পথ দুর্ঘটনায় প্রয়াত হলেন মেদিনীপুরের কেবল টিভি ও ‘বৈদ্যুতিন সংবাদ’ জগতে বিপ্লবের অন‍্যতম অগ্রদূত সুবীর সামন্ত



শচীন পাল, সংবাদ একলব্যঃ মর্মান্তিক পথদুর্ঘটনায় আহত হয়ে অকালেই প্রয়াত হলেন মেদিনীপুরের কেবল টিভি ও বৈদ‍্যুতিন সংবাদ জগতের পুরোধা ব্যক্তিত্ব সুবীর সামন্ত। মৃত‍্যুকালে বয়স হয়েছিল ৫৪ বছর। বুধবার রাতে চব্বিশ পরগনা থেকে নিজেদের ফটোগ্রাফি সংগঠনের কর্মসূচি শেষ করে কোলাঘাটে ঢোকার মুখে রাত সাড়ে এগারোটা নাগাদ, নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে তাঁর গাড়ী রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকা একটি দশ চাকার নির্মীয়মান গাড়িকে ধাক্কা মারে। চালক এবং পিছনের সিটে বসে থাকা সুবীরবাবু গুরুতর আহত হন। 


পুলিশের ভ্রাম্যমান গাড়ি তাঁদের উদ্ধার করে উলুবেড়িয়া হাসপাতালে নিয়ে যায়। খবর পেয়ে রাতেই পারিবারিক বন্ধু সস্ত্রীক হ‍্যাপি পালের সাথে উলুবেড়িয়া ছুটে যান সুবীরবাবুর স্ত্রী চন্দা সামন্ত। হাসপাতালে ভর্তি করা পরেও কয়েক ঘণ্টা জীবিত ছিলেন সুবীর বাবু। কিন্তু প্রচুর রক্তক্ষরণ ও গুরুতর আঘাতের কারণে সুবীরবাবুকে বাঁচানো যায় নি। যদিও ড্রাইভার বেঁচে যান এবং পরে তাঁকে মেদিনীপুর হাসপাতালে নিয়ে আসা হয়। খবর পেয়ে বৃহস্পতিবার কাকভোরেই উলুবেড়িয়া ছুটে যান সুবীরবাবুর বন্ধু অনয় মাইতি, দুলাল দত্ত, বিদ্যুৎ দাস সহ অন্যান্যরা। বৃহস্পতিবার সকালে তাঁর মৃত্যুর খবর ছড়িয়ে পড়তে গোটা মেদিনীপুর শহর জুড়ে শোকের ছায়া নেমে আসে।

বিগত শতাব্দীর নয়ের দশকের দ্বিতীয়ার্ধে সহযোগীদের সঙ্গে নিয়ে মেদিনীপুর শহরের অলিগলি কেবল টিভি সংযোগ পৌছে দিয়ে ছিলেন সুবীর সামন্ত। পাশাপাশি শহর ও জেলার খবর বাড়িতে বাড়িতে পৌঁছে দেওয়ার লক্ষ্যে কেবল টিভি চ্যানেলে বৈদ‍্যুতিন মাধ‍্যমে, নিজের উদ্ভাবনী চিন্তা দিয়ে শুরু করেছিলেন "স‍্যাটলিংক সংবাদ"। তার পরে মেদিনীপুরে অন‍্যরা এই রকম প্রয়াস নিলেও সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয় ছিল স‍্যাটলিংক সংবাদ। সেসময় মেদিনীপুরবাসীর নৈশভোজের অন‍্যতম সঙ্গী ছিল স‍্যাটলিংক সংবাদ। 

