গড়কাটা মাশান বাবাকে ঘিরে নানান অজানা রহস্যের সন্ধান
তপন বর্মন, সংবাদ একলব্য:
মানবসভতার ঊষালগ্ন থেকেই নানারকম বিশ্বাস ও সংস্কারের ফলে লৌকিক দেবতার উৎপত্তি । লোক সংস্কৃতির উৎসই হল এই লৌকিক দেবতা। আর এই লৌকিক দেবতাদের মধ্যে অন্যতম হলেন মাশান ঠাকুর। গোটা উত্তরবঙ্গ তথা কোচবিহার, জলপাইগুড়ি, দার্জিলিং , আলিপুরদুয়ার ,দিনাজপুর,জেলা সহ নেপালের ঝাপামোরাং জেলা, আসামের ধুবড়ি, গোয়ালপাড়া, বঙ্গাইগাঁও, কোকরাঝাড় ও নলবাড়ি প্রভৃতি জেলায় মাসান ঠাকুরের পূজা ব্যাপক ভাবে প্রচলিত হয়ে আসছে।
এই মাশান ঠাকুরের সংখ্যা নিয়ে গবেষকদের মধ্যে মতভেদ রয়েছে। তবে বেশিরভাগ গবেষকের মতে মাশান ঠাকুর ১৯ রকমের । এদের মধ্যে একটি উল্লেখযোগ্য হল গড়কাটা মাশান।
কী আছে এই গড়কাটা মাশান বাবার রহস্য ? কীভাবে আবিভূর্ত হলেন এই মাশান ঠাকুর ? কীভাবে স্হাপিত হল মন্দির ? এই প্রশ্ন নিয়েও জল্পনার অবসান নেই।
কোচবিহার জেলার দিনহাটা মহকুমার গোসানীমারী ১ নং গ্রাম পঞ্চায়েতের অন্তর্গত সুজলা সুফলা গ্রাম ফুলবাড়ী। গ্রামের পাশ দিয়ে বয়ে গেছে কাটানদী । এই নদীর পূর্ব তীরেই মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে গড় কাটা মাশান পাঠের মন্দির। গোসানীমারীর রাজা কান্তেশ্বরের তৈরি গড় কেটে রাস্তা তৈরির সময় এই মাশান ঠাকুরকে থান দেওয়া হয় জন্য এর নাম হয় গড় কাটা মাশান বলে অনেকে মনে করেন। মন্দিরের দক্ষিণে এখনও কান্তেশ্বর রাজার গড়ের কিছু অংশ প্রাচীন স্মৃতিকে আকড়ে ধরে আছে।
মাশান ঠাকুরের জন্ম নিয়ে যেমন বিভিন্ন মতামত রয়েছে তেমনি মাশান ঠাকুরও বিভিন্ন স্থানে বিভিন্ন রূপে পূজা নেন। এ স্হানে গড়কাটা মাশান ঠাকুর কে শিব রূপে পূজা করা হয়। প্রচলিত কাহিনী অনুসারে কুবেরের অপর নাম ছিল যক্ষ। এই যক্ষের আর এক নাম যখা । রাজবংশী সমাজে এই যখাই শিব রূপে পূজিত হয়ে আসছেন।
আবার স্হানীয় কিছু প্রবীন ব্যক্তি জানান কামতেশ্বর রাজার গড়ের বিভিন্ন দুয়ারের মধ্যে একটি উল্লেখযোগ্য দুয়ার হল ধর্ম দুয়ার, যার কোনো সন্ধান মেলে না অথচ কথিত আছে এটি রাজবাড়ীর পূর্ব দিকে অবস্থিত। তাদের দাবি রাজা অন্তর্হিত হওয়ার পর এই ধর্ম দুয়ারে গড়কাটা মাশানের পাটে শিব মাশান রূপে এই পূজিত হয়ে আসছেন।
মন্দিরে মাশান ঠাকুরের মূর্তির পিছনে একটা স্মারক রয়েছে। সেখানে মাশান ঠাকুর যে শিবেরই আর আর এক রূপ,তা লিখিত আছে।
মাশান পূজা সাধারণত রাজবংশী সমাজের পুরুষ মানুষরাই বিনা মন্ত্র উচ্চারণে নিষ্ঠা সহকারে পূজা করে থাকেন। গড়কাটা মাশান ঠাকুরকেও প্রথমদিকে সেভাবেই পূজা করা হত। কিন্তু পরবর্তীতে সংস্কৃত মন্ত্র উচ্চারণে শিব মন্ত্রে এখানে মাশান ঠাকুরের পূজা শুরু হয়।
প্রসঙ্গত এখানকার মাশান ঠাকুরের সৌমকান্ত মূর্তি যা সত্যিই মনোমুগ্ধকর। অন্যান্য মাশান মূর্তির মধ্যে যে ভীতি প্রবণ রূপের প্রকাশ থাকে তা গড় কাটা মাশান ঠাকুরের মূর্তিতে নেই। মাশান ঠাকুরের প্রতিমাটি মাটির তৈরি, নীল বর্ণের সুঠাম দেহের অধিকারী। এক হাতে গদা ধারণ করে তিনি বেদিতে বসে আছেন। এছাড়াও ভক্তবৃন্দরাও অনেক সময় মানসা পূরণ হলে এ স্থানে নানান মাশান মূর্তি উৎসর্গ করে থাকেন।
