এ কোলকাতার মধ্যে আছে আর একটা কোলকাতা

এ কোলকাতার মধ্যে আছে আর একটা কোলকাতা


ipsita sardar, kolkata


কলকাতার আদিগঙ্গার তীরে আজও দাঁড়িয়ে আছে জীর্ণপ্রায় প্রাচীন ঐতিহ্য নবরত্ন ছোটো রাসমন্দির। 


ঈপ্সিতা সরদার


কোলকাতার বুক চিরে আদিগঙ্গা বয়ে চলেছে, সে যাত্রাপথের খোঁজ‌ আমরা বিশেষ রাখি না। হয়তো দেখেছি কোনো কর্দমাক্ত সরু নালার মত জল বয়ে চলেছে, কিন্তু একটু লক্ষ্য করলে বোঝা যায়, দাঁড়িয়ে আছি জরাজীর্ণ গঙ্গার ঘাটেই। সে গঙ্গার জলে আজও সকলের অলক্ষ্যে ছায়া ফেলে প্রবাদ-প্রাচীন। 

নবরত্ন ছোটো রাসমন্দির



শহর কোলকাতার ব্যস্ত গলি, আভিজাত্যের স্পর্শ সে পথের প্রতি বাঁকে। কবি কালিদাসের বাড়ি পেরিয়ে আর বেশ কিছুটা এগিয়ে গেলেই বাওয়ালি রাজবাড়ীর প্রাচীন ঐতিহ্য, রাধাকৃষ্ণের ছোট রাস মন্দির। 

বিশাল মাঠে পড়ন্ত সূর্যের আলোয় ছোটো ছোটো শিশুরা খেলা করছে, মন্দিরের প্রবেশপথের পাশে ছোট্ট একটা ঘরের সামনে মন দিয়ে এক প্রতীমা শিল্পী মূর্তির চালাতে ছুঁইয়ে দিয়েছেন নিখুঁত হাতের পরশ, ফুটে উঠছে দেবীর অপরূপ সৌন্দর্য্য। মন্দিরের চারপাশে উঁচু পাঁচিল, সেই পাঁচিলের গা ঘেঁষে গড়ে উঠেছে মৃৎশিল্পীদের সাধনালয়। গা বেয়ে গঙ্গার ঘাট নেমে গেছে। জীর্ণ, কিন্তু তার আভিজাত্য মলিন‌ হয়নি। 

নবরত্ন ছোটো রাসমন্দির



পশ্চিমী ও ইউরোপীয় ঘরানার মিশেল স্পষ্ট ফুটে উঠেছে ঘাটের প্রতি কোনে। কোন সুদূর অতীতে মুঘল বালুঝড় এসে খুঁটি গেড়েছিল গঙ্গার শীতল হাওয়ার বুকে, সেই ইতিহাস বয়ে আজও স্রোত অক্ষুণ্ণ রেখেছে ভাগীরথী।

আঠারো‌ শতকে ক্লাইভের অনুরোধে বাওয়ালী রাজবাড়ীর সদস্যরা কোলকাতায় বসবাস করতে শুরু করেন। পারিবারিক ঐতিহ্য রক্ষার্থে রামনাথ মন্ডল এবং মানিক মন্ডল চেতলা অঞ্চলে গড়ে তোলেন একাধিক রাধাকৃষ্ণের মন্দির। তার মধ্যে অন্যতম এই নবরত্ন ছোটো রাস মন্দির। 

নবরত্ন ছোটো রাসমন্দির



কথিত আছে, রাণী রাসমণি এই মন্দিরের আদলেই দক্ষিনেশ্বরের মন্দির তৈরি করেন। আশ্চর্যের বিষয় এই যে, মন্দিরটি রাধাকৃষ্ণের হলেও সংলগ্ন অংশে বারোটি শিবমন্দির বর্তমান। প্রতিটি মন্দিরের শিবের পৃথক পৃথক নামকরণ কথা হয়েছিল-- ভুবনেশ্বর, রামচন্দ্রেশ্বর, কৈলাসনাথ, ভুতনাথ, সরেশ্বর, গোবিন্দচন্দ্রেশ্বর, নকুলেশ্বর, কমলাকান্তেশ্বর, ভোলানাথ, তারকানাথ, রত্নেশ্বর ও গোপেশ্বর। 

মন্দিরপ্রাঙ্গনে প্রবেশের মূল পথের বাইরে অস্পষ্ট তিনটি কষ্টিপাথরের ফলক দেখা যায়, যার থেকে সংগৃহীত তথ্য থেকে আমরা জানতে পারি এর প্রতিষ্ঠা কাল ও প্রতিষ্ঠাতার নাম। প্রাচীন বাংলা সংস্কৃত মিশ্রিত ভাষায় ফলকগুলি‌তে লেখা খোদাই‌ করা হয়েছে। সেই প্রাচীনকাল থেকে মন্দিরে ঢোকার নিয়মাবলী লেখা,"জুতো পরে মন্দিরে প্রবেশ নিষিদ্ধ, এমনকি ঘোড়া, হাতি, পালকি, গাড়ি অর্থাৎ কোনো বাহনে প্রবেশ করা নিয়মবিরুদ্ধ।" পেয়ারেলাল দাস ও মনিমোহন দাস এই মন্দিরের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন ১১ই মার্চ ১৮৪৬, এবং কাজ শেষ হয় ২রা এপ্রিল ১৮৪৭।

এখানে আরাধ্য সকল দেবতার মূর্তিই কষ্টি পাথরের নির্মিত। নবরত্ন মন্দিরটি উৎসর্গ করা হয়েছে আরাধ্য দেবতা শ্রী শ্রী গোপাল জীউ এর নামে। পঞ্চরত্ন মন্দির দুটি কাশীপতি শিবকে উৎসর্গ করা হয়েছে। বর্তমানে মন্দিরের নহবতখানার চিহ্নমাত্র নেই। আদিগঙ্গার ঘাটেও ভাঙন ধরেছে। মন্দিরের পূজারী নিত্যপূজা করেন বটে, কিন্তু যত্ন ও সংরক্ষনের অভাবে ধীরে ধীরে ধ্বংসের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে ঐতিহ্যপূর্ণ এই মন্দির। বাওয়ালী মূল রাজবাড়ী বর্তমানে সংরক্ষিত হলেও, অনিশ্চিত এই মন্দিরের ভবিষ্যৎ।


তথ্যসূত্র: "কলিকাতা সেকালের ও একালের": হরিসাধন মুখোপাধ্যায়
চিত্রগ্রহণ: দেবার্ঘ্য কুমার চক্রবর্ত্তী

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