বাঙালি ও বাংলা মাসের শেষ পুজো চড়ক পূজা ও কিছু কথা


বাঙালি ও বাংলা মাসের শেষ পুজো হল চড়ক পূজা।

চড়ক পূজা বাংলা তথা বাঙালির বিখ্যাত উৎসব । চৈত্রের শেষ দিনে এই পূজা অনুষ্ঠিত হয় এবং বৈশাখের প্রথম দু-তিন দিনব্যাপী চড়ক পূজার উৎসব চলে। লিঙ্গপুরাণ, বৃহদ্ধর্মপুরাণ এবং ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণে চৈত্র মাসে শিব আরাধনা প্রসঙ্গে নৃত্যগীতাদির উল্লেখ থাকলেও চড়ক পূজার উল্লেখ পাওয়া যায় না।পঞ্চদশ-ষোড়শ শতাব্দীতে রচিত গোবিন্দানন্দের ‘বর্ষক্রিয়াকৌমুদী’ এবং রঘুনন্দনের ‘তিথিতত্ত্বে’ চড়কের উল্লেখ মেলে না। লোকগবেষকদের কাছ থেকে জানা যায়, পাশুপত সম্প্রদায়ের মধ্যে প্রাচীনকালে চড়ক উৎসব প্রচলিত ছিল। তবে চড়ক পূজা সঠিক কবে থেকে এবং কিভাবে শুরু হয়েছিল তার সঠিক ইতিহাস আজও জানা যায়নি।‘চড়ক’ বা ‘শিবের গাজন’ বা ‘নীল পূজা’ এক এক জায়গায় এক এক নামে পরিচিত। যেমন, চড়ক পূজার নাম মালদহে ‘গম্ভীরা’ বা দিনাজপুরে ‘গমীরা’। 



ইতিহাস ঘেঁটে কেউকেউ জানিয়েছেন, শিবের গাজনের উৎপত্তি নাকি ধর্মঠাকুরের গাজন থেকে। তবে জনশ্রুতি রয়েছে, পঞ্চদশ শতকের শুরুর দিকে সুন্দরানন্দ ঠাকুর নামে এক রাজা এই চড়ক-পূজার প্রথম প্রচলন করেন। রাজ পরিবারের লোকজন এই পূজা আরম্ভ করলেও চড়কপূজা কোনোদিনই রাজ-রাজড়াদের পূজা ছিল না। চড়ক হিন্দু সমাজের লোকসংস্কৃতির অঙ্গ মাত্র বলা। আসলে এই পূজার সন্ন্যাসীরা প্রায় সবাই হিন্দু ধর্মের নিম্নবিত্ত সম্প্রদায়ের লোক। তাই চড়ক পূজায় কোনও ব্রাহ্মনের প্রয়োজন পড়ে না।মহাদেবের সন্তুষ্টি লাভের আশায় সপ্তাহব্যাপী নানান পূজার আয়োজন করা হয়। ‘ফলপূজা’, ‘কাদাপূজা’, ‘নীলপূজা’সহ সপ্তাহব্যাপী বিভিন্ন পূজা শেষে আয়োজন করা হয় চড়ক পূজার। 



এই চড়ক পূজায় সাধারণত গ্রামে একজন ‘মূল সন্ন্যাসী’ থাকেন যিনি বাকিদের পরিচালনা করেন। গ্রামের যেকেউ এই ‘বিশেষ সন্ন্যাস’ নিতে পারেন। তবে সন্ন্যাস নেওয়ার জন্যে এক মাস উপবাস, ফলাহার, হবিষ্যির মতো কঠিন নিয়মের মধ্যে দিয়ে যেতে হয় তাঁকে। তবে কালের গতিতে আজ এই নিয়ম এখন অনেকটাই শিথিল। এখন শুধুমাত্র একমাস বা একসপ্তাহ নিরামিষ আহারের মাধ্যমে সন্ন্যাস পালন করেন সন্ন্যাসীরা।



মাসব্যাপী উপবাস এবং নানা প্রকারের দৈহিক যন্ত্রণা ধর্মের অঙ্গ বলে বিবেচিত হয় এই উৎসবে, হিন্দু ধর্মে যাকে বলে ‘কৃচ্ছ সাধনা’। উদ্যোক্তারা কয়েকজনের একটি দল নিয়ে সারা অঞ্চলে ঘুরে বেড়ান। দলে থাকেন একজন শিব এবং গৌরী। মাঝে মাঝে কালী, লক্ষ্মী, সরস্বতী, কার্তিক, গণপতি, অসুর এবং দুর্গার বাহন সিংহকেও দেখা যায়।শিব ভক্তিমূলক গানের সঙ্গে চলে নাচাগানা।সখীদের পায়ে বাঁধা থাকে ঘুঙুর।সঙ্গে থাকে ঢোল-কাঁসরসহ একদল বাদক।সখীরা গান ও বাজনার তালে তালে নাচে।এদেরকে স্থানীয় ভাষায় কেউকেউ ‘নীল পাগলের দল’ও বলে থাকেন। চড়কগাছে ভক্ত বা সন্ন্যাসীকে একটি চাকার সঙ্গে বেঁধে দ্রুতবেগে ঘোরানো হয়। তাঁর পিঠে, হাতে, পায়ে, জিহ্বায় এবং শরীরের অন্যান্য অঙ্গে বাণ-শলাকা বিদ্ধ করা হয়। 



লোকবিশ্বাস, তন্ত্রশক্তির সাহায্যে নানান অসাধ্য সাধন করা হয় এই চড়ক পূজার সময়। চড়ক পূজায় ঈশ্বরের ভর করা, কাঁচের ওপর দিয়ে হাঁটা, জ্বলন্ত কয়লার ওপর দিয়ে হাঁটা, হাতে অস্ত্র দিয়ে কোপানো, ধারাল অস্ত্রের ওপর দাঁড়ানো ইত্যাদি নানান কেরামতি চলতে থাকে। অষ্টাদশ শতকের প্রথম দিকে ব্রিটিশ সরকার আইন করে এই নিয়ম বন্ধ করলেও গ্রামের সাধারণ লোকের মধ্যে এসব এখনও প্রচলিত।