অবিভক্ত মেদিনীপুর জেলায় মেদিনীপুর কলেজ, কেডি কলেজ কিংবা বিদ্যাসাগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সংসদ নির্বাচনের বিভিন্ন খবর যথেষ্ট গুরুত্ব পেত স‍্যাটলিংকে। পুরসভা নির্বাচন নিয়ে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধি দের উপস্থিতিতে বিতর্ক বেশ জনপ্রিয় ছিল স‍্যাটলিংকে। বিভিন্ন কাজেরসূত্রে পরোপকারী, সদাহাস্যময় ব‍্যক্তিত্ব সুবীর সামন্তবাবু দলমত নির্বিশেষে সকলের কাছে অতি প্রিয় একজন ব্যক্তিত্ব হিসেবে পরিচিত হয়ে উঠেছিলেন। সুবীরবাবু মেদিনীপুর কলেজ গেটে অবস্থিত তাঁর উর্জ্জনা স্টুডিও থেকে ছাত্র-ছাত্রীদেরর্ট আর্জেন্ট ফটো সরবরাহ করতেন। উর্জ্জনা স্টুডিওর কর্ণধার সুবীর সামন্ত কেবল টিভির মাধ্যমে অবিভক্ত মেদিনীপুরের বৈদ্যুতিন সংবাদমাধ্যমে এনেছিলেন এক বিপ্লব । তার কেবল নেটওয়ার্ক এর মাধ্যমে তিনি প্রায় ২৬ বছর ধরে গ্রাহকদের নিরবিচ্ছিন্ন পরিষেবা দিয়ে গেছেন। 

তাঁর তৈরী লোকাল টিভি চ্যানেল এর মাধ্যমে রাজনীতি, খেলাধুলা, কুইজ, বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানকে মানুষের কাছে পৌঁছে দিতেন সুবীর বাবু। এক্ষেত্রে স‍্যাটলিংকের প্রথম যুগের বার্তা সম্পাদক সাংবাদিক রাহুল ঘোষ এবং একঝাঁক তরুণ তুর্কি সাংবাদিক ও সংবাদ পাঠক-পাঠিকাদের গুরুত্বপূর্ণ অবদান ছিল। শারোদৎসব কিংবা মহরমের​ শোভাযাত্রার পুরস্কার বিতরণী উপলক্ষ্যে বিভিন্ন নামীদামী শিল্পীদের সমন্বয়ে মেদিনীপুর শহরে সংস্কৃতিক জলসা ও বড় বড় জায়ান্ট স্ক্রিনে তার সম্প্রচার অথবা ‘ড্রোন‘ উড়িয়ে মিছিল-মিটিংয়ের ছবি তোলা, সবক্ষেত্রে নতুনত্বের জন্যই বিখ্যাত ছিলেন সুবীর সামন্ত। বর্তমানে মেদিনীপুরে বহু প্রখ্যাত চিত্র সাংবাদিক ও সাংবাদিক তাঁর হাতেই তৈরি । বহুক্ষেত্রেই আর্থিক ঝুঁকি নিয়ে কাজ করতে গিয়ে আর্থিক ক্ষতির মুখেও পড়েছেন সুবীর বাবু। বর্তমানে ফটোগ্রাফি সংগঠনের কাজ ও নিজের প্রিন্টিং ব‍্যবসা নিয়ে ব‍্যস্ত থাকতেন সুবীর বাবু।

এহেন সদা হাস্যময়, পরোপকারী এহেন ব্যক্তির অকালমৃত্যুতে মেদিনীপুরে নেমে আসে শোকের ছায়া। সোশ্যাল মিডিয়ায় ছয়লাপ হয়ে যায় শোকবার্তায়​। উলুবেড়িয়া হাসপাতালে তাঁর মরদেহ ময়নাতদন্তের পর সন্ধ্যায় নাগাদ মেদিনীপুর শহরে পৌঁছায় । শেষ বিদায় জানান মেদিনীপুরের কেবল টিভি অপারেটর সংগঠন, সাংবাদিকবৃন্দ , ফটোগ্রাফারবৃন্দ, থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষ এবং তাঁর গুণমুগ্ধরা ও বন্ধুরা। তিনি রেখে গেলেন স্ত্রী চন্দা সামন্ত ও একমাত্র পুত্র শান্তশীল সামন্তকে। সুবীরবাবুর মৃত‍্যুতে মেদিনীপুরর কেবল টিভি জগত ও বৈদ‍্যুতিন সংবাদ জগতের একটি যুগের অবসান ঘটলো।