গড়কাটা মাশান কতদিন ধরে এখানে পূজিত হয়ে আসছেন তার কোনো সুনির্দিষ্ট তথ্য পাওয়া না গেলেও স্হানীয় কিছু প্রচলিত কাহিনী অনুযায়ী এখানকার পূজা দেড় শতাব্দীরও প্রাচীন।
আগেকার দিনে গোসানীমারী বন্দর থেকে দিনহাটা চলাচলের প্রধান রাস্তা ছিল এটি। এই রাস্তা ধরে বহু মানুষ হাঁটা পথে কিংবা গরু গাড়ি, মোষের গাড়ি করে যাতায়াত করতেন। জনবসতিহীন ঘন জঙ্গল আর হিংস্র পশুর ভয়ে মানুষ নিত্য যাতায়াত কালে ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে পড়ত। তবে এই স্হানে এসে যদি কেউ মাশান বাবার স্মরণাপন্ন হতেন তবে স্বয়ং মাশান ঠাকুর মনুষ্য রূপ ধারণ করে হাতে লন্ঠন নিয়ে পথ চারীকে তার গন্তব্যে পৌঁছে দিতেন এবং কিছু দূর গিয়ে অদৃশ্য হয়ে যেতেন। আবার মাশান বাবার প্রতি অশ্রদ্ধা দেখানোর কারণেও অনেক সময় গাড়ি সমেত গাড়িয়ালকে গড়ের উপর তুলে রাখতেন। এধরনের ঠাকুরের ছলনার কথা লোকমুখে মুখে আজও প্রচলিত। তাদের বিশ্বাস মাশান ঠাকুরের এই ধরনের লীলার কারণেই সেসময় মানুষ জন এই স্থলে জঙ্গল পরিষ্কার করে একটা বড়ো শিমুল গাছের নীচে বড়ো পাথর রেখে মাশান ঠাকুরের পূজার প্রচলন শুরু করেন। পরবর্তীকালে ষাটের দশকে কাল্টু রায় বসুনিয়া নামে স্হানীয় এক ব্যক্তি ১৭ শতক জমি দান করে টিনের ঘর করে প্রথম এই মন্দিরের প্রতিষ্ঠা করেন। আশির দশকে সেই মন্দিরটি পাকা মন্দির করা হয় এবং দুই হাজার সালের প্রথম দশকে পূজাকমিটি ও দিনহাটার মারোয়াড়ী ব্যবসায়ী সমিতির উদ্যোগ বর্তমানের সুবৃহৎ সুন্দর মন্দিরটি নির্মিত হয়েছিল। প্রাচীন মন্দির গুলি মূল মন্দিরের উত্তর পাশে আজও প্রায় অক্ষত অবস্থায় রয়েছে। কাল্টু রায় বসুনিয়ার মৃত্যুর পর তার পুত্র অশ্বিনী রায় বসুনিয়া এখানে নিয়মিত পূজা অর্চনা করতেন। পরবর্তীতে নন্দেশ্বর মিশ্র নামে এক ব্রাহ্মণ এই মন্দিরের নিত্য পূজারী ছিলেন।
সারাবছর শনিবার মঙ্গলবার এখানে দুরদুরান্তের ভক্তরা এসে পূজা দিয়ে যান। মন্দিরের সামনে পাঠা , কবিতর ও শূকোর বলি দেওয়া হয়ে থাকে কিংবা বাবার নামে উৎসর্গ করে ছেড়ে দেওয়ার রীতি আছে। প্রসাদ হিসেবে দই চিরা গুড় বাতাসা আটিয়া কলা দিয়ে পূজা দিলেই বাবা সন্তুষ্ট হন বলে ভক্তের বিশ্বাস।পূজাকে কেন্দ্র করে প্রত্যেক বছর ১লা বৈশাখ থেকে ৩১ বৈশাখ পর্যন্ত জমজমাট মেলা বসে।মেলায় নাগরদোলা, বিভিন্ন খাবার দোকান, মনোহারীর দোকান, খেলনা, প্রদশর্নী, নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসের কেনাবেচা চলে। হাজার হাজার মানুষের ঢল নামে এই মেলায়। হিন্দু মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ের মানুষ এখানে আনন্দ নেন। এক প্রকার সম্প্রতির বন্ধনও এই মেলায় লক্ষ করা যায়।
ব্যক্তি ঋণ:
১। শিবু শর্মা
২। রোহিনী রায় বসুনিয়া
৩। বিনোদ রায়।
৪। নিবারণ বর্মন
৫। মিলন বর্মন।
৬। উপেন বর্মন।
0 মন্তব্যসমূহ
Thank you so much for your kindness and support. Your generosity means the world to me. 😊