞ্জ ছরা, উত্তর দিকে কাঁটাতারের ভেতরে বাংলাদেশ সীমান্ত লাগোয়া নয়টি ভারতীয় পরিবারের বসবাস এবং দক্ষিণে কাঁটাতারের বেড়া পেরিয়ে সাহেবগঞ্জ বাজার।
অবিভক্ত ভারতবর্ষে বাংলাদেশ ও ভারতবর্ষের যোগাযোগের মাধ্যমের যে সুব্যবস্থা ছিল তা এখানে এলে এখানো বোঝা যায়। এখানে একটি রাস্তা এখনো বাংলাদেশ অভিমুখে বিস্তৃত হয়ে আছে যা ভারতীয় বি এস এফ কড়া প্রহরায় বন্ধ ।
মন্দিরের সামনে কয়েক কাটা জমির একটা ছিটমহল রয়েছে।এটা ভুটানি ছিটমহল নামে পরিচিত। অনেকের মতে কোচ রাজার কাছে তৎকালীন ভুটান রাজা শিকার করতে এসে এ স্হান ক্রয় করে রাত যাপন করে। যদি এর প্রামান্য তথ্য মেলেনি কেবল লোক মুখে প্রচলিত।
ছিন্নমস্তা মায়ের মন্দিরের সামনে কালী ঠাকুরের মন্দির রয়েছে যা কয়েকশ বছর ধরে পূজিত হয়ে আসছে। বিশাল বট গাছ আর শিমুল গাছের নীচে এই মন্দির।চৈত্র মাসের অষ্টমী তিথিতে মা কালী এখানে পূজিতা হন। সেই সাথে আগেরকার দিনে অষ্টমীর স্নানকে কেন্দ্র করে এখানে মেলা বসত যা "গুড়া খাওয়া " মেলা নামে পরিচিত ছিল। যদিও এখন মেলা তেমনটা আর হয়না। পরবর্তীতে দেশভাগের পর কাঁটাতারে আটকে যায় মানুষের আবেগ।
পূজাকে কেন্দ্র করে পুলিশ ও বিএস এফ এর কড়া নিরাপত্তায় মোড়া থাকে এ স্হল। সব মিলিয়ে সাহেবগঞ্জের সৎকার সমিতির পরিচালনা এই ছিন্নমস্তা পূজা বহু বছর ধরে এক ভিন্ন মাত্রা পেয়ে আসছে বলে মত বিশিষ্ট মহলের।
0 মন্তব্যসমূহ
Thank you so much for your kindness and support. Your generosity means the world to me. 😊